শিরোনাম
শনিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর বিএনপি

♦ বছরে দল ও অঙ্গ সংগঠনের অর্ধশতাধিক শোকজ ও বহিষ্কার ♦ সতর্ক করা হচ্ছে বড় বড় নেতাকে ♦ বহিষ্কার হতে পারেন অনেকে

শফিউল আলম দোলন

দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থান নিচ্ছে বিএনপি। দৃঢ়তার সঙ্গে দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখতে চান ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। এ লক্ষ্যে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার অতিরিক্ত ক্ষমাসুলভ আচরণে লাগাম টানার কৌশল নিয়েছেন তিনি। গত এক বছরে সারা দেশে দল ও অঙ্গ সংগঠনের অর্ধ শতাধিক নেতা-কর্মীকে বহিষ্কারসহ নানা কারণে শোকজ নোটিস দেওয়া হয়েছে। বহিষ্কৃতদের অধিকাংশই দলীয় শৃঙ্খলার পরিপন্থী কাজে জড়িত থাকার দায়ে বিএনপির গঠনতন্ত্রের ৫ (গ) ধারা মোতাবেক প্রাথমিক সদস্য পদসহ সব পর্যায়ের পদ থেকে বহিষ্কার হন। স্থায়ী ও নির্বাহী কমিটির আরও পাঁচজন সদস্যকে খুব শিগগিরই সতর্ক করে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। দলের নির্ভরযোগ্য একাধিক সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।   

বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অনেক উদার। শত অপরাধ করলেও তিনি মাফ করে দিতেন। তবে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ততটা উদার নন। যে কোনো মূল্যে তিনি দলের মধ্যে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে চান। সংশ্লিষ্ট নেতা-কর্মীদের মধ্যে সেই বার্তা দিতেই শৃঙ্খলাবিরোধী কর্মকান্ডে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। 

জানা গেছে, কিছুদিনের মধ্যেই দলের স্থায়ী কমিটির দুজন সদস্য, নির্বাহী কমিটির দুজন ভাইস চেয়ারম্যান ও একজন যুগ্ম মহাসচিবকে নতুন করে কারণ দর্শানোর নোটিস দেবে দলীয় হাইকমান্ড। দর্শানো কারণ সন্তোষজনক না হলে তাদেরও পর্যায়ক্রমে বহিষ্কার করা হতে পারে। দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ এনে সর্বশেষ গত বুধবার কারণ দর্শানো হয়- দলের অন্যতম ভাইস চেয়ারম্যান শওকত মাহমুদকে। কারণ তিনি দলীয় অনুমোদন ছাড়াই গত ২৭ মার্চ জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে সম্মিলিত পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের ব্যানারে বিক্ষোভ সমাবেশ করেছেন। তবে তিনি স্বল্প সময়ের মধ্যেই এ দলীয় কারণ দর্শানোর চিঠির জবাব দেবেন বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান। একই দিনে নেত্রকোনা জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ও সাবেক এমপি আশরাফউদ্দিন খান, চাঁদপুরের ইঞ্জিনিয়ার মোমিনুল ইসলামসহ আরও কয়েকজনকে কারণ দর্শানো চিঠি প্রদানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে। সাবেক প্রতিমন্ত্রী আ ন ম এহছানুল হক মিলনকে পদাবনতি করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক থেকে সরিয়ে তাকে দলের নির্বাহী কমিটির সদস্য করা হয়েছে। তবে বিএনপির ত্যাগী নেতাদের ওপর এসব বহিষ্কারাদেশ, শোকজ নোটিস, দলীয় পদ-পদবি কেড়ে নেওয়া, পদাবনতি দেওয়া, আবার প্রত্যাহার করার বিষয়গুলো নিয়ে দলের ভিতরে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। অনেকে এসব কার্যক্রমকে দলের ভিতরের একটা গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন। তারা এটাকে দল ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আখ্যা দিয়ে বলেছেন, একে একে বিএনপির জনপ্রিয় ও ত্যাগী নেতাদের বেছে বেছে  দল থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে বিএনপির ভাঙন চূড়ান্ত ধাপে এসে পৌঁছেছে। আর এ ভাঙনের প্রক্রিয়া হিসেবেই বিভিন্ন এলাকার জনপ্রিয় নেতাদের বহিষ্কার করা হচ্ছে। খুলনার জনপ্রিয় নেতা নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে বহিষ্কার করার পর বহিষ্কার হন নারায়ণগঞ্জের তৈমূর আলম খন্দকার। আর সর্বশেষ বহিষ্কার হলেন সাবেক এমপি ও কিশোরগঞ্জ জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি মেজর (অব.) আখতারুজ্জামান। বিএনপির একাধিক সিনিয়র নেতার অভিযোগ, ‘বিএনপিকে ক্ষমতায় আনার চেয়ে শেখ হাসিনার শাসনামল অনেক ভালো’, ‘বিএনপির কোনো ভিশন নেই’, ‘নেতাদের শরম হবে যখন কর্মীরা তাদের জুতাপেটা করবে’, দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানকে ‘বেয়াদব’ বলে আখ্যায়িত করাসহ দলের জন্য অবমাননাকর এমন সব বক্তব্যের কারণে একাধিকবার দলের পক্ষ থেকে আখতারুজ্জামানকে মৌখিকভাবে সতর্ক করা হয়। কিন্তু তিনি তা না মানায়  শেষ পর্যন্ত দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তবে কারও কারও মতে, এসব বহিষ্কারের মধ্য দিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ গ্রুপিং যেমন বেড়ে চলেছে, তেমনি ভাঙন প্রক্রিয়াও ত্বরান্বিত হচ্ছে।  বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, এটি একটি চলমান প্রক্রিয়া। দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গকারী যে-ই হন না কেন, তার বিরুদ্ধেই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যথায় দলীয় শৃঙ্খলা ধরে রাখা যাবে না। জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপিতে প্রথম মতবিরোধ তীব্র আকার ধারণ করে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়া নিয়ে। এ প্রক্রিয়ায় অনেকে মনে করেছিলেন যে বিএনপির এতে অংশগ্রহণ করা উচিত ছিল। বিশেষ করে নির্দলীয়, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার হোক বা না হোক, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠিত না হলে সুষ্ঠু নির্বাচন অসম্ভব ব্যাপার। কিন্তু বিএনপি একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দল হিসেবে যে ভূমিকা, সে ভূমিকা পালনে অক্ষমতা প্রকাশ করে। যে কারণে তাদের এ ধরনের আচরণে বিএনপির মধ্যেও এক ধরনের অসন্তোষ তৈরি করেছে। যারাই সাংগঠনিকভাবে একটু বেশি জনপ্রিয় এবং দলের জন্য চিন্তিত, তাদেরই দল থেকে ছেঁটে ফেলা হচ্ছে। এর মধ্য দিয়ে দলের ভিতরে ক্ষোভ-অসন্তোষ দানা বেধে উঠছে।   

এ বিষয়ে দলের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সৈয়দ এমরান সালেহ প্রিন্স বলেন, শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে কয়েকজনকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। কারও কর্মকাে  দল যদি ক্ষতিগ্রস্ত হয় সেক্ষেত্রে বহিষ্কার হওয়াটা তো সাংগঠনিক নিয়ম। আমি মনে করি এসব বহিষ্কারে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। বরং দলে আরও স্বচ্ছতা আসে। তবে দল পুনর্গঠনের সঙ্গে যুক্ত একাধিক নেতা জানান, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দায়িত্ব নেওয়ার পর দলে শৃঙ্খলা ফেরাতে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন। এর অংশ হিসেবে দলের সিনিয়র নেতাসহ বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের শোকজ প্রদানসহ তাদের পদ থেকে বহিষ্কার করা হচ্ছে। এর আগে ভোট বয়কটের দলীয় সিদ্ধান্ত লঙ্ঘন করে সিটি নির্বাচনে মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করায় নারায়ণগঞ্জে বিএনপি চেয়ারপারসনের সাবেক উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট তৈমূর আলম খন্দকারকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়। এর আগে দলীয় কর্মসূচিতে নিষ্ক্রিয় থাকায় বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ও কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র মনিরুল হক সাক্কু সদস্যপদ হারান। এ ছাড়া খুলনা জেলা ও মহানগর শাখার কমিটি ঘোষণার পর হাইকমান্ডের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করায় অব্যাহতি দেওয়া হয় বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক নজরুল ইসলাম মঞ্জুকে।

সর্বশেষ খবর