শনিবার, ৯ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রোজা না রাখার অবকাশ আছে যাদের

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রোজা না রাখার অবকাশ আছে যাদের

বান্দাকে মুত্তাকি বানানোর ট্রেনিং হিসেবে আল্লাহতায়ালা মাহে রমজানের এক মাসের সিয়াম সাধনা ফরজ করেছেন। না খেয়ে থেকে বান্দার কষ্ট হোক আল্লাহতায়ালার এ ইচ্ছা নেই। তাই তো বান্দার একান্ত অসুবিধার কথা ভেবে রোজা রাখার ক্ষেত্রে ছাড়ও দিয়েছেন আল্লাহতায়ালা। আসুন জেনে নিই রোজা না রাখার অনুমতি আছে যাদের তাদের সম্পর্কে।  প্রথমত, ভ্রমণরত ব্যক্তির জন্য রোজা না রাখার সুযোগ রয়েছে। তবে অস্বাভাবিক কষ্ট না হলে রোজা রাখাই উত্তম। আর অস্বাভাবিক কষ্ট হলে রোজা রাখা মাকরুহ। এ অবস্থায় রোজা না রেখে পরে তা কাজা করবে। আছিম (রহ.) বলেন, আনাস (রা.)-কে ভ্রমণে রোজা রাখার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ‘ভ্রমণকালে যে রোজা রাখবে না সে অবকাশ গ্রহণ করল। আর যে রোজা রাখল সে উত্তম কাজ করল।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বা। ) ইমাম আবু হানিফা (রহ.) এর মতে, ভ্রমণের শুরুতে রোজা রাখলে পথে আর ভাঙা জায়েজ নয়। কেউ ভেঙে ফেললে গুনাহগার হবে। তবে কাফফারা আদায় করতে হবে না। শুধু কাজাই যথেষ্ট। আনাস (রা.) বলেন, ‘কেউ রোজা রেখে ভ্রমণে বের হলে রোজা ভাঙবে না। তবে যদি পিপাসার কারণে প্রাণনাশের আশঙ্কা হয় তাহলে ভাঙতে পারবে, পরে তা কাজা করে নেবে। (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩য় খন্ড, ৪০৩ পৃষ্ঠা।) তবে ইমাম আহমদ (রহ.) বলেছেন, ভ্রমণের পথেও রোজা ভাঙা জায়েজ। ইমাম শাফেয়ি (রহ.) এর ফতোয়াও তাই। (তাফসিরে মাজহারি, ১ম খন্ড, ৩৬৯ পৃষ্ঠা।) ভ্রমণের শুরুতে রোজাদার ছিল না, কিন্তু সূর্যোদয়ের আগে সে নিজ বাসস্থানে ফিরে এসেছে, এমন ব্যক্তির ক্ষেত্রে হুকুম হলো অবশিষ্ট সময় রমজানের মর্যাদা রক্ষার্থে পানাহার থেকে বিরত থাকবে। এটা ওয়াজিব। তবে পরবর্তী সময়ে এ রোজার কাজা অবশ্যই করতে হবে। ইবরাহীম নাখায়ি (রহ.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের দিনে ভ্রমণরত থাকার কারণে পানাহার করেছে, নিজ বাসস্থানে পৌঁছার পর ইফতারের আগে সে আর পানাহার করবে না।’ (ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ৩য় খন্ড, ৪২৮ পৃষ্ঠা।) হাসান (রা.) বলেন, ‘সুবহে সাদিকের পর যে নারী ঋতুস্রাব থেকে পবিত্র হয়েছে সে দিনের বাকি অংশে পানাহার করবে না এবং এদিনের রোজা পরবর্তীতে কাজা করবে।’ (বাহরুর রায়েক, ২য় খন্ড, ২৯১ পৃষ্ঠা।)

দ্বিতীয়ত, অসুস্থ ব্যক্তির রোজার কারণে রোগ বৃদ্ধি পাওয়ার প্রবল আশঙ্কা থাকলে রোজা না রাখার অবকাশ আছে। উল্লেখ্য, আশঙ্কা যদি সুস্পষ্ট হয় তাহলে তো কথা নেই। নতুবা একজন অভিজ্ঞ ও দীনদার চিকিৎসকের মতামতের প্রয়োজন হবে। (মুহিতুল বুরহানি, ৩য় খন্ড, ৩৫৯ পৃষ্ঠা।) এক্ষেত্রে অনেকেই রোজা থেকে বাঁচতে নিজেই নিজের রোগ আবিষ্কার করে ফেলেন। এমনটি করলে সে রোজার দায়ভার থেকে মুক্ত হবে না। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, দুনিয়ার সব মানুষকে ফাঁকি দেওয়া গেলেও আল্লাহকে ফাঁকি দেওয়া সম্ভব নয়। তাফসিরে মাজহারির লেখক আল্লামা কাজী সানাউল্লাহ পানিপথী (রহ.) রোজা না রাখার অবকাশ ব্যক্তিদের আলোচনা করতে গিয়ে ইমাম আহমদ (রহ.) এর ফতোয়া উল্লেখ করে বলেন, অসুস্থ এবং মুসাফির ব্যক্তি চাইলে রোজা রাখতে পারবে। তবে তারা রোজা রেখে স্ত্রী সহবাস করতে পারবে না। যদি করে ফেলে তাহলে তাদের কাফফারা আদায় করতে হবে। কিন্তু রোগী বা মুসাফির যদি কিছু খেয়ে রোজা ভাঙার পর স্ত্রী সহবাস করে তাহলে কাফফারা আদায় করতে হবে না, কাজা করলেই যথেষ্ট হবে। তাবেয়িদের মধ্যে ইবনে সিরিন (রহ.) মনে করতেন, সামান্য অসুখেও রোজা না রাখার অবকাশ আছে। আর ইবরাহীম নাখয়ি এবং হাসান বসরি (রহ.) এর মতে, দাঁড়িয়ে নামাজ পড়ার ক্ষমতা নেই- এমন পর্যায়ের অসুস্থ হলে রোজা ভাঙতে পারবে। (তাফসিরে মাজহারি, ১ম খন্ড, ৩৬১ পৃষ্ঠা।) তৃতীয়ত, গর্ভবতী। রোজা রাখার কারণে গর্ভবতী মহিলা নিজের কিংবা সন্তানের প্রাণহানি বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির প্রবল আশঙ্কা করলে তার জন্য রোজা ভঙ্গ করা জায়েজ। পরে এ রোজা কাজা করে নেবে। (মুহিতুল বুরহানি, ৩য় খন্ড, ৩৫৯ পৃষ্ঠা।) চতুর্থ, দুগ্ধদানকারিনী মা রোজা রাখলে যদি সন্তান দুধ না পায় আর ওই সন্তান অন্য কোনো খাবারেও অভ্যস্ত না হয়, ফলে দুধ না পাওয়ার কারণে সন্তানের মৃত্যু বা মারাত্মক স্বাস্থ্যহানির আশঙ্কা হয়, তাহলে তিনি রোজা ভাঙতে পারবেন এবং পরে কাজা করে নেবেন। হাদিস শরিফে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহতায়ালা মুসাফিরের জন্য রোজার হুকুম শিথিল করেছেন এবং আংশিক নামাজ কমিয়ে দিয়েছেন। আর গর্ভবতী ও দুগ্ধদানকারিনীর জন্যও রোজার হুকুম শিথিল করেছেন।’ (তিরমিজি।) পঞ্চমত, দুর্বল বৃদ্ধ। বার্ধক্যজনিত কারণে রোজা রাখতে সক্ষম না হলে রোজা না রাখার অনুমতি রয়েছে। এক্ষেত্রে প্রত্যেক রোজার পরিবর্তে একজন গরিবকে দুইবেলা খাবার খাওয়াবে অথবা পৌনে ২ কেজি গমের মূল্য সদকা করবে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘আর যাদের জন্য রোজা রাখা অত্যন্ত কষ্টকর তারা ফিদয়া তথা একজন মিসকিনকে খাবার খাওয়াবে। (সূরা বাকারা, আয়াত ১৮৪। )

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি

সর্বশেষ খবর