সোমবার, ১১ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

পাকিস্তানে নতুন সরকার আজ

মাত্র দুই ভোটে আউট ইমরান, প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন শাহবাজ শরিফ

প্রতিদিন ডেস্ক

পাকিস্তানে নতুন সরকার আজ

শাহবাজ শরিফ

দীর্ঘ নাটকীয়তার পর শনিবার মধ্যরাতে জাতীয় পরিষদের ভোটাভুটিতে হেরে গিয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। তিনি হেরে গেছেন দুই ভোট কম পাওয়ায়। এরপর আজ নির্বাচন করা হচ্ছে নতুন প্রধানমন্ত্রী। ধারণা করা হচ্ছে, এই নতুন প্রধানমন্ত্রী হবেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সভাপতি শাহবাজ শরিফ। তার নেতৃত্বে গঠন হচ্ছে আরেকটি জোট সরকার।

জিও নিউজের প্রতিবেদন অনুযায়ী, পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে আজ সোমবার দেশটির পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসছে। এর আগে জাতীয় পরিষদ সচিবালয় থেকে জানানো হয়, প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য আগ্রহী প্রার্থীরা রবিবার (গতকাল) স্থানীয় সময় বেলা ১১টা থেকে ২টা পর্যন্ত তাদের মনোনয়নপত্র জমা দেন। বিকাল ৩টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই হয়। আজ বিকাল ৩টায় জাতীয় পরিষদে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচন করা হবে। ইমরান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর দেশটির পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে যার নাম সবচেয়ে আলোচিত হচ্ছে, তিনি পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) সভাপতি শাহবাজ শরিফ।

মনোনয়ন সম্পর্কে জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য গতকাল দুপুর ২টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা নেওয়ার পর বিকাল ৩টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়। পাকিস্তানের ঐক্যবদ্ধ বিরোধীদলীয় প্রার্থী ও পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) প্রেসিডেন্ট শাহবাজ শরিফ ও সদ্য-ক্ষমতাচ্যুত পাকিস্তান তেহরিক-ই ইনসাফ নেতৃত্বাধীন সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শাহ মাহমুদ কুরেশি প্রধানমন্ত্রী পদে পুনর্নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য মনোনয়ন দাখিল করেন। বিরোধী নেতা শহীদ খাকান আব্বাসি, সৈয়দ নাভিদ কামার, খুরশিদ আহমেদ শাহ, মহসিন দাওয়ার এবং অন্যদের সঙ্গে নিয়ে জাতীয় পরিষদের সচিবালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন শাহবাজ শরিফ। বলা হয়, তিনি ঐক্যবদ্ধ বিরোধী দলের প্রার্থী হিসেবে প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন।

মনোনয়নপত্র দাখিলের পর সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে শাহবাজ শরিফ জানান, জাতীয় সম্প্রীতিই হবে তার সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের বিষয়। অর্থনীতি চাঙা করে জনগণকে স্বস্তি দেওয়া হবে। পিএমএল-এনের এই নেতা আরও উল্লেখ করেন, বিরোধী নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করার পর তিনি নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করবেন। তিনি বলেন, তারা একটি নতুন যুগের সূচনা এবং দেশে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের সংস্কৃতির প্রচার করবেন। পররাষ্ট্রনীতির ব্যাপারে শাহবাজ শরিফ জানান, তারা ভারতের সঙ্গে শান্তি চান, কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার সমাধান ছাড়া তা সম্ভব নয়। তিনবারের সাবেক পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের মামলার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে শাহবাজ শরিফ বলেন, মামলা আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে। ইমরান অপসারিত হওয়ার ঘটনা : আগের খবর অনুযায়ী, দিনভর নানা নাটকীয়তা শেষে গত শনিবার বাংলাদেশ সময় দিবাগত রাত ২টার দিকে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অনাস্থা ভোটে হেরে ক্ষমতা থেকে অপসারিত হন ইমরান খান। ৩৪২ আসনের পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে ভোট পড়ে ১৭৪টি। তাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে দরকার ছিল ১৭২ ভোট। ফলে মাত্র ২ ভোট পক্ষে এলেই ইমরান খান টিকে থাকতে পারতেন। জানা গেছে, রাতে ভোটাভুটির আগে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন ইমরান খান। তার সঙ্গে পদত্যাগ করেন স্পিকার আসাদ কায়সার। এ সময় আসাদ কায়সার উল্লেখ করেন, প্রধানমন্ত্রীকে পদচ্যুত করতে তিনি বিদেশি ষড়যন্ত্রে অংশ নিতে পারবেন না। এরপর ভারপ্রাপ্ত স্পিকার আয়াজ সাদিকের সভাপতিত্বে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোটাভুটি হয়, যার ফলাফল নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিল আগেই। ভোটাভুটি শেষে বিরোধীদলীয় নেতা শাহবাজ শরিফ পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে বলেন, ‘পাকিস্তানে আজ নতুন ভোরের সূচনা হলো। আমরা পাকিস্তানকে নতুন করে গড়ে তুলব।’ উল্লেখ্য, ইমরান পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তার ক্ষমতাচ্যুতির মধ্য দিয়ে দেশটির নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারলেন না। ভোটে নির্বাচিত ইমরান ২০১৮ সালের আগস্টে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। পাকিস্তানে অনাস্থা ভোটে কারও প্রধানমন্ত্রিত্ব হারানোর এটাই প্রথম ঘটনা। আগে কয়েকজন প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হলেও তারা টিকে গিয়েছিলেন। এদিকে ভোটে ইমরান খানের পরাজয়ের পর শাহবাজ শরিফ জাতীয় পরিষদে দাঁড়িয়ে বলেন, বিরোধীদলীয় জোট সরকার গঠনের পর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিশোধপরায়ণ হবে না। তিনি বলেন, ‘অতীতের তিক্ততায় আমি ফিরে যেতে চাই না। যখন সময় আসবে, আমরা আরও বিস্তারিত বলব। আমরা এ জাতির ক্ষতের উপশম করতে চাই। নিরপরাধ মানুষকে আমরা কারাগারে পাঠাব না। আমরা প্রতিশোধ নেব না। আইন তার নিজের গতিতে চলবে, কোনো হস্তক্ষেপ সেখানে হবে না। আমি, বিলওয়াল (সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারির ছেলে, পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি বিলওয়াল ভুট্টো, বা মাওলানা ফজলুর রহমান (জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সভাপতি) কেউ হস্তক্ষেপ করবে না। আইনের শাসন বহাল হবে, আমরা বিচার বিভাগের প্রতি সম্মান দেখাব।’  শাহবাজ শরিফের পর বক্তব্য দিতে দাঁড়িয়ে পিপিপি নেতা বিলাওয়াল ভুট্টো বলেন, ‘আমি পুরো জাতি, এই পার্লামেন্টকে অভিনন্দন জানাতে চাই, দেশের ইতিহাসে এই প্রথম একটি অনাস্থা প্রস্তাব ভোটে পাস হয়েছে, আমরা ইতিহাস গড়েছি।’

ইমরান সরকারের পতনের প্রধান কারণ : প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঢেলে সাজানোর চেষ্টা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। কিন্তু চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির কথা জানান ইমরান। এর অংশ হিসেবেই তিনি বাণিজ্য চুক্তির জন্য রাশিয়া সফর করেন। কিন্তু সেই দিনই ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া, যা নিয়ে পশ্চিমারা ইমরান খানের ওপর দারুণ ক্ষুব্ধ ছিল। এ ঘটনার কয়েক দিন আগে থেকেই ইমরান খান বিরোধী দলের বিরুদ্ধে অভিযোগ করছিলেন, এরা ‘বিদেশি রাষ্ট্রের’ সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি আরও অভিযোগ করেছিলেন, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে আছে যুক্তরাষ্ট্র, কারণ তিনি রাশিয়া এবং চীনের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। এ জন্যই তাকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র চলছে। দ্বিতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের পরামর্শে সংসদ ভেঙে দিয়েছিলেন রাষ্ট্রপতি। এর আগে ইমরানের বিরুদ্ধে আনা অনাস্থা প্রস্তাব খারিজ করে দেন ডেপুটি স্পিকার। এসব বিষয়ে শুরু থেকেই ‘নিরপেক্ষ’ অবস্থানে দেখা যায় সেনাবাহিনীকে। বাহিনীটি কোনো পক্ষের হয়েই মতামত দেওয়া থেকে বিরত থাকে। অর্থাৎ তথাকথিত নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে। সেনাবাহিনীর এমন অবস্থানের কারণেই শক্ত অবস্থানে চলে যায় বিরোধী দলগুলো। সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থানের কারণে বিরোধীরা বুঝতে পারে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না ইমরান খান। এদিকে বৈদেশিক নীতি ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান নিয়োগ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের মতবিরোধ স্পষ্ট হয়। গত অক্টোবরে এ নিয়ে উত্তেজনা চূড়ান্ত রূপ নেয়। কারণ এ সময় ইমরান খান লেফটেন্যান্ট-জেনারেল ফয়েজ হামিদকে গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে বহাল রাখার চেষ্টা করেন। যা নিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিরোধ দেখা দেয়। যদিও পরে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়ার মনোনীত ব্যক্তিই নিয়োগ পায়।

পদত্যাগ করবেন পিটিআই আইনপ্রণেতারা : পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফের (পিটিআই) নেতা ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী ফাওয়াদ চৌধুরী  জানিয়েছেন, দেশটির জাতীয় পরিষদ (পার্লামেন্ট) থেকে দলের আইনপ্রণেতারা পদত্যাগ করবেন। পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার এক দিন পর গতকাল ফাওয়াদ চৌধুরী এ কথা জানান। খবরে বলা হয়, পিটিআই আইনপ্রণেতাদের পদত্যাগের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী পদে পাকিস্তান মুসলিম লীগ-এন সভাপতি শাহবাজ শরিফের মনোনয়ন গ্রহণের সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল। এই মনোনয়ন নিয়ে আপত্তি তুলেছে পিটিআই। যদিও পরে জাতীয় পরিষদের সচিবালয় পিটিআইর আপত্তি প্রত্যাখ্যান করে শাহবাজের মনোনয়নপত্র গ্রহণ করেছে।

ইসলামাবাদে সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপকালে ফাওয়াদ জানান, পিটিআইর কেন্দ্রীয় কোর নির্বাহী কমিটির বৈঠকে পুরো পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হয়েছে। ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘কোর নির্বাহী কমিটি পরামর্শ দিয়েছে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের শুরুতে পিটিআই সদস্যদের পদত্যাগ করার। শাহবাজ শরিফের মনোনয়নে আমাদের আপত্তি আমলে না নিলে আমরা সোমবার পদত্যাগ করব।’ তিনি জানান, অর্থ পাচার মামলায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ার পথে থাকা শাহবাজ প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন- এটি চরম অবিচার।

ফাওয়াদ চৌধুরী বলেন, ‘বিদেশিদের দ্বারা মনোনীত ও বিদেশের আমদানি করা সরকার এবং সেই সরকারের প্রধান হিসেবে শাহবাজের মতো মানুষ, পাকিস্তানের জন্য এর চেয়ে অপমানের আর কী হতে পারে?’

ইমরান খানের গ্রেফতার চাইলেন মরিয়াম নওয়াজ : সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান, স্পিকার আসাদ কায়সার ও সাবেক ডেপুটি স্পিকারকে গ্রেফতারের আদেশ জারি করতে সুপ্রিম কোর্টের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) ভাইস প্রেসিডেন্ট মরিয়াম নওয়াজ। একই সঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত ভঙ্গ করায় অবিলম্বে সুয়োমোটো নোটিস জারিরও আবেদন জানান মরিয়াম।

সরকারি কর্মকর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা : অনাপত্তিপত্র বা এনওসি ছাড়া পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। দেশত্যাগ বন্ধে ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এফআইএ) কর্মীদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। পাকিস্তানের পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এ নির্দেশনা এসেছে বলে জানিয়েছে দেশটির সংবাদমাধ্যম দ্য ডন। খবরে বলা হয়, শনিবার মধ্যরাতে পাকিস্তানের পার্লামেন্ট স্পিকার আসাদ কায়সারের পদত্যাগের ঘোষণা ও ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা ভোটের প্রক্রিয়া শুরুর সময় এই নির্দেশনা দেওয়া হয়। পাকিস্তানের সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এফআইএর অভিবাসন কর্মীদের সর্বোচ্চ পর্যায়ে সতর্ক রাখার পাশাপাশি এনওসি না নিয়ে দেশ ছাড়তে চাওয়া সরকারি কর্মকর্তাদের আটকে দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে নির্দেশনায়। একই সঙ্গে এয়ারপোর্ট সিকিউরিটি ফোর্সকে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রাখা হয়েছে এবং বিদেশগামীদের তল্লাশি বাড়ানো হয়েছে। এ ছাড়া সামরিক শহর রাওয়ালপিন্ডিতে নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর