বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বিদেশি ঋণ ঝুঁকিসীমার নিচে রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা লজ্জার

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিদেশি ঋণ ঝুঁকিসীমার নিচে রাখার নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ এখনো ঝুঁকিসীমার অনেক নিচে রয়েছে। ভবিষ্যতে ঋণের বর্তমান এ অবস্থান ধরে রাখতে সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

গতকাল সকালে গণভবনে ‘অফশোর ট্যাক্স অ্যামেস্টি’ এবং ‘শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের পটভূমিতে বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনীতির পর্যালোচনা’ বিষয়ে উপস্থাপনা প্রত্যক্ষ করার সময় প্রধানমন্ত্রী এই নির্দেশনা দেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইংয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ কথা জানানো হয়।

এ সময় শ্রীলঙ্কার চলমান সংকটের কারণ ও এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক পর্যালোচনা করে দেখা হয়। প্রায় সব সূচকেই বাংলাদেশের অর্থনীতি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল অবস্থায় আছে বলে মতপ্রকাশ করা হয়। তবে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি, খাদ্যপণ্য ইত্যাদি অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ‘আমদানিকৃত মুদ্রাস্ফীতি’ হিসেবে সৃষ্ট অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ রাখতে একটি সমন্বিত রাজস্বনীতি ও মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের ওপর জোর দেওয়া হয়। অর্থনীতির বিভিন্ন সূচক বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, মধ্য ও দীর্ঘ মেয়াদে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের বড় কোনো ঝুঁকির আশঙ্কা নেই।

বৈঠকে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল, প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদবিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই ইলাহী চৌধুরী, প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউসসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা লজ্জার : গতকাল সকালের সভার বিষয়ে বিকালে প্রেস ব্রিফিংয়ে বিস্তারিত জানান প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। তিনি বলেন, শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করা এর চেয়ে দুঃখজনক আর কিছু নেই। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশকে তুলনা করার চেয়ে লজ্জাজনক আর কিছু হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রী প্রতিটি পদক্ষেপ অনেক বিচার-বিশ্লেষণ করে নেন।  প্রেস ব্রিফিংকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ফজলে কবির, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন, আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ উপস্থিত ছিলেন।

আহমদ কায়কাউস বলেন, বাংলাদেশ শ্রীলঙ্কা হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। প্রধানমন্ত্রী নিজে প্রতিটি তথ্য-উপাত্ত ঘেঁটে নিশ্চিত হয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের অনেক অর্জন রয়েছে। আমরা উন্নয়নশীল দেশে এসেছি। মহামারির সময়েও আমাদের পাশ্ববর্তী দেশে ভারতের জিডিপি নেগেটিভ হয়েছে, সেখানে আমাদের জিডিপি ১২ দশমিক ৯৪ শতাংশ বেড়েছে। আমরা দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সবচেয়ে ভালো ফিগার ধরে রাখতে পেরেছি। সর্বোপরি আমাদের অর্থনীতি মজবুত হয়েছে। আমরা সংকটে পড়ার আগেই সংকটকে মোকাবিলা করতে পেরেছি অর্থনৈতিক-সামাজিক সব বিষয়ে। বিশ্বে মহামারির যে অবস্থা তৈরি হয়েছে, আমরা সেখান থেকে উত্তরণ ঘটাতে পেরেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের প্রসঙ্গ উল্লেখ করে মুখ্যসচিব বলেন, বাংলাদেশের অবস্থা কেমন আছে সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী বিস্তারিত তথ্য নিয়েছেন। তিনি সন্তুষ্ট হয়েছেন। তিনি বলেন, আমাদের ‘বৃহৎ প্রকল্পগুলো করলে বাংলাদেশ টিকতে পারবে কি না, সে প্রশ্নও ছিল। কিন্তু সেগুলোও আজ দৃশ্যমান। ডিজিটাল বাংলাদেশ নিয়ে ঠাট্টা-মশকরা করা হয়েছে। কিন্তু ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তবতা। আহমদ কায়কাউস বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দায়িত্ব গ্রহণ করেন, তখন আমাদের উন্নয়ন বাজেট ছিল ৬৮ হাজার কোটি টাকা। এখন আমাদের টোটাল বাজেট ৬ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা। অর্থ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব আবদুর রউফ তালুকদার বলেন, প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে গত ১৩ বছরে আমাদের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় আছে। এ কারণে সরকারের বিভিন্ন নীতি ও আর্থিক সুবিধা প্রদানের কারণে পোশাক রপ্তানি ও রেমিট্যান্স প্রবাহ এবং ধানের উৎপাদন বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। তিনি বলেন, কার্যকর নীতি প্রণয়নের ফলে করোনা অভিঘাত কাটিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতি অত্যন্ত দ্রুত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো করছে। গত অর্থবছরে আমাদের প্রবৃদ্ধি ছিল ৬ দশমিক ৯৬ এবং আগামী অর্থবছরে এটা ৭ দশমিক ২ এর ওপরে থাকবে বলে আমরা আশা করি। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বোচ্চ সংখ্যক ৬৮ দশমিক ১ শতাংশ টিকা বিনামূল্যে বাংলাদেশ প্রদান করেছে। করোনার পর কিন্তু আমাদের কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। এনবিআর রেভিনিউ গত ৬ বছরে গড়ে ১১ শতাংশ। এ বছর এটা ১৫ শতাংশের বেশি। প্রাইভেট সেক্টরে যে ক্রেডিট গ্রোথ সেটা ১১ শতাংশ। গত দুই বছরে এটা ছিল ৮-৯ ভাগ। এর ফলে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। অর্থ সচিব জানান, দক্ষিণ এশিয়ার চারটি বড় ইকোনমি ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা। এর মধ্যে ভারতের জিডিপি অবশ্যই বড়। কিন্তু শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের জিডিপির যোগফলের চেয়ে বাংলাদেশে জিডিপি বড়। বাংলাদেশ যে রপ্তানি করে তা শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের রপ্তানির যোগফলের বেশি। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কার রিজার্ভের যোগফলের দ্বিগুণ।

ফলে যারা শ্রীলঙ্কার সঙ্গে বাংলাদেশের তুলনা করেন, তারা বাংলাদেশকে হেয় করতে চায়। কারণ কোনোভাবেই এটা তুলনা করা যাবে না। আমাদের যে বৈদেশিক ঋণ আছে সেটা জিডিপির মাত্র ১২ শতাংশ। এটা শ্রীলঙ্কার প্রায় ৪৮ শতাংশ। শ্রীলঙ্কার ঋণের সুদের হার গড়ে ৭ দশমিক ৫ শতাংশ আর আমাদের ঋণের সুদের হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ। তিনি বলেন, একটা দেশ তখনই দেউলিয়া হয় যখন সে তার ঋণ শোধ করতে পারে না। আমাদের যে ঋণ আছে আগামী ৫-১০ বছর যদি ধরি তাহলেও ঋণ পরিশোধের কোনো সমস্যা নেই।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান ও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিম বলেন, আমরা যেটা করছি সেটা ঠিক কর ছাড় নয়, এটাকে সমন্বয় বলা যেতে পারে। যেখানে করভার বেশি আছে, সেটা সমন্বয় করি। এটা করে আমরা সব জায়গায় ইতিবাচক ফল পেয়েছি। আমরা অন্ধের মতো কর হার কমাইনি। করের ছাড় দিলেও আমাদের সার্বিক রাজস্ব বেড়ে গেছে। এ জন্য আমাদের গ্রোথ রেট বেড়েছে। রাজস্ব ছাড়ের জন্য অর্থনীতিতে যে ইতিবাচক ফলাফল এসেছে তার চিত্র তুলে ধরেন তিনি। 

অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের সচিব ফাতিমা ইয়াসমিন বলেন, আমরা ঋণের ব্যবহারে অত্যন্ত সচেতন। ঋণের মাত্রাও নমনীয়। শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনায় বলা যায়, ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশ কোনো ঝুঁকিতে নেই।

আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের সচিব শেখ মোহাম্মদ সলীম উল্লাহ বলেন, অপ্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করা হবে না। সেই বিষয়ে সরকার ও সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো সতর্ক রয়েছে।

 

সর্বশেষ খবর