বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ঘুরে-ফিরে ওরা একই পেশায়

আলী আজম

রাজধানীর পল্লবী এলাকা থেকে মণি ইসলাম, তার ননদ জান্নাতুল ফেরদৌস রুপা এবং তাদের ড্রাইভার মো. শাহাদাত হোসেনকে ৭১ হাজার পিস ইয়াবাসহ আটক করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর (ডিএনসি)। গত ২ ডিসেম্বর পল্লবীর ১১ নম্বর সেকশন থেকে ইয়াবা ছাড়াও তাদের কাছ থেকে দুটি প্রাইভেটকার জব্দ করা হয়। ডিএনসি বলছে, তারা পেশাদার মাদক ব্যবসায়ী। দীর্ঘদিন ধরে পারিবারিকভাবে এ ব্যবসা করছে। এই চক্রের প্রধান রাজু মোল্লা ওরফে সুজন। রাজুর অবর্তমানে স্ত্রী মনি ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। রাজুর ভাই রুবেলও এই ব্যবসার অন্যতম হোতা। রাজুর বিরুদ্ধে মাদক ও অস্ত্র আইনে চারটি মামলা রয়েছে। এ ছাড়া রাজুর স্ত্রী মনির বিরুদ্ধে মাদক আইনে ছয়টি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ৩১ হাজার ৫০০ ইয়াবা রাখার অভিযোগে মনি ও তার স্বামী রাজুর বিরুদ্ধে ২০১৯ সালের ১৬ ডিসেম্বর শাহআলী থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করা হয়। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর গত ২৬ নভেম্বর জামিনে মুক্তি পায় মনি। রাজু ও তার ভাই রুবেল মাদক মামলায় বর্তমানে জেলে রয়েছেন। তাদের অনুপস্থিতিতে রাজুর স্ত্রী মনি ও রাজুর বোন রুপা ইয়াবা ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছিল। তাদের নিজস্ব দুটি প্রাইভেটকারে ইয়াবা বিক্রি করত। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানীতে তাদের বাড়ি হলেও পল্লবীতে নিজস্ব ফ্ল্যাট রয়েছে। এদিকে সোমবার রাজধানীর উত্তর বাড্ডা থেকে ৫০ কেজি গাঁজা ও প্রাইভেটকারসহ তিনজন মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) গুলশান বিভাগ। তারা হলেন- মো. ফারুক হোসেন, মো. সুমন ও মো. জয়নাল হোসেন। তারা ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে প্রাইভেটকারে গাঁজা ঢাকায় নিয়ে আসত। ডিবি বলছে, গ্রেফতার ফারুক হোসেন দুই মাস আগে পল্টন থানায় মাদকসহ ধরা পড়েছিল। ওই মামলায় জেলে যায়। এক সপ্তাহ আগে জামিনে বেরিয়ে এসে আবার মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ে। গ্রেফতার তিনজনের বিরুদ্ধে মাদক আইনে বাড্ডা থানায় মামলা করা হয়েছে। ডিএনসি সূত্রে জানা গেছে, গত ২০ বছরে ৪৬ হাজার ৯০৭টি মামলা নিষ্পত্তি হয়। এসব মামলায় আসামি ছিলেন ৫০ হাজার ৫৯৯ জন। এর মধ্যে খালাস পেয়েছেন ২৬ হাজার ১৩৮ জন। অর্থাৎ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা যাদের বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্টতা পায় তাদের ৫২ দশমিক ২৩ শতাংশ খালাস পেয়েছেন। সবশেষ ২০২০ সালে খালাস পান ৫৭ দশমিক ৯৫ শতাংশ আসামি। গত পাঁচ বছরের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মাদকের মামলায় আসামি খালাসের হার ৫৫ থেকে ৬১ শতাংশ। খালাসের কারণ হিসেবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ত্রুটিপূর্ণ এজাহার ও অভিযোগপত্র, বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপন করতে না পারা এবং জব্দতালিকা সঠিকভাবে না করায় আসামিরা সুবিধা পেয়েছেন। জব্দতালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষী এবং বাদী ও অভিযানকারীদের বক্তব্যে অমিল থাকায় অপরাধ প্রমাণ করা যায়নি। আবার অনেক কর্মকর্তা মাদক উদ্ধারে মনোযোগী হলেও তদন্তে কম আগ্রহ দেখিয়েছেন। ফলে আদালতে দায়সারা অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মাদক মামলা সঠিকভাবে তদন্ত করা হয় না। চার্জশিট শক্তভাবে জমা না দেওয়া, যথেষ্ট পরিমাণ সাক্ষী প্রমাণের অভাব ও সাক্ষীকে আদালতে হাজির করতে না পারায় বিচার কাজে দীর্ঘসূত্রতা তৈরি হয়। মাদক মামলার নিষ্পত্তিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন সাক্ষী। অনেক সাক্ষীই আদালতে সাক্ষ্য দিতে রাজি হন না। অনেক মামলার সাধারণ সাক্ষীও খুঁজে পাওয়া যায় না। আসামিরা প্রভাবশালী হওয়াতেও সাক্ষ্য দিতে ভয় পায়। তাই সাক্ষীর অনুপস্থিতিতে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা অবসরে গেলে আর সাক্ষী দিতে রাজি হয় না। কেউ কেউ চাকরি থেকে বদলি হয়ে গেলে অন্য জেলা থেকে এসে সাক্ষী দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।

ত্রুটিপূর্ণ এজাহার ও বিশ্বাসযোগ্য সাক্ষী উপস্থাপনে ব্যর্থতাসহ আট কারণে মাদক মামলার আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন। গত এক দশকে নিষ্পন্ন হওয়া মামলা পর্যালোচনা শেষে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর এই কারণগুলো চিহ্নিত করেছে। অন্য কারণগুলো হলো- মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া, আইনের বিধান অনুযায়ী জব্দ তালিকা তৈরি না করা, জব্দ তালিকার সাক্ষীদের সঙ্গে রাষ্ট্রপক্ষের সাক্ষীদের বক্তব্যে অমিল, বাদী ও অভিযানকারী দলের সদস্যদের বক্তব্যে অমিল, আদালতে সাক্ষী হাজিরে ব্যর্থতা এবং অনেক ক্ষেত্রে মামলার বাদী ও তদন্ত কর্মকর্তাও সাক্ষ্য দিতে আসেন না। এ ছাড়া গ্রেফতারের কাগুজে সময়ের চেয়ে আসল সময়ের অমিলের কারণে আসামিপক্ষ সুবিধা পেয়ে থাকে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, মাদক ব্যবসার সঙ্গে সম্পৃক্তরা নিত্যনতুন কৌশলে তাদের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ব্যক্তি পুরো পরিবারের সবাইকে নিয়ে মাদক ব্যবসায় জড়িয়ে পড়ছে। তারা মাদক বহন করছে, বিক্রি করছে এমনকি বিভিন্ন দেশ থেকে আধুনিক মাদক নিয়ে আসছে। আমাদের দেশের আইনে মাদক যারা বহন করে এদের গ্রেফতার করা কিংবা জেলে পাঠানো হয়। সে ক্ষেত্রে আইনের কঠোর নির্দেশনা এখনো পর্যন্ত অনুপস্থিত। যে কারণে তারা অল্প সময়ের মধ্যে কোনো না কোনোভাবে জামিনে বেরিয়ে যাচ্ছে। পরে আবার মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। যারা মাদক বহন, বিক্রি বা বাণিজ্য করছে এদেরকে কঠোর ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। গ্রেফতাররা যদি কোনো না কোনোভাবে জামিনে বেরিয়ে আসে, তবে তারা ফের পুরনো পেশায় পুরোদমে ফিরে যাচ্ছে। পথঘাট ও আইনি প্রক্রিয়া বুঝতে পারায় আগের চেয়ে আরও গতি বাড়িয়ে দিয়ে মাদক ব্যবসা করছে। যারা মাদক কারবারে জড়িত তাদের সামাজিকভাবে বয়কট করতে হবে। যারা মাদক ব্যবসা করে তারা ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে চলে। তাদের কাছে অস্ত্র ও নিজস্ব লোকবল রয়েছে। ফলে সামাজিকভাবে বয়কটের পাশাপাশি আইনিভাবে দ্রুত ও কার্যকরীভাবে দমন করতে হবে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর