বুধবার, ১৩ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রোজার রুহানিয়াত হারায় যেসব কাজে

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

রোজার রুহানিয়াত হারায় যেসব কাজে

এমন কিছু কাজ আছে যাতে সরাসরি রোজা ভাঙে না কিন্তু রোজার রুহানিয়াত চলে যায়, শরিয়তের পরিভাষায় এসব কাজকে মাকরুহ বলা হয়। রোজা অবস্থায় কুলি করার সময় গড়গড়া করা এবং নাকের নরম অংশ পর্যন্ত পানি পৌঁছানো মাকরুহ। লাকিত ইবনে সবিরা (রা.) থেকে বর্ণিত, রসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন,  ‘অজু-গোসলের সময় ভালোভাবে নাকে পানি দাও, তবে রোজাদার     হলে এমনটি কোরো না।’ (তিরমিজি।) ফকিহরা বলেন, এমন কাজ করা মাকরুহ যার ফলে রোজাদার নিতান্তই দুর্বল হয়ে পড়ে। যেমন শিঙ্গা লাগানো, অনর্থক অধিক পরিশ্রম করা ইত্যাদি। একইভাবে রোজা অবস্থায় শরীর থেকে রক্ত বের হলে বা ইনজেকশন ইত্যাদির মাধ্যমে রক্ত বের করলে রোজা ভাঙবে না। তবে ইচ্ছাকৃতভাবে এ পরিমাণ রক্ত বের করা মাকরুহ, যার ফলে রোজাদার খুব দুর্বল হয়ে যায়। (মুহিতুল বুরহানি, ফাতাওয়ায়ে হিন্দিয়া) তাবেয়ি সাবেত আলবুনানি (রহ.) বলেন, ‘আনাস (রা.)-কে জিজ্ঞেস করা হলো রোজা রেখে শিঙ্গা লাগানোকে আপনারা কি মাকরুহ মনে করতেন? তিনি বলেন, ‘না। তবে এ কারণে দুর্বল হয়ে পড়লে তা মাকরুহ হবে।’ (বুখারি) রোজা রেখে গিবত করলে, গালিগালাজ করলে, অশ্লীল সিনেমা-থিয়েটার ইত্যাদি দেখলে, গানবাদ্য শুনলে এবং যে কোনো কবিরা গুনাহে লিপ্ত হলে রোজা মাকরুহ হয়ে যায়। আর এ কাজগুলো যে সর্বাবস্থায় হারাম তা তো বলাই বাহুল্য। ‘তোমাদের কেউ যখন রোজা রাখে তখন সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং শোরগোল, হট্টগোলে লিপ্ত না হয়।’ (বুখারি) আবু দাউদের বর্ণনায় এসেছে, ‘রোজাদার যেন কোনো অন্যায়-অপরাধে লিপ্ত না হয়।’ হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন, নবী (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মিথ্যা-প্রতারণা ও গুনাহের কাজ ত্যাগ করে না আল্লাহর কাছে তার পানাহার থেকে বিরত থাকার কোনো মূল্য নেই।’ (বুখারি) হজরত সুফিয়ান সওরি (রহ.)-এর অভিমত ছিল গিবতের কারণে রোজা নষ্ট হয়ে যায়। তেমনি ইমাম গাজ্জালি (রহ.) তাঁর অমর গ্রন্থ এহইয়াউল উলুমে প্রসিদ্ধ তাবেয়ি হজরত মুজাহিদ ও ইবনে শিরিনের উক্তি উদ্ধৃত করেছেন, গিবত রোজা নষ্ট হওয়ার কারণ। এসব মনীষী প্রথমত হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণিত হাদিস দলিল হিসেবে উল্লেখ করেন। দ্বিতীয়ত, তাঁরা যুক্তি দেন- পানাহার মৌলিকভাবে হালাল। অথচ রোজার কারণে তা নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু মিথ্যাচার, গিবত প্রভৃতি কখনো বৈধ নয়। রোজায় এসবের কদর্যতা আরও বেড়ে যায়। রোজা রেখে এগুলোয় লিপ্ত হওয়া আরও গুরুতর অন্যায়। সুতরাং মৌলিকভাবে হালাল ও বৈধ পানাহার যদি রোজা নষ্টের কারণ হয় তা হলে যেসব কাজ কোনো অবস্থাতেই বৈধ নয়, তাতে লিপ্ত হওয়ার কারণে রোজা নষ্ট হওয়া খুবই যুক্তিসংগত। অন্যান্য মনীষী এ যুক্তির গুরুত্ব স্বীকার করলেও আইনের ক্ষেত্রে সাবধানী মন্তব্য করার মূলনীতি অনুসারে বলতে চান, অন্যায় কর্ম ও পাপাচারের কারণে সিয়াম সাধনার সুফল কমে যায়। এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু রোজা নষ্ট হয়ে যাওয়ার রায় দেওয়া সমীচীন হবে না। মাওলানা আশরাফ আলী থানভি (রহ.) এ ব্যাপারে একটি দার্শনিক ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেন, রোজার একটি কাঠামোগত স্বরূপ রয়েছে। তেমনি রয়েছে একটি উদ্দেশ্যগত স্বরূপ। সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার ও কামাচার বর্জন রোজার কাঠামোগত স্বরূপ। সেমতে রোজায় পানাহার যদিও লঘু অন্যায়; কিন্তু তা কাঠামোগত স্বরূপের পরিপন্থি। আর পাপাচার যদিও গুরুতর অন্যায়; কিন্তু তা রোজার কাঠামোগত স্বরূপের পরিপন্থি নয়। রোজার উদ্দেশ্যগত স্বরূপ হলো পানাহারের পাশাপাশি পাপাচার বর্জন। সুতরাং গুনাহের কাজ রোজার উদ্দেশ্যগত স্বরূপের বিরোধী। তাই অন্যায় কাজ ও আচরণের কারণে রোজার উল্লেখযোগ্য সুফল তথা তাকওয়া অর্জন এবং বিশাল ফজিলত থেকে রোজাদারকে বঞ্চিত থাকতে হবে। এদের উদ্দেশ করেই রসুল (সা.) বলেছেন, ‘অনেক রোজাদার আছে না খেয়ে থাকার কষ্ট ছাড়া কিছুই অর্জন করে না।’ (বুখারি)

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি

সর্বশেষ খবর