বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

থমকে আছে রমনা বটমূলে হামলার দুই মামলার বিচার

আরাফাত মুন্না

২১ বছর আগে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা পার্কের বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছিল জঙ্গিরা। ঘটনাস্থলেই মারা যান নয়জন। হাসপাতালে আরও একজন। নির্মম এ ঘটনায় হত্যা ও বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা দুটি মামলাই থমকে আছে। হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স নিষ্পত্তির অপেক্ষায় সাত বছর ধরে ঝুলছে হাই কোর্টে। আর বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটি এখনো নিম্ন আদালতে ঝুলছে। দীর্ঘ এ ২১ বছরেও মামলা দুটির বিচার শেষ না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী অনেকে।

এ দুই মামলা কবে নিষ্পত্তি হবে এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বিচারাধীন কোনো মামলার বিষয়ে আমি মন্তব্য করব না। তবে মামলা দুটি দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা গ্রহণে রাষ্ট্রপক্ষকে বলব।’

সুপ্রিম কোর্ট সূত্র জানান, ২০১৪ সালে হত্যা মামলাটি বিচারিক আদালতের রায়ের পর ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাই কোর্টে আসে। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে এ মামলার পেপারবুকও (রায়সহ যাবতীয় নথি সংবলিত বই) তৈরি করা করা হয়। কয়েক দফা আদালতও পরিবর্তন হয়েছে। এর পর থেকে এ মামলার কার্যক্রম আর এগোয়নি। সর্বশেষ বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের এখতিয়ার পরিবর্তন হলে কার্যতালিকা থেকে বাদ দেওয়া হয় মামলাটি। এ মামলার বিষয়ে জানতে চাইলে অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পেপারবুর প্রস্তুত হওয়ার পর করোনার কারণে দুই বছর শুনানি করা সম্ভব হয়নি। এর মধ্যে কয়েক দফা বেঞ্চ পরিবর্তনও হয়েছে। ঈদের ছুটির পর আমরা মামলাটি শুনানির জন্য বেঞ্চ নির্ধারণে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করব।’ রায়ে সর্বোচ্চ সাজাপ্রাপ্ত আসামিদের দণ্ড বহাল থাকবে বলেও আশা প্রকাশ করেন তিনি।

আদালতসূত্রে জানা গেছে, বিস্ফোরক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলাটির বিচার চলছে ঢাকার ১ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে। মামলার মোট ৮৪ সাক্ষীর ৫৪ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়েছে। মামলাটি এখন যুক্তিতর্ক পর্যায়ে রয়েছে। ১০ এপ্রিলও এ মামলায় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু আসামিপক্ষ সময় আবেদন করলে ২০ এপ্রিল নতুন দিন ঠিক করেন বিচারক।

জানতে চাইলে এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আবু আবদুল্লাহ ভূঁইয়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘করোনার কারণে কিছুটা বিলম্ব হয়েছে। বর্তমানে মামলাটি যুক্তিতর্ক উপস্থাপন পর্যায়ে রয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুতই মামলাটির বিচারিক কার্যক্রম সমাপ্ত হয়ে রায়ের পর্যায়ে আসবে।’ দীর্ঘদিনেও বিচার শেষ না হওয়ায় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মোতাহার হোসেন সাজু আক্ষেপ করে বলেন, ‘চোখের সামনে মানুষ মারা গেল, রক্তে ভিজে গেল আমার গায়ের পোশাক, সেই ঘটনার বিচার আজও দেখতে পারলাম না, এটাই আফসোস!’

মামলার বিবরণ থেকে জানা যায়, পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠান ‘ইসলামবিরোধী’ বিবেচনা করে ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনা বটমূলে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানে বোমা হামলা চালানো হয়। হামলায় ঘটনাস্থলেই নয়জনের মৃত্যু হয়। পরে হাসপাতালে মারা যান একজন। এ ঘটনায় নীলক্ষেত পুলিশ ফাঁড়ির সার্জেন্ট অমল চন্দ্র ওই দিনই রমনা থানায় হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি মামলা করেন। ঘটনার প্রায় আট বছর পর ১৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। আলোচিত এ মামলায় তদন্ত কর্মকর্তা বারবার পরিবর্তন, সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল, বারবার তাগিদ দেওয়া সত্ত্বেও তদন্ত কর্মকর্তাদের আদালতে সাক্ষ্য দিতে না আসার কারণে বিচার শুরু হতে দেরি হয়। পর্যায়ক্রমে থানা, ডিবি ও সিআইডি পুলিশে মামলার তদন্ত যায়। মামলার অষ্টম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির পরিদর্শক আবু হেনা মো. ইউসুফ ২০০৮ সালের ৩০ নভেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। দুটি মামলারই অভিযোগপত্র একসঙ্গে দাখিল করা হয়। পরে বিচারের জন্য মামলা দুটি ২০০৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতে যায়। ওই আদালতে একই বছরের ১৬ এপ্রিল পৃথক মামলা দুটিতে আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মনিটরিং সেলের সিদ্ধান্তে হত্যা মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-৩ ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলাটি দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১-এ পাঠানো হয়। বিচার শেষে ২০১৪ সালের ২৩ জুন ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালত হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করে। রায়ে মুফতি আবদুল হান্নানসহ আটজনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয় ছয় আসামিকে। মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত প্রত্যেককে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ডও দিয়েছে আদালত। এ মামলায় ১৪ আসামির চারজন শুরু থেকেই পলাতক। এরপর ডেথ রেফারেন্স এবং আসামিদের জেল আপিল ও ফৌজদারি আপিলের শুনানির জন্য মামলাটি হাই কোর্টে আসে।

সর্বশেষ খবর