শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান বাংলাদেশের

প্রতিক্রিয়া স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর

নিজস্ব প্রতিবেদক

২০২১ সালে বাংলাদেশে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর প্রকাশিত বার্ষিক প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছে বাংলাদেশ। সরকারের দায়িত্বশীলরা বলছেন, রিপোর্টে অতীতের ধারাবাহিকতায় ঢালাওভাবে গৎবাঁধা অভিযোগ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রচুর তথ্যবিভ্রাট রয়েছে। সরকারবিরাধী প্রপাগান্ডা মেশিন থেকে তথ্য নিয়ে প্রতিবেদনটি প্রস্তুত করা হয়েছে। বিষয়টি নিয়ে গতকাল তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান ও পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন নিয়ে শিগগিরই আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিক্রিয়া জানাবেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের কাছে বিষয়গুলো জানতে চাইবেন। বিশ্বের ১৯০টি দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে গত মঙ্গলবার ‘২০২১ : কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্যাকটিসেস’ শীর্ষক বার্ষিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতর। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে দেশটি। নিরাপত্তা বাহিনী ক্ষমতার অপব্যবহার ও দুর্নীতিতে জড়িত বলে দাবি করা হয়েছে রিপোর্টে। বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিপীড়ন ও দুর্নীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও ব্যাপকভাবে দায়মুক্তি ভোগ করে আসছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশে সমকামীদের অধিকার নেই ও রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলেও বাংলাদেশকে দোষারোপ করা হয়।

নিরাপত্তা বাহিনী নিয়ে মার্কিন প্রতিবেদনে তথ্যবিভ্রাট : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

নিরাপত্তা বাহিনীর ক্ষমতার অপব্যবহার নিয়ে মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে সেখানে তথ্যবিভ্রাট হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। তিনি বলেন, প্রথম কথা হলো এই অভিযোগটা বোধহয় ২০২১ এর, ২০২২ এর নয়। ২০২১-এ যে পরিমাণ গুম-খুনের কথা এখানে বলা হচ্ছে আমাদের রেকর্ডে কিন্তু সে পরিমাণ নেই। যখন থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের দায়িত্ব নিয়েছেন, তখন থেকে কোনো ধরনের অন্যায়-অত্যাচার নিরাপত্তা বাহিনী করলে তাকে কিন্তু আইনের মুখোমুখি আনা হচ্ছে। আমি সেটাই বারবার স্পষ্ট করে বলছি। গতকাল সচিবালয়ে নিজ দফতরে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা সব সময়ই আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা যদি কেউ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন, নিরাপত্তা বাহিনী আত্মরক্ষায় যদি গুলিও করেন তাহলে প্রত্যেক ঘটনায় একজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট তদন্ত করেন। এতে যদি ঘটনার সত্যতা প্রমাণ হয় তাহলেই সেই বিষয়টি আমরা ক্লোজ করে দেই। যদি নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মনে করেন এখানে ঘটনাটি অন্যায় বা অসতর্কতায় হয়েছে, সেটা আমরা বিচার বিভাগে পাঠিয়ে দেই। তিনি বলেন, আপনারা নিশ্চই জানেন, জেলখানায় আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীর যথেষ্ট পরিমাণ, ইন্সপেক্টর লেভেল থেকে ডিআইজি লেভেল পর্যন্ত কর্মকর্তা রয়েছেন। এটাই শুধু নয়, র‌্যাবেরও অনেক  স্য রয়েছেন। এর অর্থ কেউই বিচারের ঊর্ধ্বে নয়। এখানে যিনি অন্যায় করবেন তাকেই বিচারের মুখোমুখি হতে হয়। তারা (যুক্তরাষ্ট্র) যেটা করেছে, তাদের তথ্যবিভ্রাট হয়েছে বলে আমি মনে করি।

নিরাপত্তা বাহিনী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার হচ্ছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, এ বিষয়ে জানতে চাইলে মন্ত্রী বলেন, এটা হতো তখন যখন বিএনপি ক্ষমতায় ছিল। পেছনের কথা যদি তারা বলে, এটা আমার জানা নেই। তিনি আরও বলেন, গুম-খুনের কথা যেগুলো বলছেন, এগুলো প্রায়ই অনুসন্ধান করে আমরা দেখেছি, তারা অনেকেই হয়তো আত্মগোপন করে গুম বলে চালিয়ে দিয়েছেন। হয়তো ব্যবসায় লোকসান করে নিজেই কোথাও চলে গেছেন। এই কিছুদিন আগেও আপনারা দেখেছেন, এক লোক আড়াই বছর পর বলেছেন ইচ্ছে করেই গুম হয়েছিলেন পরিবারের অশান্তির কারণে। আমাদের নিরাপত্তা বাহিনী অনেককেই খুঁজে বের করে দিয়েছে। আমি এখনো জোর গলায় বলতে পারি, যে প্রতিবেদনটা বের হয়েছে তাতে তথ্যের গরমিল রয়েছে। বিচার বিভাগ ব্যবহার করে রাজনৈতিক হয়রানি প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বিচারবিভাগ যখন যে নির্দেশনা দিচ্ছে সব জায়গায় সেটি পালন হচ্ছে। বিচার বিভাগ স্বাধীন, হয়রানি হবে কীভাবে।

রিপোর্ট গতবাঁধা, সরকারবিরাধী প্রপাগান্ডা মেশিন থেকে তথ্য নেওয়া হয়েছে : পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের মানবাধিকার রিপোর্টকে অতীতের মতো ধারাবাহিক গৎবাঁধা বলে উল্লেখ করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। সেই সঙ্গে রিপোর্টে সরকারবিরোধী প্রপাগান্ডা মেশিন থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তিনি। এমনকি রিপোর্টে মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে বলেও মন্তব্য করেছেন প্রতিমন্ত্রী। গতকাল বিকালে নিজ দফতরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব অভিযোগ করেন।

পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বলেন, রিপোর্ট মাত্র প্রকাশিত হয়েছে। মার্কিন প্রশাসনের বছরব্যাপী তৈরি করেছে এবং অনেক রিসোর্স ব্যয় হয়েছে। তাৎক্ষণিকভাবেই এর প্রতিক্রিয়া দেওয়া সম্ভব নয়।

পররাষ্ট্র দফতর এটার বিশ্লেষণের কাজটা করতে শুরু করেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এর জবাব দেওয়া হবে। প্রথমত আমরা আগামী রবিবার একটা প্রতিক্রিয়া জানাব এবং পরবর্তীতে অবশ্যই মার্কিন সরকারের সঙ্গে আমাদের সিরিজ বৈঠকে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি শুধু এই রিপোর্ট নিয়েও আলাপ করব এবং প্রতিটি বিষয়ে তাদের কাছ থেকে জানতে চাইব এবং আমাদের অবস্থান কোথায় কী আছে তাদেরকে জানাব।

তিনি বলেন, মোটাদাগে বলতে গেলে, মানবাধিকার বলতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ যে দু-তিনটা এলিমেন্ট আলোচনায় আসে, শুধু সেটা নয় এর বাইরেও শিশুদের সঙ্গে আচরণ কী রকম হচ্ছে, এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কীভাবে দেখা হচ্ছে, এমন সব বিষয়ই অন্তর্ভুক্ত আছে। খুবই দুঃখের এবং পরিতাপের বিষয় হলো যে, অতীতের ধারাবাহিকতায় গতবাঁধা বিষয় রিপোর্টে আছে। বাংলাদেশের সরকারবিরোধী যেসব প্রপাগান্ডা মেশিন আছে সেগুলো থেকে ইনফরমেশন নেওয়া হয়েছে। প্রতিমন্ত্রী বলেন, তাসনিম খলিল নামে সুইডেনে আশ্রিত একজনের বিরুদ্ধে আরেকজন বাংলাদেশি সুইডেনের নাগরিক মামলা করেছেন। সেই মামলাটির দায়ভার বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপানোর চেষ্টা করা হয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, রোহিঙ্গা নিয়ে সরকার কতটা আন্তরিক কতটা মানবিক পৃথিবীর সবাই তা জানে, কেউ যদি আমাদেরকে মানবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তখন আমার মনে হয় তাদের নৈতিক স্খলন হয়েছে। রিপোর্টে তা করা হয়েছে আমি বলছি না। আমরা রিফিউজিদের-কে রিফিউজি না ডাকলেও তাদেরকে আমরা যথেষ্ট সুযোগ-সুবিধা দেই। কিন্তু এখানে বলা হয়েছে, আমরা নাকি ব্যাখ্যা দিয়ে বলি যে আমরা এ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর না করায় কোনো দায় দায়িত্ব নেই না। এটা পুরোপুরি মিথ্যা। তিনি বলেন, ১০/১২ জন রোহিঙ্গা ভাসানচর থেকে পালানোর সময় নৌকা ডুবি হয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে। এটাও কি আমাদের দোষ? আমাদের ঘাড়ে এ দোষ চাপানো হয়েছে।

দ্বিতীয় বিষয় হলো, এই রিপোর্টে আমরা কেন বাংলাদেশে একজন ছেলে ছেলেকে বিয়ে করতে পারবে না বা একজন ছেলে ছেলের সঙ্গে কেন তার দৈহিক চাহিদা মেটাতে পারবে না বা একজন মেয়ে কেন আরেকজন মেয়ের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে না সেই প্রশ্নও তোলা হয়েছে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা আমাদের ইসলাম ধর্মের পরিপন্থী। পৃথিবীর এমন একটা মুসলিম দেশ দেখান যারা এলজিবিটিকে অনুমোদন দেয়। যত দেশ বা সংস্থা থেকে চাপ আসুক না কেন এলজিবিটি প্রশ্নে কোনো ছাড় দেবে না বাংলাদেশ। এটা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে বিরোধিতা করা হবে, ধর্মের সঙ্গে বিরোধিতা করা হবে।

প্রতিমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার মামলার ইতিহাসও এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। তাকে রাজনৈতিক বন্দি বলা হয়েছে। তিনি তো রাজনৈতিক বন্দি নন। আমরা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে যতবার এ নিয়ে কথা বলেছি, সেখানে আমরা সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছি। তাকে মানবিক কারণে জেল থেকে মুক্তি দিয়ে বাসায় থাকতে দেওয়া হয়েছে। তার বিদেশে যাওয়ার প্রশ্নটাও অমূলক ছিল।

র‌্যাবকে দায়মুক্তির বিষয়ে প্রতিমন্ত্রী বলেন, এটা মোটেই সত্য নয়। পরিষ্কারভাবেই গত তিন বছরে কতজন পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে তা প্রকাশ্যে জানানো হয়েছে। পৃথিবী সব দেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী চ্যালেঞ্জের মধ্যে দিয়ে দায়িত্ব পালন করে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গতকালকেও নিজেদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বে মানুষ মারা গেছে, প্রতিনিয়ত মারা যাচ্ছে। সেখানে আমাদের র‌্যাব, পুলিশ ফোর্স জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যখন কাজ করতে যাবে, তখন যদি গুলি চালাচালিতে কেউ মারা যান, কালকে সেটাও আমাদের ওপরে চাপিয়ে দেওয়া হবে। এই অবস্থান থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

সর্বশেষ খবর