শনিবার, ১৬ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

নবীজির (সা.) বিজ্ঞানময় ইফতার

মাওলানা সেলিম হোসাইন আজাদী

নবীজির (সা.) বিজ্ঞানময় ইফতার

পৃথিবীতে রোজাদারদের মতো সৌভাগ্যবান আর কেউ নেই। বিশেষ করে গ্রীষ্মে যারা রোজা রাখেন তারা শীতে রোজা পালনকারীদের চেয়েও বেশি খোশনসিব। এক হাদিসে রসুল (সা.) বলেছেন, ‘প্রচণ্ড গরমে যিনি রোজা রাখেন আল্লাহ তার জন্য একজন ফেরেশতা নিয়োগ করে দেন। ফেরেশতা রোজাদারের জন্য আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করতে থাকেন। ইফতার শেষে আল্লাহতায়ালা ফেরেশতাদের ডেকে বলেন, তোমরা সাক্ষী থাকো, আমার বান্দা আমাকে ভয় করে রোজা ভাঙেনি, আমি তার জীবনের সব গোনাহ মাফ করে দিয়েছি।’ (এহইয়াউল উলুমুদ্দিন।) সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারে শরবত মুখে দেওয়ার আনন্দ পৃথিবীর যে কোনো আনন্দকে ম্লান করে দেয়। ইফতারের আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। প্রতিটি রোজাদারই জানেন, ইফতারের অপেক্ষা কি মধুর অপেক্ষা। আরবি ভাষায় একটি প্রবাদ আছে, অপেক্ষার চেয়ে মৃত্যু ভালো। এখানে এসে বোধহয় প্রবাদটি মিথ্যা হয়ে যায়। কোনো রোজাদারই ইফতারের জন্য অপেক্ষা করার আনন্দ থেকে নিজেকে বাদ রাখতে চাইবেন না। কারণ ইফতারের অপেক্ষায় থাকা ইফতারের মতোই আনন্দঘন পরিবেশ তৈরি করে। হাদিস শরিফে রসুল (সা.) বলেছেন, রোজাদারের জন্য দুটি আনন্দ আছে। একটি দুনিয়ায়। অন্যটি আখেরাতে। দুনিয়ার আনন্দ হলো ইফতারের আনন্দ। আখেরাতের আনন্দ হলো দিদারে ইলাহি তথা প্রেমময় প্রভুর প্রেম দর্শনের আনন্দ। (বুখারি।) রসুল (সা.) ইফতারের ফজিলত বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছেন, ইফতার যেমন রোজাদারের জন্য আনন্দময় ও সওয়াবে ভরপুর নেয়ামত, একইভাবে ইফতারের জন্য অপেক্ষার সময়টুকুও রোজাদারের আমলনামায় অফুরন্ত সওয়াব লেখেন ফেরেশতারা। শুধু তাই নয়, নবীজি (সা.) বলেছেন, ইফতারের সময় এতই মূল্যবান, এ সময় বান্দা আল্লাহর কাছে যা চাইবেন, তাই কবুল করবেন। নবীজি আরও বলেন, হে আমার উম্মত! তোমরা ইফতারের সময় বেশি বেশি দোয়া করো। ইফতারের মুহূর্তের দোয়া কখনো ব্যর্থ হয় না। (মেশকাতুল মাসাবিহ।)

ইফতার যথাসম্ভব দ্রুত করা উচিত। দেরিতে করলে গোনাহ হবে না কিন্তু হাদিসে বড় কল্যাণের কারণ বলা হয়েছে এ কাজকে। তিরমিজি ও আবু দাউদ শরিফের হাদিসে এসেছে, নবীজি বলেছেন, তোমরা তত দিন পর্যন্ত কল্যাণের সঙ্গে থাকবে যত দিন সূর্যাস্তের সঙ্গে সঙ্গে ইফতার করবে। আরেকটি হাদিসে নবীজি বলেছেন, আমি ওই উম্মতকে ভালোবাসি, যে দ্রুত ইফতার করে। তারপর নবীজি বলেন, পূর্ববর্তী সব নবীর সুন্নত ছিল, দ্রুত ইফতার করা। (আবু দাউদ।) সারা দিন ক্ষুধার্ত থেকে ইফতারের সময় খাবারের ওপর হামলে পড়তে দেখা যায় অনেককে। এটিও সুন্নাতবিরোধী কাজ। আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতেও ইফতারে অতিভোজন স্বাস্থ্যের পক্ষে মারাত্মক ক্ষতিকর বলে প্রমাণিত হয়েছে। নবীজির ইফতার ছিল খুবই সাদামাটা। অনেকে মনে করেন, খেতে পেতেন না কিংবা খাবার ছিল না এ জন্য নবীজি সাদামাটা ইফতার করতেন। এ ধারণাটি সঠিক নয়। আসলে নবীজি বিজ্ঞানময় জীবনযাপন করতেন। তিনি খুব ভালো করেই বুঝতে পেরেছেন, দীর্ঘ সময় পাকস্থলী খালি থাকার পরপরই খুব বেশি খাবার গ্রহণ করা উচিত নয়। তাছাড়া রূহকে তাজা করার এই মাসে দেহকে বেশি খাবার দেওয়াও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথে বড় বাধা। তাই নবীজি পুরো রমজানজুড়েই বেশি বেশি ইবাদত করতেন কিন্তু খুব কম খাবার খেতেন। হাদিস শরিফে বলা হয়েছে, নবীজি ইফতার করতেন তাজা খেজুর দিয়ে। তাজা খেজুর না থাকলে শুকনো খেজুর দিয়ে। তাও না পেলে কয়েক ঢোক দুধ পান করতেন। তার পরই মাগরিবের নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। আমরা যারা রমজানকে আত্মার পরিশুদ্ধির মাস হিসেবে নিয়েছি, আমাদেরও নবীজির মতো পরিমিত খাবার গ্রহণ করতে হবে।

ইফতারে বন্ধুবান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশীকে শরিক করার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্যকে ইফতার করানোর সওয়াব সম্পর্কে নবীজি বলেন, কেউ কোনো রোজাদারকে ইফতার করালে রোজাদারের সমান সওয়াবও তাকে দেওয়া হবে। এ জন্য কারও সওয়াব থেকে কমানো হবে না। এমন লোভনীয় সওয়ারের কথা শুনে সাহাবিরা খুবই খুশি হলেন। একজন সাহাবি জিজ্ঞাসা করলেন, নবীজি! আমাদের মধ্যে এমন অনেক দরিদ্র সাহাবি আছেন, যারা অন্যকে ইফতার করানোর সামর্থ্য রাখেন না। নবীজি বললেন, তুমি চাইলে তোমার ভাইকে এক ঢোক পানি কিংবা একটি খেজুর দিয়ে ইফতার করিয়েও সওয়াব অর্জন করতে পার। মুহাদ্দিসরা বলেন, নবীজির মুখে এমন কথা শোনার পর থেকে এক সাহাবি আরেক সাহাবির মেহমান হতেন। কোনো সাহাবিই মেহমান ছাড়া ইফতার করতেন না। ফলে সওয়াব অর্জনের প্রতিযোগিতার ফাঁকে ভাইয়ে ভাইয়ে ভালোবাসার বন্ধন আরও জোরালো হয়ে ওঠে। আর এটাই ছিল নবীজির উদ্দেশ্য।

লেখক : চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ মুফাসসির সোসাইটি, পীর সাহেব, আউলিয়ানগর, www.selimazadi.com

সর্বশেষ খবর