রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ক্যান্সার ও হৃদরোগী বাড়ছেই

ধূমপান খাদ্যাভ্যাস ফসলে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশক ও ভেজালকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

ক্যান্সার ও হৃদরোগী বাড়ছেই

দেশে প্রতি চারজন প্রাপ্তবয়স্কর মধ্যে তিনজনের হৃদরোগ ঝুঁকি রয়েছে। প্রতি বছর দেড় লাখ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন ক্যান্সারে। দুরারোগ্য দুই ব্যাধিতে আক্রান্তের হার বাড়ছে আশঙ্কাজনকভাবে। ক্যান্সার ও হৃদরোগে আক্রান্ত বাড়ার কারণ হিসেবে ধূমপান, খাদ্যাভ্যাস, ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, খাদ্যে ভেজাল, কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়াকে দায়ী করছেন চিকিৎসকরা।

জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. স্বপন কুমার বন্দ্যোপাধ্যায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘প্রতি বছর দেশে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগী শনাক্ত বাড়ছে। প্রায় দেড় লাখ মানুষ প্রতি বছর ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। রোগী শনাক্ত বাড়ায় আক্রান্তের সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। মানুষের বয়স যত বাড়ে ক্যান্সার আক্রান্তের ঝুঁকি তত বাড়ে। এর বাইরেও কিছু অনুঘটক আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ধূমপান ও তামাক সেবন মুখগহ্বর, পাকস্থলী, ফুসফুসের ক্যান্সারের জন্য সরাসরি দায়ী। অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।’ এ ছাড়া ফসলে অতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, ভেজাল খাবার গ্রহণ ক্যান্সারের জন্য দায়ী বলে জানান এই চিকিৎসক। তিনি আরও বলেন, ‘অভ্যাস পরিবর্তন করে ক্যান্সার ঝুঁকি অনেকটা কমানো যায়। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবন বন্ধ করতে হবে। খাবার তালিকা থেকে অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার ও জাঙ্ক ফুড বাদ দিতে হবে। বাল্যবিয়ে বন্ধ করলে জরায়ুমুখ-ক্যান্সার প্রতিরোধ করা যায়। এ ছাড়া কিছু টিকা দিয়ে সার্ভিক্যাল ক্যান্সার প্রতিহত করা যায়। সেদিকেও নজর দিতে হবে।’

নানা ধরনের ক্যান্সারে আক্রান্ত বাড়ছে। কিন্তু দেশে আক্রান্তের সঠিক পরিসংখ্যান না থাকায় কাজে আসছে না কোনো উদ্যোগ। চিকিৎসা কেন্দ্র, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংকটে ক্যান্সার চিকিৎসা। সংকট কাটাতে দেশের আট বিভাগীয় মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ক্যান্সার চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউটের তথ্যমতে সাধারণত ফুসফুস, স্তন, জরায়ুমুখ, মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত  রোগী বেশি। এ ছাড়া খাদ্যনালি, পাকস্থলী, লিভার, বাকযন্ত্র, পায়ুপথ, ডিম্বাশয়, বৃহদান্ত, সারভাইরাকাল, লিউকেমিয়া বা ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় মানুষ। ৫ জানুয়ারি প্রকাশিত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমীক্ষায় ক্যান্সার আক্রান্ত বিষয়ে উঠে এসেছে বিভিন্ন তথ্য। প্যাথলজিভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি এবং মাসব্যাপী হাসপাতালভিত্তিক ক্যান্সার রেজিস্ট্রি বিশ্লেষণ করে বিএসএমএমইউর পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগ বলছে, নারীদের ক্ষেত্রে স্তন ক্যান্সার এবং পুরুষের মূত্রথলির ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা সবচেয়ে বেশি। এ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান, সিনিয়র রিসার্চ অফিসার ডা. শেহরিন ইমদাদ রায়না তাঁদের সমীক্ষার ফলাফল তুলে ধরেন। তাঁরা জানান, নমুনায় ১৭ শতাংশ ক্যান্সার হিসেবে চিহ্নিত হয়। যাদের নমুনায় ক্যান্সার ধরা পড়ে তাদের ৫৯ দশমিক ৫ শতাংশ নমুনা নারী, বাকি ৪০ দশমিক ৫ শতাংশ নমুনা পুরুষ। গবেষণার জন্য মোট নমুনার সংখ্যা ছিল ২১ হাজার ১৭৫টি। এর মধ্যে ক্যান্সার শনাক্ত হয় ৩ হাজার ৫৮৯ জনের। ডা. খালেকুজ্জামান বলেন, পুরুষের মধ্যে ১০ দশমিক ২ শতাংশ মূত্রথলির, ৯ দশমিক ৯ শতাংশ প্রস্টেট, ৮ দশমিক ৫ শতাংশ মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। নারীদের ২৩ দশমিক ৩ শতাংশ স্তন, ২১ দশমিক ৫ শতাংশ জরায়ুমুখ আর ৮ দশমিক ৯ শতাংশ মুখগহ্বরের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছেন। করোনাকালে থেমে নেই ক্যান্সারের ভয়াবহতা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) তথ্যানুযায়ী গত পাঁচ বছরের মধ্যে ২০২০ সালেই দেশে মরণঘাতী ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে সবচেয়ে বেশি। ওই বছরে শনাক্তকৃত ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা ছিল দেড় লাখের বেশি। গ্লোবাল ক্যান্সার ইনসিডেন্স, মর্টালিটি অ্যান্ড প্রিভিলেন্স (গ্লোবোক্যান) পরিসংখ্যানের আলোকে ডব্লিউএইচওর অধীন ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) জানিয়েছে, গত পাঁচ বছরে শনাক্তকৃত রোগীর মধ্যে এখনো ক্যান্সারে আক্রান্ত রয়েছেন ২ লাখ ৭১ হাজারের কাছাকাছি। এর মধ্যে ২০২০ সালে শনাক্ত হয়েছিলেন ১ লাখ ৫৬ হাজার ৭৭৫ জন। একই সময়ে মৃত্যু হয়েছে প্রায় ১ লাখ ৯ হাজার ক্যান্সার আক্রান্তের। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দেশে সক্রিয় ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা প্রকৃতপক্ষে আরও কয়েক গুণ বেশি হতে পারে। কারণ সারা দেশে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে সমন্বিত কোনো পরিসংখ্যান না থাকায় প্রকৃত সংখ্যা বের করা মুশকিল। ক্যান্সারের মতোই ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে হৃদরোগ। বর্তমান বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও দেশে বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা ছিল বেশি। তবে গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগের প্রবণতা বেড়েছে। দেশে বর্তমানে শতকরা ৫৩ ভাগ মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগের কারণে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ। উচ্চ রক্তচাপ ও গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমের কারণে বাড়ছে হৃদরোগের ঝুঁকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) গত বছরের পরিসংখ্যানে দেখা যায় ১৯৭০ সালের পর উন্নত বিশ্বে মৃত্যুহার কমে গেলেও বিশ্বব্যাপী মৃত্যুর অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায় হৃদরোগ। বর্তমান বিশ্বে এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা যাচ্ছে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে। কিছুদিন আগ পর্যন্তও দেশে বয়স্কদের মধ্যে হৃদরোগে আক্রান্তের প্রবণতা ছিল বেশি, তবে গত কয়েক বছরে তরুণদের মধ্যেও হৃদরোগের প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। বাংলাদেশে বর্তমানে শতকরা ৫৩ ভাগ মৃত্যু হয় অসংক্রামক রোগের কারণে। এর মধ্যে শীর্ষে রয়েছে হৃদরোগ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্ডিওলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. এস এম মোস্তফা জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশে হৃদরোগী আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। আমরা গবেষণায় দেখেছি সব বয়সী মানুষ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছে। কিছুদিন আগে আমরা এক রোগীর বাইপাস সার্জারি করেছি। তার বয়স ছিল ১১ বছর। হার্টের এমন অবস্থা ছিল যে রিং পরানোর মতো জায়গা ছিল না। তরুণদের মধ্যে হৃদরোগ আক্রান্ত হওয়ার ঘটনা বেড়েছে। ডায়াবেটিস, ধূমপান, চর্বিযুক্ত খাবার, ফাস্টফুড গ্রহণ, কায়িক পরিশ্রম কমে যাওয়া, স্থূলতা হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এ ছাড়া পারিবারিক রোগের ইতিহাস থাকলে বংশগত কারণে অনেকে আক্রান্ত হয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘সচেতনতা বাড়ায় মানুষ এখন শারীরিক সমস্যা বোধ করলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে পারে। এতে রোগী শনাক্ত বেড়েছে। সচেতন হলে হৃদরোগের ঝুঁকি অনেকটা কমানো যাবে।’ যুক্তরাজ্যের ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়, আইসিডিডিআরবি ও জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট পরিচালিত ব্রেভ স্টাডি (বাংলাদেশ রিস্ক অব অ্যাকিউট ভাসকুলার ইভেন্টস) নামের এক জরিপ থেকে জানা যায়, দক্ষিণ এশিয়ায় ২০১০ সালের পর থেকে হৃদরোগে আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে হৃদরোগের প্রকোপ বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। বিশ্বে বর্তমানে প্রতি বছর হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যাচ্ছে ১ কোটি ৭৩ লাখ মানুষ, যার মধ্যে অপরিণত বয়স ও উন্নয়নশীল দেশগুলোয় মারা যাচ্ছে শতকরা ৮০ শতাংশ। জাতীয় হৃদরোগ ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ডা. আফজালুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘হৃদরোগের প্রাথমিক উপসর্গগুলোর মধ্যে রয়েছে- বুকের এক পাশে কিংবা চারপাশে ব্যথা অনুভূত হওয়া, বুক ভারী লাগা, শরীরের অন্য অংশ যেমন বাঁ হাতে, পিঠে, চোয়ালে এ ব্যথা হতে পারে। ব্যথার সঙ্গে ঘাম হওয়া, নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসা, বমি বমি ভাব হওয়া, বুক ধড়ফড় করা বা বিনা কারণে অস্থির লাগা, মাথা ঝিম ঝিম করা ইত্যাদি উপসর্গ থাকতে পারে। এ ধরনের উপসর্গ হলে অবশ্যই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হবে।’ হৃদরোগের ঝুঁকি মোকাবিলায় বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা। এর মধ্যে অন্যতম ধূমপান, মাদক সেবন থেকে বিরত থাকা, দুশ্চিন্তা না করা, শরীরের রক্তচাপ নিয়মিত পরীক্ষা করা, প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০ মিনিট হাঁটাচলা করা, ব্যায়াম করা, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা, প্রচুর শাকসবজি খাওয়া, নিজেকে চিন্তামুক্ত রাখা এবং মাঝেমধ্যে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

সর্বশেষ খবর