রবিবার, ১৭ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ভুয়া টিকিট ভিসা দিত ওরা

ধর্ষিতা নারী উদ্ধার

নিজস্ব প্রতিবেদক

মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে ভুয়া টিকিট ও ভিসা সরবরাহ করত ওরা। একেকজনের কাছ থেকে আদায় করত ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা। গত পাঁচ বছরে শতাধিক মানুষের কাছ থেকে এরই মধ্যে ৩ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে চক্রের সদস্যরা। এ ছাড়া বিদেশে উচ্চ বেতনে চাকরির কথা বলে তারা বহু নারীর অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে ধর্ষণও করত। সর্বশেষ তাদের কবল থেকে মৌলভীবাজারের এক নারীকে উদ্ধার করেছে র‌্যাব-৩-এর একটি দল। রাজধানীর রামপুরা ও হাতিরঝিল থেকে শুক্রবার বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার করা হয়েছে চক্রের হোতা কামরুল আহমেদ, খালেদ মাসুদ হেলাল, তোফায়েল আহমেদ ও মো. জামালকে। রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে গতকাল সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৩ অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আরিফ মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, গ্রেফতারের সময় তাদের কাছ থেকে ২৭টি পাসপোর্ট, একটি মনিটর, একটি সিপিইউ, একটি মাউস, একটি কিবোর্ড, একটি ইউপিএস, ভুয়া ভিসার ১০০টি কপি, ১২৫টি ভুয়া টিকিট, চারটি মোবাইল, কভিড-১৯ নমুনা সংগ্রহ ও পরীক্ষার দুটি ফরম এবং একটি প্রিন্টার উদ্ধার করা হয়েছে। র‌্যাব-৩ অধিনায়ক বলেন, ‘কিছু সুনির্দিষ্ট অভিযোগের মধ্যে একটির তদন্ত করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি, রামপুরা এলাকায় মানব পাচার ও প্রতারক চক্র মধ্যপ্রাচ্যে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। এরা ভুয়া ভিসা ও টিকিট দিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বেকারদের কাছ থেকে অর্থ নিচ্ছিল। বিমানবন্দরে যাওয়ার পরই ভুক্তভোগীরা ভয়াবহ বিপাকে পড়ছেন। ইমিগ্রেশন কর্তৃপক্ষ ভিসা ও টিকিট জাল হওয়ায় বিমানবন্দর থেকে ফিরিয়ে দিয়েছে অনেককে। ভুক্তভোগীরা পরে চক্রের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলেও তারা যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এভাবে গত দুই বছরে চক্রের সদস্যরা আটবার বাসার ঠিকানা পরিবর্তন করে। গত পাঁচ বছরে চক্রটি অবৈধভাবে শতাধিক লোককে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পাঠায়। তারা বিদেশ গিয়ে কাজ না পেয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে।

যেভাবে নারীকে উদ্ধার : র‌্যাব কর্মকর্তা মহিউদ্দিন জানান, ‘১২ এপ্রিল চক্রটি মৌলভীবাজার থেকে একজন নারীকে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে রামপুরা এলাকার কামরুলের বাসায় নিয়ে আসে। বাসায় আটকে রেখে তোফায়েল ওই নারীকে ধর্ষণ করেন। ওই নারী মোবাইলে সাহায্য চাইলে আমরা ১৩ এপ্রিল রাত আড়াইটার দিকে রামপুরা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে উদ্ধার করি।’ উদ্ধারের পর ওই নারী র‌্যাবকে জানান, তিনি সাইফুল ইসলাম শান্ত নামের এক ব্যক্তিকে বিয়ে করেছিলেন। বিয়ের পর সাইফুল যৌতুক বাবদ ধাপে ধাপে ৫ লাখ টাকা নিয়ে তাকে ছেড়ে চলে যায়। মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে তার বাবা যৌতুকের টাকা ধারদেনা করে জোগাড় করেছিলেন। পাওনাদাররা টাকার জন্য চাপ দিতে থাকলে তিনি গ্রামের দালাল তোফায়েলের শরণাপন্ন হন। অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তোফায়েল তাকে গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরব পাঠানোর প্রলোভন দেখান। তিনি সৌদিতে যেতে রাজি হন। এরপর সৌদি যেতে হলে আরবি ভাষার ট্রেনিং করতে হবে বলে তাকে ঢাকায় কামরুলের বাসায় এনে আটক রেখে ধর্ষণ করা হয়। পরে আইনি ব্যবস্থা নিতে ওই নারীকে রামপুরা থানায় পাঠায় র‌্যাব। বাদী হয়ে ওই নারী রামপুরা থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন।

প্রাথমিক অনুসন্ধান ও আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র‌্যাব জানায়, আসামিদের জনশক্তি রপ্তানির লাইসেন্স নেই, কিন্তু তারা দীর্ঘদিন ধরে জনশক্তি রপ্তানির নামে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসার মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে লোক পাঠাত। এ ছাড়া চক্রটি মধ্যপ্রাচ্য হয়ে ইউরোপে জনশক্তি পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে বিদেশ যেতে ইচ্ছুক বেকারদের কাছ থেকে ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা করে হাতিয়ে নিত। বিনিময়ে ভুয়া ভিসা ও ভুয়া টিকিট ধরিয়ে দিত ভুক্তভোগীদের হাতে। র‌্যাব জানায়, চক্রের হোতা কামরুল নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তার নির্দিষ্ট পেশা নেই। প্রতারণা ও মানব পাচারই তার কাজ। ২০১৯ সালে কামরুল ভ্রমণ ভিসায় সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই যান। তারপর সেখানে মানব পাচারের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দিয়ে দুবাইয়ের রেসিডেন্স ভিসা পান তিনি। সেখানে একটি প্রাইভেট কার কিনে নিজে ড্রাইভিং করে অর্থ উপার্জন করেন। করোনা মহামারিতে প্রাইভেট কারটি বিক্রি করে ২০২১ সালের মে মাসে দেশে ফিরে এসে আবার প্রতারণা ও মানব পাচার শুরু করেন কামরুল। তিনি বিভিন্ন ট্যুরস ও ট্রাভেলসের সঙ্গে যোগাযোগ করে অবৈধভাবে ভ্রমণ ভিসায় বিভিন্ন দেশে লোক পাঠাতেন। কামরুলের নামে চট্টগ্রাম আদালতে একটি চেক জালিয়াতির মামলা এবং মৌলভীবাজার আদালতে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের করা ১৮ লাখ টাকার একটি মামলা রয়েছে। তার বিভিন্ন ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ৩৮ লাখের বেশি টাকা আছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর