সোমবার, ১৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ভেঙে দেওয়া হলো জেলা পরিষদ

এক দিনের মধ্যে আমলাদের কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার নির্দেশ ক্ষুব্ধ চেয়ারম্যানরা, এক সপ্তাহের মধ্যে প্রশাসক নিয়োগ

উবায়দুল্লাহ বাদল

পাঁচ বছরের মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ায় দেশের পার্বত্য তিন জেলা ছাড়া সব জেলা পরিষদ ভেঙে দেওয়া হয়েছে। গতকাল ৬১টি জেলা পরিষদ বিলুপ্ত করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে স্থানীয় সরকার বিভাগ। জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা পরিচালনার জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে এসব জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হবে বলে জানিয়েছে স্থানীয় সরকার বিভাগ।

এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ ও অপমানিতবোধ করছেন বলে জানিয়েছেন বিদায়ী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা। তারা গতকাল সপ্তাহের প্রথম দিন অফিসে গিয়েই জেলা পরিষদ বিলুপ্তির চিঠি পান। এতে অনেকেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। কেউ কেউ গতকালই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন। তারা অনেকেই কোনো ধরনের নথিপত্র গোছানোরও সুযোগ পাননি। এ ঘটনাকে অনাকাক্সিক্ষত ও দুঃখজনক বলে মন্তব্য করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, এতে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে। এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।

গতকাল স্থানীয় সরকার বিভাগের জেলা পরিষদ শাখা থেকে এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়- ‘জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এর ধারা ৫ অনুযায়ী (জেলা পরিষদ সংশোধন আইন, ২০২২ অনুযায়ী) দেশের ৬১ জেলা পরিষদের মেয়াদ প্রথম সভার তারিখ হতে পাঁচ বছর উত্তীর্ণ হওয়ায় পরিষদসমূহ বিলুপ্ত হয়েছে। এমতাবস্থায় জেলা পরিষদ আইন, ২০০০ এর ধারা ৮২ অনুযায়ী সরকার কর্তৃক প্রশাসক নিয়োগের পূর্ব পর্যন্ত ওই আইনের ধারা ৭৫ এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে প্রত্যেক জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা পরিচালনার জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাগণকে দায়িত্ব অর্পণ করা হলো।’

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আজকেই আমরা ৬১টি জেলা পরিষদ ভেঙে দিয়েছি। এখন প্রশাসক নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে। আগামী ৮/১০ দিনের মধ্যে প্রশাসক নিয়োগ সম্পন্ন হবে। এই কয়েক দিনের জন্য আমরা জেলা পরিষদের প্রশাসনিক ও আর্থিক ক্ষমতা পরিচালনার জন্য প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বা ভারপ্রাপ্ত প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাগণকে দায়িত্ব দিয়েছি। এরই মধ্যে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচনের আয়োজন করার অনুরোধ করেছি এবং জেলা প্রশাসকদের ভোটার তালিকা তৈরি করার নির্দেশ দিয়েছি। কারণ এখানকার ভোটার স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানের জনপ্রতিনিধিরা।’

প্রশাসক কি সরকারি কর্মকর্তারাই হবেন না রাজনীতিবিদরা- এ প্রশ্নের জবাবে হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, ‘আইনে দুটি সুযোগ রয়েছে। একটি সরকারি কর্মকর্তা, অপরটি বিশিষ্ট ব্যক্তি। বিষয়টি রাজনৈতিকভাবেই সিদ্ধান্ত হবে। এখন সরকার যেভাবে নির্ধারণ করবে আমরা সেভাবেই নিয়োগ দিব। এ বিষয়টি আমাদের মন্ত্রী মহোদয় দেখভাল করছেন। তিনি যে তালিকা দেবেন সেভাবেই আমরা প্রজ্ঞাপন জারি করব।’

তবে এ বিষয়টিকে ভালোভাবে নিচ্ছেন না সদ্য বিলুপ্ত হওয়া জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা। তারা বলছেন, এটা আমলাদের কারসাজি। তারা জনপ্রতিনিধিদের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। তারা যা খুশি তাই করছেন। স্থানীয় সরকার বিভাগ যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তা চেয়ারম্যানদের জন্য অপমানজনক।

এ প্রসঙ্গে জামালপুর জেলা পরিষদের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান ও জামালপুর জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফারুক আহম্মদ চৌধুরী বলেন, ‘আমি আজ দুপুরে অফিসে গিয়ে চিঠি পেয়েছি। সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে এসেছি। উচিত ছিল প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পর তাদের কাছে আমাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার সুযোগ দেওয়া। তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘এটা আমলাদের কারসাজি। তারা জনপ্রতিনিধিদের কোনো তোয়াক্কাই করছে না। স্থানীয় সরকার বিভাগ যে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে তা চেয়ারম্যানদের জন্য অপমানজনক। অন্যায়ভাবে এ প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে। জনপ্রতিনিধিদের অপমানিত করা হয়েছে।’

প্রায় অভিন্ন ভাষায় কথা বলেছেন কুষ্টিয়া জেলা পরিষদের সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান রবিউল ইসলাম। তিনি বলেন, এভাবে জেলা পরিষদ বিলুপ্ত না করে বিদায় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে হলে অনেক সুন্দর হতো। সোমবার জেলা পরিষদের গাড়ি বুঝিয়ে দিব। কাজের স্বীকৃতি নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারলেন না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের মনোভাবের সঙ্গে পুরোই একমত পোষণ করেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার। তিনি গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানরা ক্ষমতাসীন দলের সিনিয়র নেতা। তাদের এভাবে বিদায় করা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। সাংবিধানিক নির্দেশনা হলো গণতন্ত্র। আর গণতন্ত্র মানেই সর্বত্র জনপ্রতিনিধিদের শাসন। জনপ্রতিনিধিদের বাদ দিয়ে আমলাদের ওপর দায়িত্ব দেওয়া গণতন্ত্রের সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। তাদের মেয়াদ শেষের আগেই নির্বাচনের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল। এসব কারণে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলো গুরুত্ব হারাচ্ছে।’

প্রসঙ্গত, গত ৭ এপ্রিল মেয়াদ শেষ হলে জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগের বিধান যুক্ত করে ‘জেলা পরিষদ (সংশোধন) বিল-২০২২’ আইন পাস হয়। এখন প্রশাসকের মেয়াদ ১৮০ দিনের বেশি হবে না। একই সঙ্গে একাধিকবার কেউ প্রশাসক থাকতে পারবেন না বলেও বিধান রাখা হয়েছে।

সাবেক রাষ্ট্রপতি এইচ এম এরশাদের আমলে গঠিত জেলা পরিষদে সংসদ সদস্যরা দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ সালে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার নতুন করে জেলা পরিষদ আইন প্রণয়ন করে। এরপর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ আবার ক্ষমতায় আসার পর ২০১১ সালে প্রশাসক নিয়োগ দিয়ে জেলা পরিষদ পরিচালনা করে। আওয়ামী লীগ নেতারাই মূলত প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ পান। প্রথমবারের মতো জেলা পরিষদ নির্বাচন হয় ২০১৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর