মঙ্গলবার, ১৯ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

হাওরে ভয়াবহ পরিস্থিতি

♦ সুনামগঞ্জে পানি ঢুকছেই ♦ কিশোরগঞ্জে আতঙ্কে কৃষক ♦ হবিগঞ্জে পানির নিচে পাকা ধান ♦ নেত্রকোনায় ঝুঁকির মুখে বাঁধ

প্রতিদিন ডেস্ক

হাওরে ভয়াবহ পরিস্থিতি

হবিগঞ্জের লাখাইর হাওরে পানিতে তলিয়ে যাওয়া ধান কাটছে কৃষক -বাংলাদেশ প্রতিদিন

পানি বাড়ছেই হাওরে। তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকার ফসল। আতঙ্কে রয়েছেন কৃষকরা। তারা বলছেন, পরিস্থিতি অত্যন্ত ভয়াবহ। খবর পাঠিয়েছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের প্রতিনিধিরা-

সুনামগঞ্জে গায়েবি পরিসংখ্যান : সুনামগঞ্জে উজানের ঢলের পানির চাপে বাঁধ ভেঙে যেসব হাওরের ফসল হানি হয়েছে, সেখানে ধান কাটার যে ‘গায়েবি’ পরিসংখ্যান দিয়েছে কৃষি বিভাগ, বাস্তবের সঙ্গে তার মিল নেই বলে মনে করছেন কৃষকরা। হাওরের ফসল এ পর্যন্ত ৩৭ ভাগ কাটার দাবি করা হলেও তলিয়ে যাওয়া হাওরের ধান কাটার পরিমাণ ৭০ থেকে ৮০ ভাগ দেখানো হয়েছে। ‘বন্যায় ক্ষতি কম, লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বেশি’ ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে দুর্যোগকালীন সময়ে এমন বার্তা দিতে এমন কাল্পনিক তথ্য দেওয়া হয়েছে বলে জানান হাওর আন্দোলনের নেতারা। সেই সঙ্গে ফসল তলিয়ে যাওয়ার ফলে বাঁধ নির্মাণের সঙ্গে জড়িতদের প্রতি কৃষকদের মাঝে যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে, সেটি প্রশমনের চেষ্টার অংশও এটি।

হাওর বাঁচাও আন্দোলনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালেহীন চৌধুরী বলেন, মাঠপর্যায় থেকে আমাদের পাওয়া তথ্য মতে এ পর্যন্ত জেলায় প্রায় ১৫ ভাগ জমির ধান কাটা হয়েছে। হাওর বিপর্যয়ের সময় কৃষি বিভাগ প্রতিবারই  বেশি অর্জন দেখানোর চেষ্টা করে, যাতে বাঁধ নির্মাণের অনিয়ম-দুর্নীতি আড়াল করা যায়। একইভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম দেখায় সরকারি এই সংস্থাটি।

কিশোরগঞ্জে হাওরের ৩০ হাজার কৃষক আতঙ্কে : পাহাড়ি ঢলে বাড়ছে মেঘনা নদীর পানি। এতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার জোয়ানশাহী হাওরের কৃষকদের মধ্যে বাড়ছে আতঙ্ক। যে কোনো সময় পানি ঢুকে তলিয়ে যেতে পারে বোরো ধান।

তবে প্রতিবারের মতো এবারও মেঘনার বাড়তি পানির চাপ সামলাতে অস্থায়ীভাবে একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। তবে এ বাঁধ নির্মাণে উঠেছে অনিয়মের অভিযোগ। ফলে যে কোনো সময় বাঁধ ভেঙে হাওরে পানি ঢোকার আশঙ্কা করছেন কৃষক।

কৃষি অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার শ্রীনগর, আগানগর ও সাদেকপুর ইউনিয়ন নিয়ে জোয়ানশাহী হাওরটির অবস্থান। এ হাওরে সাধারণত প্রতি একর জমিতে ৬০ থেকে ৭০ মণ ধান উৎপাদন হয়। ফলে কৃষি অর্থনীতিতে হাওরটি অগ্রণী ভূমিকা রাখছে।

এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাদিকুর রহমান সবুজ বলেন, আসলে জোয়ানশাহী হাওর রক্ষায় যে ডুবন্ত কাঁচা বাঁধ নির্মাণ করা হয়, সেটি তিনটি ধাপে হয়। মেঘনায় পানি বাড়ার খবর পেয়ে বাঁধটি পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। এ সময় বাঁধ নির্মাণকারী ঠিকাদারকে আরও মাটি ফেলার নির্দেশ দিয়েছি। একই সঙ্গে বাঁধটি পাহারা দেওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে।

বাঁধ নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, বিষয়টি তদন্ত সাপেক্ষে অভিযোগ প্রমাণিত হলে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

হবিগঞ্জের হাওরে পানির নিচে পাকা ধান : কালনী ও মেঘনা নদীর পানি প্রবেশ করে হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলায় তিনটি হাওরের শতাধিক হেক্টর বোরো ধানের জমি তলিয়ে গেছে। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে কৃষকের গোলায় ওঠার অপেক্ষায় থাকা ৩ হাজার হেক্টর জমির ফসল তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এই অনিশ্চয়তা থেকে কৃষকরা  আধাপাকা ধান কাটা শুরু করেছেন।

লাখাই উপজেলার এক নম্বর লাখাই ইউনিয়নে অবস্থিত মেঘনা ও কালনী নদী সরাসরি হাওরের সঙ্গে যুক্ত। ফসল রক্ষা বাঁধ না থাকায় গত দুই দিন ধরে নদীর পানি ব্যাপক হারে হাওরে প্রবেশ করছে। এতে ইউনিয়নটির শিবপুর, সুজনপুর ও বারচর হাওরের শতাধিক হেক্টর জমির আধাপাকা ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

এ বিষয়ে লাখাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. শরীফ উদ্দিন বলেন, লাখাই ইউনিয়নের বোরোর জমিগুলো তুলনামূলক নিচে। পরিদর্শনে দেখেছি ধানগাছগুলো পানির নিচে তলিয়ে যায় যায় অবস্থায়। এ অবস্থায় দ্রুত ধান কাটার জন্য সব কৃষককে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

হবিগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ শোভন জানান, হবিগঞ্জের নদ-নদীগুলো স্বাভাবিক অবস্থায় রয়েছে। হাওরগুলোও এখন নিরাপদ। তবে যে স্থান দিয়ে পানি প্রবেশ করছে, সেটি অনেক নিচু এলাকা।

নেত্রকোনায় ঝুঁকির মুখে বাঁধ : পাহাড়ি ঢলে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের ধনু নদের পানি যেন ঠেলছে বাঁধগুলোকে। যে কারণে হাওরের খালিয়াজুরী উপজেলার ৫৫ কিলোমিটার বাঁধের ৭ কিলোমিটার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধে ফাটলের পর ফাটল দেখা দিচ্ছে।

গতকাল সকাল থেকে ধনুর পানি বিপৎসীমার ২২ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। কৃষকরা বলছেন, মাত্র ২৫ ভাগ ধান কেটেছেন তারা। তার ওপর কাঁচা আধাপাকা। কৃষক মগবুল মোল্লাসহ অনেকেই বলছেন, কাঁচার কারণে ধানে ৮/১০ মণের স্থলে ৩/৪ মণ পাচ্ছেন। এদিকে বাঁধ মেরামতে গত ২ এপ্রিল থেকেই দিনরাত এক করে স্বেচ্ছাশ্রম দিচ্ছেন স্থানীয় কৃষক ও এলাকাবাসী। ফসল রক্ষায় প্রাণপন চেষ্টা, অন্যদিকে তলিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় কাঁচা ধান কাটছেন কৃষক। এতে কোনোভাবেইে ক্ষতি পোষাতে পারবেন না হাওরবাসী। বছরজুড়ে কী খেয়ে বেঁচে থাকবেন- এমন নানা দুশ্চিন্তায় দিনরাত কাটছে হাওরবাসীর। চলছে এক প্রকার নীরব হাহাকার।

এদিকে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ-পরিচালক এফ এম মোবারক আলী জানান, হাওরের ধান ৬০ ভাগ কাটা শেষ; যা কৃষকের তথ্যের সঙ্গে মিল নেই। তবে সকালে মদন উপজেলার ফতেপুরতলার হাওরের বাঁধটি ভেঙে যাওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে তিনি বলেন, ওই বাঁধের ভিতরের ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমিতে ফসল থাকলেও শতকরা ৫ ভাগ ডুবেছে। কৃষকরা বলছেন, কাঁচা ধান ৫ ভাগ কাটতে পারলেও বাকি সব তলিয়ে গেছে। 

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর