শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

নাহিদের পর মুরসালিন

আরও এক মৃত্যু, বিএনপি নেতাসহ আসামি ১৪২৪, ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের সমঝোতা, খুলেছে নিউমার্কেট

নিজস্ব প্রতিবেদক

নাহিদের পর মুরসালিন

নিউমার্কেটে গতকাল ক্রেতাসমাগম -বাংলাদেশ প্রতিদিন

রাজধানীর নিউমার্কেটের দোকানপাট খুলতে শুরু করেছে। শুধু নিউমার্কেট নয়, আশপাশের মার্কেটগুলোর দোকানও খুলতে শুরু করেছেন ব্যবসায়ীরা। টানা দুই দিন ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে দোকান মালিক ও কর্মচারীদের ব্যাপক সংঘর্ষের পর গতকাল সকাল ১০টা থেকে এসব দোকানপাট খুলতে দেখা যায়। তবে দোকান খুললেও ব্যবসায়ীদের মধ্যে আতঙ্ক কাটেনি। ঈদের আগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় সবারই লোকসান হয়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সংঘর্ষের ঘটনায় পৃথক তিন মামলায় ১ হাজার ৪২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া সংঘর্ষের ঘটনায় এ পর্যন্ত নাহিদ ও মুরসালিন নামে দুজন নিহত হয়েছেন। এদিকে গতকাল পর্যন্ত ঢাকা কলেজের উল্টোপাশের মার্কেটগুলো খোলেনি। এর আগে বুধবার রাতে ঢাকা কলেজের শিক্ষার্থী, শিক্ষক, প্রশাসন ও নিউমার্কেট দোকান মালিক সমিতির বৈঠকে মার্কেট খোলার সিদ্ধান্ত হয়। একই সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তিদের পরিবার ও আহতদের ক্ষতিপূরণ দেবেন ব্যবসায়ীরা। আর ভবিষ্যতে যে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা রোধে গঠন করা হবে মনিটরিং সেল। এ ছাড়া দীর্ঘ চার ঘণ্টা বৈঠকে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তি প্রদান, সংঘর্ষে হতাহতদের জন্য ক্ষতিপূরণসহ ব্যবসায়ী ও কর্মচারীদের আচরণে শৃঙ্খলা আনতে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জানানো হয়। নিউমার্কেটের পাঞ্জাবির দোকানি রহমাত উল্লাহ জানান, তিনি দোকান খুলেছেন। তবে এখনো ভয় কাটেনি। এ কয়েক দিনে তার অনেক ক্ষতি হয়েছে। ঈদের আগে এমন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ায় সবারই লোকসান হয়েছে। ফুটপাথের দোকানি ইবাদুল হোসেন জানান, ‘বুধবার রাতে নিউমার্কেট খোলার সিদ্ধান্ত হলেও ফুটপাথের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে আমরা সবাই ফুটপাথের দোকান খুলেছি।’ ঈদ সামনে রেখে কিছু দোকানে ক্রেতার ভিড় লক্ষ করা গেছে। এ ছাড়া নিউমার্কেট এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দায়িত্ব পালন করতে দেখা গেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত দুই দিন দোকান বন্ধ থাকায় তাদের অনেক ক্ষতি হয়েছে। করোনার জন্য গত দুই বছর ঈদে তারা দোকান খুলতে পারেননি। এবারের ঈদে সে ক্ষতি কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারবেন বলে তারা আশা করছেন। এক ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। দোকান খুলতে পেরে ভালো লাগছে। নিউমার্কেটের ঝামেলার কারণে আশপাশের সব দোকানপাট বন্ধ ছিল।’ এক ক্রেতা বলেন, ‘জানতাম আজকে নিউমার্কেট খুলবে-খুলবে না একটা ভাব। ভাবলাম মার্কেট যদি খোলা পাই তাহলে কিছু নেব। এখনো ভয় কাজ করতেছে। খোলা আছে দেখে তাড়াতাড়ি কেনাকাটা করে চলে যাব।’ নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় তিনটি মামলায় ১ হাজার ৪২৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। হত্যা, হত্যাচেষ্টা, জখম, ককটেল বিস্ফোরণ, সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ ও ভাঙচুরের অভিযোগে ব্যবসায়ী ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে এসব মামলা করা হয়েছে। বুধবার রাতে নিউমার্কেট থানায় এ মামলাগুলো করা হয়। ডিএমপির নিউমার্কেট জোনের এসি শরীফ মোহাম্মদ ফারুকুজ্জামান এসব তথ্য জানান। তবে গতকাল পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ।  সরকারি কাজে বাধা দেওয়া, পুলিশের ওপর আক্রমণ, ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে জখম ও ভাঙচুরের অভিযোগে একটি মামলা হয়েছে। এ মামলায় ২৪ জন এজাহারনামীয় আসামিসহ অজ্ঞাতনামা ২০০ থেকে ৩০০ ব্যবসায়ী-কর্মচারী এবং ঢাকা কলেজের ৬০০ থেকে ৭০০ শিক্ষার্থীকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। এ ছাড়া বিস্ফোরক দ্রব্য আইন, সরকারি সম্পদসহ জানমালের ক্ষয়ক্ষতির লক্ষ্যে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো এবং এ কাজে সহায়তার অভিযোগ এনে অজ্ঞাতনামা ১৫০ থেকে ২০০ জনকে আসামি করে আরও একটি মামলা হয়েছে। নিউমার্কেট থানার পরিদর্শক (তদন্ত) ইয়ামিন কবির ও নিউমার্কেট থানার এসআই মেহেদী হাসান বাদী হয়ে নিউমার্কেট থানায় মামলা দুটি দায়ের করেন। এ ছাড়া নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষের ঘটনায় নিহত হন কুরিয়ার সার্ভিস কর্মী নাহিদ হোসেন। এ ঘটনায় নাহিদের স্বজন সাইদ নিউমার্কেট থানায় একটি হত্যা মামলা করেছেন। মামলায় পরস্পরের যোগসাজশে খুন করার অভিযোগ এনে ১৫০ থেকে ২০০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে। সূত্র জানায়, পুলিশের দায়েরকৃত একটি মামলায় যে ২৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়েছে তারা হলেন- অ্যাডভোকেট মকবুল, আমির হোসেন আলমগীর, মিজান, টিপু, হাজী জাহাঙ্গীর হোসেন পাটোয়ারী, হাসান জাহাঙ্গীর মিঠু, হারুন হাওলাদার, শাহ আলম শন্টু, শহিদুল ইসলাম শহিদ, জাপানি ফারুক, মিজান বেপারী, আসিফ, রহমত, সুমন, জসিম, বিল্লাল, হারুন, তোহা, মনির, বাচ্চু, জুলহাস, মিঠু, মিন্টু ও বাবুল। ওই মামলার এক নম্বর আসামি অ্যাডভোকেট মকবুল নিউমার্কেট থানা বিএনপির সাবেক সভাপতি। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণের বিএনপির কার্যকরী সদস্য। নিউমার্কেটের যে দুটি খাবারের দোকান থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় তা মকবুলের মালিকানাধীন বলে জানা গেছে।

নাহিদের পর দোকান কর্মচারী মুরসালিনও না ফেরার দেশে : রাজধানীর নিউমার্কেটে শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে ডেলিভারিম্যান নাহিদের পর আহত দোকান কর্মচারী মো. মুরসালিনও (২৬) না ফেরার দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। গতকাল ভোরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। দুপুরে তার মরদেহ ঢামেক মর্গে ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কোন পক্ষের হামলায় মুরসালিনের প্রাণ গেল সেটি নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। এর আগে মঙ্গলবার দুপুরে শিক্ষার্থী-ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষের মধ্যে পড়ে গুরুতর আহত হন ‘ডি লিংক’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যান নাহিদ হোসেন (১৮)। তাকে ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি করা হয় এবং রাতেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এদিকে মুরসালিন নিহতের ঘটনায় কান্নায় ভেঙে পড়েন তার পরিবারের সদস্যরা। তারা বলছেন, এই দেশে কোনো বিচার নেই, কে করবে বিচার? তাই তারা মামলা করবেন না বলে জানিয়েছেন। একই কথা জানিয়েছিলেন নিহত নাহিদের বাবা নাদিম হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ। আমরা কোনো মামলা করব না। তবে আমরা চাই দোষীদের বিচার হোক।’ জানা গেছে, নিহত মুরসালিনের গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার তিতাস উপজেলার কালাইনগরে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে মুরসালিন দ্বিতীয়। কামরাঙ্গীরচরের পশ্চিম রসুলপুর এলাকায় স্ত্রী অর্ণি আক্তার মিতু, সাত বছর বয়সী মেয়ে হুমায়রা ইসলাম লামহা ও চার বছর বয়সী ছেলে আমির হামজাকে নিয়ে থাকতেন তিনি। নিউ সুপার মার্কেটের তৃতীয় তলায় ‘হাটবাজার’ নামে শার্ট-প্যান্টের দোকানের সেলসম্যান ছিলেন মুরসালিন। মঙ্গলবার দুপুরে চলা সংঘর্ষে তিনি আহত হন। এর পর থেকে ঢামেক হাসপাতালের আইসিইউতে ভর্তি ছিলেন। মর্গে মুরসালিনের ভাই নূর মোহাম্মদকে ক্লান্ত-শ্রান্ত অবস্থায় দেখা যায়। উপস্থিত সাংবাদিকদের তিনি বলেন, ‘এই দেশে কোনো বিচার নেই। কে করবে বিচার?’ খানিক দূরে গিয়ে তিনি কিছুক্ষণ অঝোরে কাঁদেন। বেলা দেড়টার দিকে ময়নাতদন্ত শেষে মুরসালিনের মরদেহ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

এরপর মরদেহ অ্যাম্বুলেন্সে করে কামারাঙ্গীরচরে পশ্চিম রসুলপুরের ভাড়া বাসায় নেওয়া হয়। মরদেহ নিয়ে রওনা দেওয়ার আগে মুরসালিনের ভাই নূর মোহাম্মদ সাংবাদিকদের সঙ্গে শেষবারের মতো কথা বলেন। সাংবাদিকদের প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘মামলা করে কী হবে? কার নামে মামলা করব? ভাইটা কীভাবে মারা গেল কিছুই জানলাম না। এটা কেবল ও আর আল্লাহ জানেন। ওর শরীরে আঘাত আর ক্ষতের বাইরে আমরা আর কিছুই দেখিনি।’ তাদের বাবা বেঁচে নেই, মা আছেন।

ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসক ঢামেক ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক মনিকা খন্দকার জানান, আঘাতের কারণে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মুরসালিনের মৃত্যু হয়েছে। কামরাঙ্গীরচরে মুরসালিনের বাসায় তার মরদেহের অপেক্ষায় ছিলেন স্ত্রী, মা, স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশী ও মার্কেট থেকে আসা তার সহকর্মীরা। মুরসালিনের মরদেহ সেখানে নেওয়া হলে কান্নায় ভেঙে পড়েন তারা। আশপাশের প্রতিবেশীরা শেষবারের মতো মুরসালিনকে দেখতে ভিড় করেন। এ সময় মুরসালিনের স্ত্রী ও মা বুক চাপড়িয়ে কাঁদতে থাকেন। স্বজনরা তাদের ধরে রাখতে পারছিলেন না। মাথায় তেল-পানি দেন কেউ।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর