শুক্রবার, ২২ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

ইতিকাফের গুরুত্ব তাৎপর্য ফাজায়েল ও মাসায়েল

মুফতি আমজাদ হোসাইন হেলালী

ইতিকাফের গুরুত্ব তাৎপর্য ফাজায়েল ও মাসায়েল

ইতিকাফ গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদত। একজন রোজাদার পবিত্র রমজানে নিজের ব্যস্ততা ও কাজ ছেড়ে মসজিদে চলে আসেন। দুনিয়াবি তামাম কাজ থেকে নিজেকে দূরে রেখে একমাত্র আল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তোলেন। ৯-১০ দিন মসজিদে অবস্থান করেন। এ সংক্ষিপ্ত সময় সম্পূর্ণ মনোযোগ ও একাগ্রতার সঙ্গে আল্লাহর জিকির, দোয়া ও ইবাদতে নিয়োজিত থাকেন। মহান রব্বুল আলামিনের নৈকট্য হাসিলের চেষ্টা ও সাধনা চালিয়ে যান। যতক্ষণ ইতিকাফকারী ইতিকাফে থাকেন ততক্ষণ তার পানাহার, ওঠাবসা, ঘুম, জাগা- প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদত। মনে হয় যেন ইতিকাফকারী আল্লাহর ঘরে এসে বলছেন, ওগো রব্বুল আলামিন! আমি এসে পড়েছি, আমায় ক্ষমা করে দিন, যতক্ষণ আপনি আমাকে ক্ষমা না করবেন ততক্ষণ আমি আপনার দরবার ছাড়ব না। বোঝা গেল ইতিকাফ গুরুত্বপূর্ণ এক ইবাদত। যা বিশেষ নিয়তে, বিশেষ অবস্থায় আল্লাহর আনুগত্যের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করতে হয়। শবেকদর পাওয়া এবং এ রাতের ঘোষিত ফজিলত থেকে উপকৃত হওয়ার জন্য ইতিকাফ থেকে উত্তম আর কোনো কাজ হতে পারে না। ইতিকাফ সম্পর্কে হজরত আয়েশা (রা.) বর্ণনা করেন, ‘নবী করিম (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন। ওফাত পর্যন্ত তিনি এভাবেই (ইতিকাফ) করে গেছেন।’ (বুখারি, মুসলিম) হজরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বর্ণনা করেন, ‘রসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করতেন।’ হজরত নাফে বলেন, ‘আমাকে ইবনে ওমর ওই স্থানটি দেখিয়েছেন যে স্থানে নবী করিম (সা.) ইতিকাফ করতেন।’ (মুসলিম)

ইতিকাফের ফজিলত : হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেন, রসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘ইতিকাফকারী গুনাহ থেকে মুক্ত থাকে। তার সব নেক আমল এমনভাবে লিপিবদ্ধ হতে থাকে যেভাবে সে নিজে করত।’ (ইবনে মাজাহ, মিশকাত) অর্থাৎ ইতিকাফের বাইরে থাকতে ইতিকাফকারী যেসব ভালো কাজ আনজাম দিতেন, যা তিনি ইতিকাফ থাকার কারণে করতে পারছেন না, সেসব আমল আগের মতোই লিপিবদ্ধ হতে থাকে। এখন ইতিকাফের কয়েকটি জরুরি মাসালা উল্লেখ করা হবে। ১. ইতিকাফের জন্য জরুরি হলো মুসলমান হওয়া, আকিল, বালেগ ও সুস্থ মস্তিষ্কের অধিকারী হওয়া। সুতরাং কাফির ও মাতাল লোকের ইতিকাফ ঠিক হবে না। নাবালেগ তবে বুঝ হয়েছে এমন বাচ্চা যেরূপ নামাজ, রোজা পালন করতে পারে তেমনি ইতিকাফও পালন করতে পারে। (বাদায়েউস সানায়ে) ২. মা-বোনেরাও ঘরে কোনো স্থান নির্দিষ্ট করে ইতিকাফ করতে পারেন। তবে তার স্বামীর অনুমতি আবশ্যক। সঙ্গে সঙ্গে তাকে হায়েজ ও নেফাস থেকে পাকসাফ থাকতে হবে। ৩. পুরুষরা মসজিদে ইতিকাফ করবেন। ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থান মাসজিদুল হারাম, পরে মাসজিদুন নববি, এরপর মাসজিদুল আকসা, এরপর যে কোনো জামে মসজিদ। জামে মসজিদে ইতিকাফ করা উত্তম। কারণ জুমার জন্য অন্যত্র যেতে হবে না। যেসব শরয়ি মসজিদে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ হয় সে মসজিদে ইতিকাফ করা যায়। (শামি) ৪. ইতিকাফ তিন প্রকার- ক. রমজানের শেষ ১০ দশকের ইতিকাফ সুন্নতে মুয়াক্কাদা আলাল কিফায়া অর্থাৎ মসজিদের মহল্লার কাউকে না কাউকে মসজিদে ইতিকাফ করতে হবে। যদি কোনো মুসল্লি ইতিকাফ না করেন তাহলে সবাই গুনাহগার হবেন। কোনো একজন ইতিকাফ করলে সব মুসল্লি এর গুনাহ থেকে বেঁচে যাবেন। চাঁদের হিসাবে ২১ রমজান রাত থেকে ঈদুল ফিতরের চাঁদ দেখা পর্যন্ত এ ইতিকাফের সময়। কারণ নবী করিম (সা.) প্রতি বছর এ দিনগুলোতেই ইতিকাফ করতেন। খ. ওয়াজিব ইতিকাফ : মানতের ইতিকাফ ওয়াজিব। সুন্নত ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে গেলে তা কাজা করা ওয়াজিব। গ. নফল ইতিকাফ : এ ইতিকাফ মানুষ যে কোনো সময় করতে পারে। অর্থাৎ কিছু সময়ের জন্য ইতিকাফের নিয়তে মসজিদে অবস্থান করা। এর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নেই। যতক্ষণ চায় করতে পারে। রোজারও প্রয়োজন নেই। এ তিন ধরনের ইতিকাফের ভিন্ন ভিন্ন মাসায়েল আছে। ৫. ইতিকাফের সবচেয়ে বড় রুকন ইতিকাফের পুরো সময় মসজিদের সীমানায়ই অবস্থান করা। শরয়ি প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের সীমানা থেকে বাইরে না যাওয়া। শরয়ি প্রয়োজন ছাড়া মসজিদের সীমানার বাইরে সামান্য সময়ও অবস্থান করলে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যায়। ৬. রোজা ইতিকাফের জন্য পূর্বশর্ত। ৭. কোনো ইতিকাফকারী কোনো প্রয়োজনীয়তার কারণে বাইরে গেছেন, কিন্তু প্রয়োজন সেরে বাইরেই কিছুক্ষণ অবস্থান করলেন, তাতেও ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে। (শামি) ৮. ইতিকাফকারী যদি বেহুঁশ বা পাগল হয়ে যায়, জিন-ভূতের আসরের কারণে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে এবং এ অবস্থা যদি এক দিন এক রাত বিদ্যমান থাকে তবে ধারাবাহিকতা খতম হয়ে যাওয়ার কারণে ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাবে।

যদি এক দিন এক রাত পূর্ণ হওয়ার আগেই হুঁশ বা বুদ্ধি ফিরে আসে, তবে ইতিকাফ নষ্ট হবে না। (আলমগিরি) তবে ইতিকাফকারী যদি অসুস্থ হয়ে পড়েন, যার চিকিৎসায় মসজিদের বাইরে যাওয়া ছাড়া সম্ভব নয় তবে তার জন্য ইতিকাফ ভেঙে দেওয়ার অনুমতি আছে। (শামি) বাইরে কোনো লোক ডুবে যাচ্ছে বা আগুনে দগ্ধ হচ্ছে তাকে বাঁচানোর আর কেউ নেই, অনুরূপ কোথাও আগুন লেগেছে, নেভানোর কেউ নেই তবে অন্যের প্রাণ বাঁচানোর এবং আগুন নেভানোর জন্য ইতিকাফকারীর ইতিকাফ ভেঙে দেওয়ার অনুমতি আছে। ইত্যাদি। সুন্নত ইতিকাফ নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর মসজিদের বাইরে চলে আসা জরুরি নয়। তবে ইচ্ছা করলে মসজিদের বাইরে আসতেও পারবেন। বরং উচিত হলো বাকি দিনগুলো নফলের নিয়ত করে মসজিদের মধ্যে অবস্থান করা। এর দ্বারা সুন্নতে মুয়াক্কাদা আদায় হবে না তবে নফল ইতেকাফের সওয়াব পাওয়া যাবে। মসজিদে অবস্থানের কারণে আল্লাহ তাকে সুন্নত ইতিকাফেরও সওয়াব দিয়ে দিতে পারেন। রব্বুল আলামিন ইতিকাফকারীদের সঠিক নিয়মে ইতিকাফ করার তৌফিক দান করুন।

সর্বশেষ খবর