শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা

দেখা মেলে না সবুজের, নেই খেলার মাঠ, আবাসিক এলাকাগুলো এখন বাণিজ্যিক, সামান্য বৃষ্টিতেই জমে পানি, বারো মাসই বায়ুদূষণ, বিশেষজ্ঞদের উৎকণ্ঠা, তবু চাপ ঢাকার ওপর

হাসান ইমন

বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা

কেউ উচ্চ আদালতে বিচারের প্রত্যাশায়, কেউ আবার ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনার আশায়, আবার কেউ ভালো চাকরি পাওয়ার আশায় আসছেন ঢাকায়। অনেকে জটিল রোগের চিকিৎসা নিতে আসছেন। মানুষের ঢাকামুখী স্রোত থামছেই না। একদিকে যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নষ্ট হচ্ছে, বায়ুদূষণের ফলে সৃষ্টি হচ্ছে নানা রোগ। পাবলিক টয়লেটের সংকট, শপিং মল, মার্কেট ও করপোরেট অফিসগুলোয় পার্কিং সুবিধা না থাকায় সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত যানজটে আটকা থাকছে মানুষ। এ শহরের বাসিন্দারা ন্যূনতম নাগরিক সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন। তবে ঢাকামুখী জনস্রোতের কারণে উৎকণ্ঠিত নগর বিশেষজ্ঞরা। তাঁরা বলছেন, ঢাকার প্রধান সমস্যা পরিবেশদূষণ, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণ, জলাবদ্ধতা, যানজট ও গণশৌচাগারের অভাব। যানজটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা মূল্যবান সময় জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছে। এসব কারণে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা।

এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অঞ্চল ও নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ঢাকায় জনঘনত্ব বেশি। এ জনঘনত্ব কমাতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সারা দেশকে নিয়ে পরিকল্পনা করা, জেলাভিত্তিক অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিক্ষা ও চাকরির নিশ্চয়তা বাড়ানো। এ ভারসাম্য নিয়ে এলে মানুষ এলাকা থেকে ঢাকায় আসবে না। আর বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে গণপরিবহনের সংখ্যা বাড়ানো। যানজট কমাতে মেট্রোরেল ও নৌপথ উপযুক্ততা বাড়াতে হবে।’

তিনি বলেন, ‘সরকারি নথিতে রাজধানীর   যেসব এলাকা সবুজ ও জলাভূমি হিসেবে চিহ্নিত ছিল তা একের পর এক দখল হচ্ছে। খাল, নদী, লেক ও উদ্যানের এসব জমি দখলমুক্ত করে নাগরিকের ব্যবহারের জন্য ফিরিয়ে দিলেও ঢাকা বসবাসযোগ্যতার দিক থেকে কিছুটা উন্নতি হবে। ন্যূনতম এ কাজটুকু জরুরি ভিত্তিতে করা উচিত।

ঢাকায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি : বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্স (বিআইপি) থেকে ২০২০ সালে ঢাকার এলাকাভিত্তিক জনসংখ্যার ঘনত্ব নিয়ে একটি জরিপ করা হয়েছে। তাতে বলা হয়- জাতিসংঘের হিসাবে বিশ্বের একটি স্বাস্থ্যকর শহরের প্রতি একর এলাকায় ৭০ থেকে ৮০ জন নাগরিকের বসবাস করা উচিত। এটা সর্বোচ্চ ১২০ জন পর্যন্ত হতে পারে। কিন্তু ঢাকার এক-তৃতীয়াংশ এলাকায় তা ৭০০ থেকে ৮০০ জন। লালবাগ, সবুজবাগ, গেন্ডারিয়াসহ পুরান ঢাকার বেশির ভাগ এলাকায় এ সংখ্যায় মানুষ বসবাস করে। আর সামগ্রিকভাবে তা ৩০০ জন। জনসংখ্যার দিক থেকে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শহর জাপানের টোকিওতে মোট ৩ কোটি ৩০ লাখ মানুষ বাস করে। কিন্তু সেখানে প্রতি একরে ৯০ জনের কম মানুষ বাস করে। সিঙ্গাপুরের মতো বহুতল ভবনসমৃদ্ধ শহরে তা ৮০ জন, সিডনিতে ৫৮ জন ও নিউইয়র্কে ১১২ জন।

কমেছে সবুজায়ন : ঢাকা শহর নিয়ে কয়েকটি গবেষণায়ও বসবাসের জায়গা হিসেবে ঢাকার এ অবনতি ধরা পড়েছে। এসব গবেষণায় ঢাকায় দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধির পাশাপাশি নগর ব্যবস্থাপনায় নানা সমস্যা উঠে এসেছে। একটি সুন্দর ও স্বাস্থ্যকর নগরের জন্য আয়তন অনুযায়ী জনসংখ্যা সীমিত রাখা, গাছপালা ও জলাভূমি রক্ষা করা আর বায়ু-মাটি দূষণ নিয়ন্ত্রণে রাখাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেন বিশেষজ্ঞরা। এ সবগুলো ক্ষেত্রে ঢাকার অবস্থার দ্রুত অবনতি হচ্ছে। মাত্র ১ হাজার ৫২৮ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের এ শহর নিয়ে গত বছর ডিসেম্বরে একটি আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান সাময়িকীতে ‘এনভায়রনমেন্টাল চ্যালেঞ্জেস’ শীর্ষক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে একই ধরনের চিত্র উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে- ১৯৮৯ সালেও ঢাকা শহরের ১৭ শতাংশ এলাকা ছিল সবুজ গাছপালায় ঘেরা। বিশ্বের স্বাস্থ্যকর ও সুন্দর পরিবেশের শহরগুলোয় এ বৈশিষ্ট্য থাকে। কিন্তু ২০২০ সালে অর্থাৎ মাত্র ৩০ বছরে তা মাত্র ২ শতাংশে নেমে এসেছে। মূলত ২০০৯ সাল থেকে ঢাকার সবুজ ও জলাভূমি এলাকা সবচেয়ে দ্রুত হারে কমেছে। শহরের নতুন আবাসিক এলাকাগুলোয় কিছু গাছপালা বাড়লেও তা সামগ্রিক চাহিদার তুলনায় খুবই কম। জনসংখ্যার ব্যাপক চাপ ও শহর ব্যবস্থাপনায় পরিকল্পনা ও সঠিক বাস্তবায়নের অভাবে এ শহরের সামগ্রিক পরিবেশের দ্রুত অবনতি হচ্ছে।

যানজটে ক্ষতি : সড়ক দুর্ঘটনা ও ঢাকার যানজটের কারণে প্রতি বছর ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। এর মধ্যে শুধু সড়ক দুর্ঘটনার কারণে বার্ষিক ৭০ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা জিডিপির ২ শতাংশ। শুধু ঢাকায় ট্রাফিক জ্যামের কারণে বার্ষিক ১ লাখ ৫ হাজার কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়, যা জিডিপির ৩ শতাংশ। দুইয়ে মিলে বছরে মোট ক্ষতি ১ লাখ ৭৫ হাজার কোটি টাকা। এসব তথ্য জানিয়েছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মাহবুব আলম তালুকদার।

দূষণ : রাজধানী ঢাকার পানি, বাতাস ও শব্দ দূষণ মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে এসব দূষণ কয়েক গুণ ছাড়িয়ে গেছে। পরিবেশের অস্বাভাবিক দূষণে বাড়ছে সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ। নানামুখী দূষণে মানুষের শ্রবণশক্তি ব্যাপক হারে হ্রাস পাচ্ছে। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা, অ্যালার্জি সমস্যা বাড়ছে অপ্রতিরোধ্য গতিতে। সেই সঙ্গে বাড়ছে ক্যান্সারের মতো রোগের ঝুঁকিও।

আবাসিক এলাকা এখন বাণিজ্যিক : রাজধানীর ধানমন্ডি, গুলশান, বনানী, বারিধারা ও উত্তরা মডেল টাউন আবাসিক এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও এখন বাণিজ্যিক। এসব এলাকার অধিকাংশ স্থাপনা এখন শপিং মল, মার্কেট, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। আবাসিক এলাকা হিসেবে সড়ক তৈরি হলেও এখন বাণিজ্যিক হওয়ায় সড়কে চাপ বেড়েছে। এতে প্রতিদিনই এসব এলাকায় যানজট তৈরি হচ্ছে।

সামান্য বৃষ্টিতে জলাবদ্ধতা : একটু বৃষ্টি হলেই রাজধানীর অধিকাংশ এলাকার রাস্তায় রাস্তায় হাঁটুসমান পানি জমে যায়। কোথাও কোথাও জলাবদ্ধতা দীর্ঘস্থায়ী রূপ নেয়।

পাবলিক টয়লেট সংকটে ঝুঁকিতে জনস্বাস্থ্য : পাবলিক টয়লেটের সংকট রয়েছে। বেসরকারি সংস্থা ওয়াটার এইড তিন বছর আগে এক জরিপ চালিয়েছিল। তাতে দেখা যায়, ঢাকায় বসবাসরত ও বহিরাগত মিলিয়ে প্রায় ৫০ লাখ মানুষ প্রতিদিন চলাচল করে। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় ১ কোটি হবে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা। রাজধানীতে এতসংখ্যক মানুষের জন্য দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে সচল পাবলিক টয়লেট আছে মাত্র ১০৩টি। পাবলিক টয়লেট সংকটের কারণে রাস্তার পাশে, গাছের আড়াল, এমনকি ফুটপাথেই প্রস্রাব করছে বিভিন্ন গন্তব্যে বের হওয়া মানুষজন। কিন্তু যারা এটি করেন না এবং নারী, শিশু ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তিরা নানা রকম শারীরিক জটিলতায় পড়ছেন এ কারণে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) যুগ্মসম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ধারণক্ষমতার বেশি মানুষ বাস করলে সে এলাকায় গ্যাস, পানি, বিদ্যুৎ, নিষ্কাশনব্যবস্থাসহ সব ধরনের নাগরিক সেবা খাতেই নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।’ তিনি বলেন, ‘রাজধানীতে যানজটের তীব্রতা বাড়ছে। প্রতিদিনই নগরীর বিভিন্ন সড়কে যানজট লেগেই থাকছে। এর অন্যতম কারণ সড়কে গণপরিবহনের সংখ্যা খুবই কম। ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অনেক বেশি। এ ছাড়া ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আধুনিক না হওয়া ও সড়কে অতিরিক্ত মোটরসাইকেল চলাচল দায়ী। আর এগুলোর সঙ্গে শব্দ ও বায়ু দূষণের কারণে বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে ঢাকা।’

সর্বশেষ খবর