বৃহস্পতিবার, ২৮ এপ্রিল, ২০২২ ০০:০০ টা

সমাধান হলো না তেঁতুলতলা মাঠের

♦ এটা মাঠ ছিল না : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ♦ মন্ত্রীর বাড়িতে থানা নির্মাণের প্রস্তাব জাফরুল্লাহর

নিজস্ব প্রতিবেদক

বেশ কয়েক দিন ধরে আন্দোলন চললেও এখনো সমাধান হলো না রাজধানীর কলাবাগানের তেঁতুলতলা মাঠের। এলাকার সব বয়সী মানুষের ফুসফুস হিসেবে পরিচিত এই মাঠটি সম্প্রতি ঢাকা জেলা প্রশাসন কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণের জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশকে বরাদ্দ দিয়েছে। এই বরাদ্দের খবর প্রকাশ হওয়ার পর থেকে মাঠটি রক্ষার জন্য আন্দোলন শুরু করে এলাকাবাসী। ওই মাঠ রক্ষার দাবি নিয়ে গতকাল আন্দোলনরত পরিবেশবিদ ও নাগরিক সমাজের একটি প্রতিনিধি দল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের সঙ্গে তার দফতরে গিয়ে বৈঠক করেন। একই সময়ে থানা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে তেঁতুলতলা মাঠ শিশু-কিশোরদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে সমাবেশ করেছে মানবাধিকার, পরিবেশ আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। অন্যথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঘেরাওসহ কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।

অন্যদিকে কোথাও জায়গা না পেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে থানা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গতকাল তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন স্থাপনের প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিয়ে তিনি এমন প্রস্তাব দেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্য : তেঁতুলতলা মাঠটি কখনো মাঠ নয়, পরিত্যক্ত সম্পত্তি ছিল বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান। মন্ত্রী বলেন, আপাতত থানার জন্য এটাই (তেঁতুলতলা মাঠ) নির্দিষ্ট জায়গা। যথাযথ প্রক্রিয়ায় বরাদ্দ হওয়ায় ওই জায়গাটি এখন পুলিশেরই।

গতকাল সচিবালয়ে নিজ দফতরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাংবাদিকদের এসব কথা বলেন। এর আগে তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন নির্মাণের প্রতিবাদে আন্দোলন করা সমাজকর্মী খুশী কবির, আইনজীবী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থপতি ইকবাল হাবিব, সাংস্কৃতিককর্মী সংগীতা ইমাম স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, যেটাকে তেঁতুলতলা মাঠ বলছেন, সেটা কখনই মাঠ ছিল না। এটা গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিত্যক্ত সম্পত্তি ছিল। ঢাকা শহরে যে নতুন নতুন থানা ভবন হচ্ছে, বেশির ভাগই ভাড়া বাড়িতে। এগুলোকে স্থায়ী জায়গায় নেওয়ার জন্য নিয়ম অনুযায়ী ডিসির (জেলা প্রশাসক) কাছে ঢাকা শহরের কোনো জায়গায় জমি অধিগ্রহণের জন্য বলেছিলাম। কলাবাগানের কোনো জায়গায় দেওয়া যায় কি না, সেটাও বলেছিলাম। জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ করে ওই জায়গাটি বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই জায়গাটির যে মূল্য, তা ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি) জমা দেওয়ার পর ডিসি জায়গাটি হস্তান্তর করেন। তিনি বলেন, আমাদের স্পষ্ট কথা, কলাবাগান থানার জন্য জায়গা প্রয়োজন। সেটার দিকে লক্ষ্য রেখে বলছি, এ জায়গাটা আমরা পেয়েছি। এর চেয়ে যদি ভালো, উপযুক্ত জায়গা ওখানকার মেয়র কিংবা অন্য কেউ ব্যবস্থা করতে পারেন, তখন আমরা সেটা কনসিডার করব। আপাতত থানার জন্য এটাই নির্দিষ্ট জায়গা, সরকারিভাবে এটার ব্যবস্থা হয়েছে। এখন এটা পুলিশের সম্পত্তি।

প্রধানমন্ত্রী বলেছেন মাঠ-জলাশয় রক্ষা করে উন্নয়ন কাজ করতে হবে, এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে মন্ত্রী বলেন, এখানে মনে হয় ২০ কাঠা জমি, খুব বড়ও নয়। ফুটবল খেলার মাঠ এ রকমও কিছু নয়। টেনিস খেলার মাঠ হবে দুটি, সেই রকমও কিছু নয়। এটা খুবই ছোট জায়গা। চিকন-লম্বালম্বি জায়গা, জায়গাটিও সুন্দর কিংবা ভালো অবস্থায় সেই রকমও নয়।

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমার থানা দরকার। সেটা তো পাবলিকের বুঝতে হবে। কারণ আমি যদি পাবলিককে সুরক্ষা বা নিরাপত্তা না দিতে পারি তখনো তো পাবলিক সেন্টিমেন্ট আমাদের বিপক্ষে আসবে। জায়গাটি আমরা নির্বাচন করিনি। জমিটি আমাদের অধিগ্রহণ করে দেওয়া হয়েছে।

আন্দোলনকারীদের সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বৈঠক : তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষার দাবি নিয়ে আন্দোলনকারী পরিবেশবিদ ও নাগরিক সমাজের একটি প্রতিনিধি দল গতকাল সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। এ সময় কলাবাগান থানা ভবন নির্মাণ তেঁতুলতলা মাঠের বদলে অন্য কোনো জায়গায় সরিয়ে নেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন বলে আশ্বাস দিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান।

বৈঠকে নিজেরা করি’র প্রধান নির্বাহী খুশী কবির, বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান, স্থপতি ইকবাল হাবিব ও উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সংগীতা ইমাম উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে খুশী কবির সাংবাদিকদের বলেন, আমরা স্পষ্ট করে বলেছি যে, এখানে যে কাজটা (নির্মাণকাজ) হচ্ছে, তা দ্রুত বন্ধ করাতে চাচ্ছি। আমরা চাচ্ছি যে এবারের ঈদের জামাত যাতে ওখানেই হয়, যেটা সব সময় হয়ে আসছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা করবেন। বিকল্প জায়গা (থানার জন্য) খুঁজবেন। আমাদেরও বলেছেন, বিকল্প জায়গা খুঁজতে সহায়তা করতে।

তেঁতুলতলা মাঠে চলমান নির্মাণকাজ বন্ধে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পুলিশকে নির্দেশ দেবেন কি না, সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তিনি নিজেও খেলার মাঠটার ব্যাপারে অনুভব করছেন। আর এটার বিকল্প অন্য কোনো জায়গায় যাওয়া সংক্রান্ত ব্যাপারে আমার প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে হবে, যেহেতু আমরা টাকা দিয়ে দিয়েছি।

জাফরুল্লাহর প্রস্তাব : কোথাও জায়গা না পেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বাড়িতে থানা ভবন নির্মাণের প্রস্তাব দিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। গতকাল তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন স্থাপনের প্রতিবাদে আয়োজিত প্রতিবাদ সমাবেশে অংশ নিয়ে তিনি এমন প্রস্তাব দেন।

জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, কোথাও জায়গা না পেলে মাননীয় মন্ত্রী আপনার বাড়ির একটু জায়গা দেন। তাতে আপনার সুনাম হবে। আর কোথাও জায়গা না পেলে পাশের বহুতল ভবনের চারতলা-পাঁচতলা নিয়ে নেন, সেখানে থানা করেন। তিনি বলেন, তেঁতুলতলা মাঠ শিশুদের ফুসফুস, বয়স্কদের ফুসফুস, এ ফুসফুস নষ্ট করতে দেওয়া যাবে না।

আন্দোলন অব্যাহত : থানা ভবন নির্মাণের সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসে তেঁতুলতলা মাঠ শিশু-কিশোরদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন মানবাধিকার, পরিবেশ আন্দোলন ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা। অন্যথায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন ঘেরাওসহ কঠোর আন্দোলনের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন তারা।

তেঁতুলতলা মাঠে থানা ভবন স্থাপনের প্রতিবাদে গতকাল আয়োজিত এক প্রতিবাদ সমাবেশে এ হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়। এরপর মাঠের সীমানা ঘেঁষে ১৪টি দেশীয় গাছ রোপণ করা হয়। পাশাপাশি একটি সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন আন্দোলনকারীরা। প্রতিবাদ সমাবেশে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, যারা এখানে খেলে, যারা এ মাঠের প্রকৃত মালিক, তারা এখানে আছে। তারা প্রতিবাদ করছে মাঠ কেন দখল করা হচ্ছে? পুলিশকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, আপনারা যেখানে-সেখানে, যখন খুশি মাঠ নিয়ে নেবেন, পুলিশ যদি এটা প্রতিষ্ঠিত করে ফেলে তাহলে আর মাঠ থাকবে না।

তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সৈয়দা রত্না বলেন, আমি এই মাঠ উন্মুক্ত দেখতে চাই। এই মাঠে এলাকার ছেলেমেয়েরা খেলা করবে। মাঠটি শিশুদের জন্য উন্মুক্ত করাই আমার একমাত্র চাওয়া।

সর্বশেষ খবর