শুক্রবার, ৬ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

উত্তাপ বাড়ছে কমছে উৎপাদনশীলতা

৪৩ বছরে তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি, অতিরিক্ত গরমে নষ্ট ১৮২০ কোটি কর্মঘণ্টা

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

উত্তাপ বাড়ছে কমছে উৎপাদনশীলতা

জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ংকর প্রভাব

গত প্রায় চার দশকের আবহাওয়া ও জলবায়ু পরিবর্তনের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে বিশ্বব্যাংক একটি গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছে, ১৯৭৬ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে বাংলাদেশ আরও উত্তপ্ত হয়েছে। এ সময়ে সারা দেশে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস (০.৫ ডিগ্রি থেকে ০.৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস)। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অতিরিক্ত গরমের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি আনুমানিক ১৪৮ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে, এর ফলে ওই বছর দেশ থেকে হারিয়ে গেছে ১ হাজার ৮২০ কোটি ঘণ্টা কাজের সময়। এটি উৎপাদনশীলতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক আরও বলেছে, সারা দেশের মতো ঢাকাও উত্তপ্ত হয়ে উঠছে। ঢাকায় গড় মাসিক সর্বোচ্চ তাপমাত্রা মার্চ থেকে অক্টোবরের মধ্যে ৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছে। অন্যদিকে এপ্রিল থেকে জুনের গড় তাপমাত্রা ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কাছাকাছি বা তার ওপরে পৌঁছে গেছে। এমনকি ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রামের উত্তাপ আরও বেশি বলেও বিশ্বব্যাংকের গবেষণায় উঠে এসেছে। তারা বলছে, বাংলাদেশে গ্রীষ্মকাল আরও উত্তপ্ত ও দীর্ঘ হচ্ছে।

জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশনের আওতায় বাংলাদেশ সরকারের পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় যে ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যান তৈরি করছে সেখানেও বাংলাদেশের এই উষ্ণতা বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানা গেছে। ন্যাশনাল অ্যাডাপটেশন প্ল্যানের টিম লিডার, ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য, জলবায়ু ও পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, বিশ্বব্যাংকের তথ্যের বস্তুনিষ্ঠতা সম্পর্কে আমি নিশ্চিত নই। আমাদের কাছে যে তথ্য আছে তাতে বরং তাপমাত্রা আরও বেশি বেড়েছে। তিনি বলেন, এটি শুধু বাংলাদেশের একার সমস্যা না, সারা বিশ্বেই তাপমাত্রা বাড়ছে। ক্লাইমেট চেঞ্জ বিষয়ে যে বৈজ্ঞানিক সংস্থা রয়েছে (আইপিসিসি), তাদের হিসাব অনুযায়ী সারা বিশ্বে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০ দশমিক ৮ ডিগ্রি থেকে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে আমরা যে তথ্য-উপাত্ত পেয়েছি তাতে বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ১ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এটি বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রার তুলনায় বেশি।

বিশ্বব্যাংক তাদের রিপোর্টে বলেছে, সারা দেশে ৪৩টি আবহাওয়া কেন্দ্র গত চার দশকের তথ্য সংগ্রহ করে তারা জলবায়ু পরিবর্তনের এই গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। ১৯৭৬ এবং ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে  রেকর্ডকৃত তাপমাত্রার পরিবর্তনগুলো বিশ্লেষণ করা হয়েছে। দেশের দুটি বৃহত্তম শহর ঢাকা এবং চট্টগ্রাম শহরের আবহাওয়ার পরিবর্তনগুলো আলাদাভাবে বিশ্লেষণ করা হয়। আবহাওয়ার তথ্য-উপাত্ত নিয়ে ‘ক্লাইমেট এফলিকশন্স’ শীর্ষক তিন পর্বের এই সিরিজ প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন বিশ্বব্যাংকের ইফফাত মাহমুদ, ওয়ামেক রাজা এবং রাফি হোসেন।

যেভাবে উত্তপ্ত হচ্ছে বাংলাদেশ : জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব স্পষ্ট করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের তিন গবেষক ইফফাত মাহমুদ, ওয়ামেক রাজা এবং রাফি হোসেন তাদের প্রতিবেদনে গত প্রায় চার দশকের তথ্য বিশ্লেষণ করে বলেছেন, ১৯৭৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে গড় তাপমাত্রা ০ দশমিক ৫ ডিগ্রি  সেলসিয়াস থেকে ০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেয়ে বাংলাদেশ আরও গরম হয়ে উঠেছে। সবচেয়ে বেশি বেড়েছে দেশের পূর্বাঞ্চলের তাপমাত্রা (সিলেট-চট্টগ্রাম)। এ অঞ্চলে প্রায় ০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস উষ্ণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলে তাপমাত্রা বেড়েছে ০ দশমিক ৬ ডিগ্রি  সেলসিয়াস থেকে ০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। অন্যদিকে দেশের কেন্দ্রীয় অঞ্চলে ০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের কিছু কম তাপমাত্রা বেড়েছে।

অঞ্চলভিত্তিক উষ্ণতা বৃদ্ধির উদাহরণ দিতে গিয়ে ওই তিন গবেষক জানিয়েছেন, তাপমাত্রার পরিবর্তন বাংলাদেশের দুটি প্রধান মহানগরী ঢাকা এবং চট্টগ্রামের জন্য ভিন্নমাত্রা তৈরি করেছে। ১৯৮০ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ঢাকায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বৃদ্ধি পেলেও চট্টগ্রামের তাপমাত্রা বেড়েছে ০ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। দেশের গড় তাপমাত্রা ১৯৭৬ সালে যেখানে ২৬ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস ছিল, সেটি ২০১৯ সালে বেড়ে প্রায় ২৭ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে উন্নীত হয়েছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের মধ্যে তাপমাত্রার পার্থক্য তুলে ধরে বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঢাকার চেয়ে চট্টগ্রাম আর বেশি উত্তপ্ত। গত ৪৪ বছরে ঢাকার গড় তাপমাত্রা শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেলেও চট্টগ্রামের তাপমাত্রা বেড়েছে প্রায় শূন্য দশমিক ৯ শতাংশ।

কী হতে পারে তাপমাত্রা বাড়লে : গবেষকরা বলছেন, তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে মানুষের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয়। উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ জাতীয় রোগের প্রকোপ বাড়ে। মানুষের মধ্যে বাড়ছে বিষণ্নতা। নষ্ট হচ্ছে কর্মঘণ্টা। সবচেয়ে বড় যে নেতিবাচক প্রভাব-সেটি হচ্ছে জলোচ্ছ্বাস ও ঘূর্ণিঝড়ের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পায়। ১৯৯৯ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ঝুঁকির দিক দিয়ে ছিল ৭ নম্বরে। বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০০০ সাল থেকে আবহাওয়া সংক্রান্ত দুর্যোগের পরিমাণ প্রায় ৪৬  শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৯৯০ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১২৯ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে। গত ২০ বছরে ঘূর্ণিঝড়ে বিশ্বব্যাপী যত মৃত্যু ঘটেছে তার ৬০ শতাংশ ছিল বাংলাদেশে।

তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে মানুষের ওপর যে শারীরিক ও মানসিক চাপ তৈরি হয় তাতে কর্মক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী অতিরিক্ত গরমের কারণে ২০১৯ সালে বাংলাদেশে জনপ্রতি আনুমানিক ১৪৮ কর্মঘণ্টা নষ্ট হয়েছে, যা দেশের মোট ১ হাজার ৮২০ কোটি কর্মঘণ্টা নষ্ট করেছে। অতিরিক্ত গরমের কারণে ২০১৩ সালে বাংলাদেশে নষ্ট হয়েছিল ১ হাজার ৩৩০ কোটি কর্মঘণ্টা।

ড. আইনুন নিশাত জানান, আইপিসিসির তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে যে হারে তাপমাত্রা বাড়ছে-তাতে এখন থেকে আগামী দুই দশকের মধ্যে ঘূর্ণিঝড় জলোচ্ছ্বাসের পরিমাণ বেড়ে যাবে। এর আগে বাংলাদেশে সিডর ও আইলা নামে যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে সেগুলো ছিল ক্যাটাগরি ২ মাত্রার। তবে দুই দশক পরে যেসব ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানতে পারে সেগুলো হবে ক্যাটাগরি ৫ মাত্রার। এ সময় বাতাসের গতিবেগ থাকবে ঘণ্টায় প্রায় ২৫০ কিলোমিটার। এই মাত্রার ঘূর্ণিঝড় এলে বাংলাদেশে যেসব বিদ্যুৎ ও মোবাইল টাওয়ার স্থাপন হয়েছে তার সবগুলোই উড়ে যাবে।

সর্বশেষ খবর