শনিবার, ৭ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

ডলারের বাজার টালমাটাল

♦ ক্রেতাদের ৯৪ থেকে ৯৫ টাকায় কিনতে হচ্ছে ♦ হতে পারে ১০০ টাকাও

আলী রিয়াজ

ডলারের বাজার টালমাটাল

কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না ডলারের দাম। প্রতিদিন বাড়ছে। মূল্যবৃদ্ধির অস্থিরতায় ডলারের বাজার পুরো টালমাটাল। বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নিয়েও ডলারের দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। ৮০ টাকার ডলার এখন ৯২ থেকে ৯৩ টাকায় কিনতে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। সাধারণ ক্রেতা পর্যায়ে কোথাও কোথাও এর চেয়ে বেশি দরে কিনতে হচ্ছে। ডলারের এ টালমাটাল পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে পৌঁছাবে তা কেউ বলতে পারছে না। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এভাবে চলতে থাকলে ১০০ টাকায় পৌঁছাবে ডলারের দর। ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় আমদানি-রপ্তানি খাতে বড় ধরনের প্রভাব পড়ছে। বাজার স্বাভাবিক রাখতে প্রতিদিনই ডলার খোলাবাজারে ছাড়ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ডলারের বিপরীতে টাকার এ দরপতনে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে কিছু সুবিধা পাওয়া গেলেও আমদানি খাতে খরচ বেড়ে যাচ্ছে। ফলে বাড়ছে পণ্যমূল্য। ব্যাংকার ও ব্যবসায়ীরা বলছেন, কোনো কোনো ব্যাংক ডলারের ঘাটতির কারণে এলসি পর্যন্ত খুলতে পারছে না। আন্তব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে বেশি দামে কেউ কেউ ধার করছে ডলার।

সম্প্রতি দেশে আমদানিনির্ভর কয়েকটি পণ্যের দর বৃদ্ধির পেছনেও ডলারের এ টালমাটাল পরিস্থিতিকে অনেকে দায়ী করছেন। অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. জামালউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘ব্যাংকারদের সতর্ক থাকতে হবে এলসি খোলার ক্ষেত্রে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি রাখতে হবে। অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে কোনো কোনো ব্যাংকারও জড়িত থাকতে পারে। সে বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে। এ ছাড়া অপ্রয়োজনীয় ও বিলাসী দ্রব্য আমদানি নিরুৎসাহ করতে হবে। ক্ষেত্রবিশেষ আপাতত এসব দ্রব্য আমদানি বন্ধ রাখতে হবে।’

বিভিন্ন ব্যাংকের লেনদেনে দেখা গেছে, খোলাবাজারে ডলার বিক্রি হচ্ছে ৯৩ টাকায়। রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী, জনতা, অগ্রণী- এ তিন ব্যাংক সর্বশেষ ৯২ টাকা দরে নগদ ডলার বিক্রি করেছে। বেসরকারি ব্যাংকগুলোর বেশির ভাগ ডলার বিক্রি করছে ৯২ টাকা ৫০ পয়সা দরে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের ৫ আগস্ট মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এরপর কয়েক মাস ধরে একই জায়গায় অর্থাৎ ৮৪ টাকায় স্থির ছিল ডলারের দর। এর পরই বাড়তে থাকে ডলারের দর। দেখা গেছে, এ নয় মাসে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে ডলারের দর বেড়েছে প্রায় ২ শতাংশ। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসায় আমদানি অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় চাহিদা বাড়ায় বাজারে ডলারের সংকট দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন অর্থনীতিবিদ ও ব্যাংকাররা। রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করেও দামে লাগাম পরানো যাচ্ছে না। চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় ১০ মাসে (২৭ এপ্রিল পর্যন্ত) ৪৬০ কোটি (৪.৬০ বিলিয়ন) ডলার বিক্রি করেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর পরও বাজারের অস্থিরতা কাটছে না। বেড়েই চলেছে যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর। এদিকে গত মাসে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) মার্চ-এপ্রিল মেয়াদের ২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন (২২৪ কোটি) ডলারের আমদানি বিল পরিশোধ করেছে। এর আগে কখনই আকুর এত বেশি বিল শোধ করেনি বাংলাদেশ। এর ফলে অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এ সূচক বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪১ দশমিক ৯০ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। যা গত দেড় বছরের মধ্যে সবচেয়ে কম। এর আগে ২০২০ সালের নভেম্বরে রিজার্ভের পরিমাণ ছিল ৪১ দশমিক ২৬ বিলিয়ন ডলার। ব্যবসায়ীদের আশঙ্কা, এ কারণে ডলারের ভয়াবহ সংকটের দিকে যেতে পারে দেশ। যদিও ঈদ কেন্দ্র করে এপ্রিলে ২০০ কোটি ৯৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের সূত্রে জানা গেছে, ২৮ এপ্রিল পর্যন্ত ২০০ কো?টি ৯৫ লাখ ডলার রেমিট্যান্স এসেছে। যা আগের মাসের চেয়ে প্রায় ১৫ কোটি ডলার বেশি। মার্চে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৮৫ কোটি ৯৭ লাখ ডলার। তবে ঘাটতি মেটাতে এ পরিমাণ খুব বেশি নয়।

জানা গেছে, করোনা মহামারির কারণে ২০২০-২১ অর্থবছর জুড়ে আমদানি বেশ কমে যায়। কিন্তু প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়ে উল্লম্ফন দেখা যায়। সে কারণে বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে যায়। সে পরিস্থিতিতে ডলারের দর ধরে রাখতে গত অর্থবছরে রেকর্ড প্রায় ৮ বিলিয়ন ডলার কিনেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম মাস জুলাইয়েও ২০ কোটি ৫০ লাখ ডলার কেনা হয়। কিন্তু আগস্ট থেকে দেখা যায় উল্টো চিত্র। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করায় লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে শুরু করে আমদানি। রপ্তানি বাড়লেও কমতে থাকে রেমিট্যান্স। বিদেশি মুদ্রার সঞ্চয়ন বা রিজার্ভও কমতে থাকে। বাজারে ডলারের চাহিদা বেড়ে যায়। বাড়তে থাকে দাম। বাজার স্থিতিশীল রাখতে আগস্টে ডলার বিক্রি শুরু করে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা এখনো অব্যাহত রয়েছে। কর্মকর্তারা জানান, আমদানি ঋণপত্র নিষ্পত্তি করতে ব্যাংকগুলো হিমশিম খাচ্ছে। আমদানি ব্যয় অনেক বেড়েছে। এ ছাড়া খাদ্য ও অবকাঠামো নির্মাণ পর্যায়ে আমদানি ব্যয়ও হঠাৎ বেড়ে গেছে। এর প্রভাব পড়েছে পুরো ডলার বাজারে।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক মুখপাত্র মো. সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ডলারের দাম বাড়ছে। সম্প্রতি এলসির চাহিদা অনেক বেড়েছে। দেশে প্রচুর পণ্য আমদানি হচ্ছে। এ কারণে ডলারের ওপর চাপও বাড়ছে। তবে আমরা সচেতন রয়েছি। ডলারের দাম সহনীয় রাখতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ইতোমধ্যে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, খাদ্যপণ্য বা প্রয়োজনীয় পণ্যের বাইরে কোনো বিলাসী দ্রব্য আমদানি করতে হলে ২৫ শতাংশ মার্জিন দিতে হবে। এতে ডলারের ওপর বাড়তি চাপ নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ঈদে রেমিট্যান্স বেড়েছে। রপ্তানিও কিছুটা বাড়বে বলে আমরা আশা করছি। ফলে দ্রুত ডলারের দাম ফের কমে আসবে।’

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর