শনিবার, ৭ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

নিত্যপণ্যের বিশ্ববাজারে যুদ্ধের প্রভাব

♦ সয়াবিন তেলের লিটার ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধির আশঙ্কা ♦ জটিল পরিস্থিতি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন এফএও

রুহুল আমিন রাসেল

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বিশ্ববাজারে নজিরবিহীনভাবে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। এ অবস্থায় বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য রেকর্ড ও জটিল বাজার পরিস্থিতি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএও।  চলমান যুদ্ধের ভয়াবহ প্রভাবে বিশ্ববাজারে প্রতিনিয়ত দাম বাড়ছে গম, ভোজ্য তেল ও জ্বালানি তেলের। ফলে দেশীয় বাজারে প্রতি লিটার বোতলজাত সয়াবিন তেলের দাম বেড়ে হয়েছে ১৯৮ টাকা। এই দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পাওয়ার আশঙ্কা করছেন ভোজ্য তেলের পাইকারি ব্যবসায়ীরা। তবে নিত্যপণ্যের সংকট উত্তরণে ব্যবসায়িক উদ্যোগের সঙ্গে কূটনৈতিক উদ্যোগ চান ব্যবসায়ীরা। পাশাপাশি কৃত্রিম সংকট ও কারসাজি ঠেকাতে বাজারে নজরদারি বাড়ানোর তাগিদ অংশীজনদের।

ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন- এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বব্যাপী ভোজ্য তেল, জ্বালানি তেল ও গমসহ কিছু নিত্যপ্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়ছে। উন্নত বিশ্বের অনেক দেশ যেমন রাশিয়া ও ইউক্রেন থেকে গম ও তেল আমদানি করে, তেমনি উন্নয়নশীল অনেক দেশও, তাদের ওপর নির্ভরশীল ছিল। এখন যুদ্ধের কারণে রাশিয়া ও ইউক্রেনের সঙ্গে আমদানি বাণিজ্য কার্যত বন্ধ রয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে বিশ্ববাজারে।

এই সংকটের সমাধান কী হতে পারে, এমন প্রশ্নের জবাবে ব্যবসায়ীদের এই শীর্ষ নেতা বলেন, আমাদের প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যসমূহ নতুন নতুন দেশ থেকে আমদানি করতে হবে। যেসব দেশ আমাদের দীর্ঘমেয়াদে গম, ভোজ্য তেল ও জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে সক্ষম হবে, তাদের সঙ্গে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্রাজিল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নতুন উৎস হতে পারে। এ জন্য ব্যবসায়িক উদ্যোগের সঙ্গে ভালো কূটনৈতিক উদ্যোগ জরুরি। পাশাপাশি পণ্য সরবরাহ ব্যবস্থা ধরে রাখতে করহার সহনীয় পর্যায়ে রাখতে হবে।

এদিকে প্রাপ্ত তথ্য বলছে, যুদ্ধবিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সামাল দিতে ইউক্রেন সূর্যমুখী তেল, গম, ওটস এবং গবাদি পশু রপ্তানি সীমিত করেছে। রাশিয়া অন্য দেশের কাছে সার, চিনি ও শস্য বিক্রি নিষিদ্ধ করেছে। রাশিয়া বিশ্বের বৃহত্তম গম, অপরিশোধিত লোহা, নিকেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস রপ্তানিকারক দেশ। দেশটি বিশ্বে কয়লা, অপরিশোধিত তেল এবং সারের প্রধান সরবরাহকারীদের অন্যতম। অন্যদিকে ইউক্রেন সূর্যমুখী তেলের সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক এবং গম, অপরিশোধিত লোহা, ভুট্টা এবং বার্লির বড় রপ্তানিকারক দেশ।

জানা গেছে, রোজার ঈদের আগে হঠাৎ করেই খুচরা বাজার থেকে সয়াবিন তেল উধাও হয়ে যায়। বিশ্ববাজারের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দাম সমন্বয় করতে না পারার কারণেই মূলত দেশে ভোজ্য তেল নিয়ে এমন ঘটনা ঘটেছে। দেড় মাস পর গত বৃহস্পতিবার বিশ্ববাজারের সঙ্গে ভোজ্য তেলের দাম সমন্বয় করা হয়েছে। ফলে একবারেই প্রতি লিটার বোতলজাত ও খোলা সয়াবিন তেলের দাম ৩৮ থেকে ৪৪ টাকা পর্যন্ত বাড়াতে হয়েছে। নতুন দর অনুযায়ী, খোলা সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৮০ টাকা, যা এত দিন ১৪০ টাকা ছিল। বোতলজাত সয়াবিন তেল প্রতি লিটার ১৬০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ১৯৮ টাকা করা হয়েছে। ৫ লিটারের বোতলের দাম হবে ৯৮৫ টাকা। এর সঙ্গে ভোজ্য তেলের দাম সহনীয় রাখতে সরকার উৎপাদন ও সরবরাহ পর্যায়ে মূল্য সংযোজন কর-মূসক বা ভ্যাট প্রত্যাহার করেছে, আমদানিতে করও কমিয়েছে।

এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি হাজী মো. গোলাম মাওলা গতকাল বলেন, বাংলাদেশে সবেমাত্র প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ১৯৮ টাকা হয়েছে। কিন্তু প্রতিবেশী ভারতে আরও দুই মাস আগে প্রতি লিটার সয়াবিন তেল ২০০ রুপিতে বিক্রি শুরু হয়েছে (বাংলাদেশি ২২৫ টাকা)। বরং বাংলাদেশে দেরিতে দাম বেড়েছে। চলমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে আগামীতে প্রতি লিটার সয়াবিন তেলের দাম ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা হতে পারে।

এই ভোজ্য তেল ব্যবসায়ী নেতা আরও বলেন, বিশ্ববাজারে ভোজ্য তেলের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে পণ্য পরিবহন খরচও অনেক বেড়েছে। আগে যে পরিমাণ পণ্য আনতে ১ হাজার টাকা জাহাজ ভাড়া গুনতে হতো, এখন সেই পণ্য আমদানিতে ৫ হাজার টাকা খরচ করতে হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ভ্যাট-কর প্রত্যাহার করলেও, দাম কমবে না। বিশ্ববাজারে দাম বাড়লে, দেশেও বাড়বে। এটা মেনে নিতে হবে। ব্যবসায়ীদের গালি দিয়ে সমস্যার সমাধান হবে না। বিভিন্ন দেশ করোনার সময় তেলের মজুদ করে রেখেছে। এই সংকট কাটাতে বাংলাদেশের আরও আগে প্রস্তুতি নেওয়ার দরকার ছিল।

অর্থনীতিবিদদের সংগঠন বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, যুদ্ধসহ যে কোনো কারণে বিশ্ববাজারে পণ্যের দাম বাড়লে, আমদানিকারক দেশ হিসেবে আমাদের কিছু করার নেই। তবে কেউ যাতে কোনো কৃত্রিম সংকট তৈরি করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। কারসাজি ঠেকাতে বাজারে নজরদারি বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রতিযোগিতা কমিশন ও ভোক্তা অধিদফতরকে সক্রিয় করতে হবে। ব্যাংকগুলোকে এলসি বা ঋণপত্র খোলার ক্ষেত্রে সজাগ রাখতে হবে। আমদানি হওয়া পণ্যের মূল্য নির্ধারণ প্রক্রিয়া যেন স্বচ্ছ ও সঠিক হয়, তাও খতিয়ে দেখতে হবে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের তথ্য বলছে, শিল্প সুবিধায় ২০২১ সালে বিশ্ববাজার থেকে ১৮ লাখ ১৮ হাজার টন ভোজ্য তেল আমদানি করেছে বাংলাদেশ। চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে আমদানি হওয়া এই তেলের মূল্য ১৭ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা। অন্যদিকে পাম ও সয়াবিন তেল পরিশোধিত ও অপরিশোধিত আকারে আমদানি হয়। অপরিশোধিত অবস্থায় আমদানি করা সয়াবিন তেল স্থানীয়ভাবে পরিশোধনের পর বাজারজাত করা হয়। তবে দেশের বাজারে ব্যবহার ও আমদানি বেশি হয় প্রধানত পরিশোধিত পাম অয়েল।

তথ্য বলছে, ২০২১ সালে সবচেয়ে বেশি শুল্কায়ন হয়েছে ১২ লাখ ১৬ হাজার টন পরিশোধিত (রিফাইন্ড) পাম অয়েল। এর পরই রয়েছে অপরিশোধিত (ক্রুড) সয়াবিন ৬ লাখ ৩ হাজার টন। আমদানি হওয়া পাম অয়েলের ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়া এ দুই দেশের ওপর নির্ভরতা রয়েছে দেশের ব্যবসায়ীদের। তবে সয়াবিন আসছে ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনা থেকে।

এদিকে বিশ্বব্যাপী খাদ্যমূল্য রেকর্ড ও জটিল বাজার পরিস্থিতি এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা বা এফএও। সংস্থাটির সর্বশেষ প্রকাশিত খাদ্যমূল্যের সূচকে এই উদ্বেগ প্রকাশ করে বলা হয়, গত মার্চ মাসে বিশ্বে খাদ্যমূল্য রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছানোর পর এপ্রিলে কিছুটা কমেছে। তবে জটিল বাজার পরিস্থিতির কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ থেকেই গেছে। গত এপ্রিলের খাদ্যমূল্যের যে সূচক এফএও প্রকাশ করেছে, তাতে গড় পয়েন্ট হয়েছে ১৫৮ দশমিক ৫। মার্চ মাসের গড় পয়েন্ট ছিল রেকর্ড ১৫৯ দশমিক ৭।

এফএওর প্রধান অর্থনীতিবিদ ম্যাক্সিমো টোরেরো কুলেন মনে করেন, খাদ্যের দাম সাম্প্রতিক রেকর্ড উচ্চতার কাছাকাছি রয়েছে। যার পেছনে বড় ভূমিকা রেখেছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ নিয়ে আতঙ্ক এবং সরবরাহ সংকট। এফএও বলছে, যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেনের বন্দরের কাজ বন্ধ থাকা এবং খাদ্যশস্য পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে উদ্বেগের কারণে গমের দাম বেড়েছে। যদিও ভারত থেকে বড় চালান এবং রাশিয়া থেকে প্রত্যাশার বেশি রপ্তানির কারণে সরবরাহে ততটা সংকট হয়নি। চাহিদা কমে পাম, সূর্যমুখী ও সয়াবিন তেলের দাম কমার কারণে এপ্রিলে উদ্ভিজ্জ তেলের দামের সূচক ৫ দশমিক ৭ শতাংশ নিচে নেমেছে। তবে চিনির দাম ৩ দশমিক ৩ শতাংশ, মাংসের দাম ২ দশমিক ২ শতাংশ বেড়েছে। দুগ্ধজাত পণ্যের সূচক দশমিক ৯ শতাংশ বেড়েছে।

এফএও তাদের নতুন প্রাক্কলনে বলেছে, ২০২২ সালের গম উৎপাদনের পরিমাণ হতে পারে ৭৮২ মিলিয়ন টন, যা আগের প্রাক্কলনের চেয়ে ২ মিলিয়ন টন কম। গম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা কমানোর মূল কারণ হলো, যুদ্ধের মধ্যে ইউক্রেনের গম উৎপাদন ২০ শতাংশ কমে যাওয়ার শঙ্কা। পাশাপাশি উত্তর আফ্রিকায় খরার কারণে মরক্কোতেও উৎপাদন কমতে পারে। মার্চে সংস্থাটি সতর্ক করেছিল, ইউক্রেনের সংঘাতের ফলে খাদ্যের দাম ২০ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে, যা অপুষ্টি বাড়ানোর ঝুঁকি তৈরি করবে।

ওয়াশিংটন পোস্টের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে, আগামী ১৮ মাস ইউরোপের জন্য কঠিন একটি সময় হতে চলেছে। কারখানায় জ্বালানি সরবরাহ থেকে শুরু করে ঘর গরম রাখা এমনকি বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলো চালু রাখতে লড়াই করছে বিভিন্ন দেশ। রাশিয়া সরবরাহ বন্ধ করে দিলে আসন্ন শীতে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ঠেকানোর মতো বিকল্প কারও হাতেই নেই। চলতি মাসেই জার্মানির কেন্দ্রীয় ব্যাংক সতর্ক করেছে, যুদ্ধ অব্যাহত থাকলে দেশটির অর্থনীতি ২ শতাংশ পর্যন্ত সংকুচিত হতে পারে।

এসঅ্যান্ডপি গ্লোবালের ভাইস চেয়ারম্যান ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ড্যানিয়েল ইয়ারগিনের মতে, রাশিয়া আকস্মিকভাবে মুখ ফিরিয়ে নেওয়ায় হঠাৎ করেই বৈশ্বিক জ্বালানি বাজারের পুনর্বিন্যাস ঘটছে। ইউরোপকে এখন জোড়াতালি দিয়ে গ্যাস সংগ্রহ করতে হবে। ইতালি আলজেরিয়া থেকে, বুলগেরিয়া গ্রিস থেকে এবং পোল্যান্ড নরওয়ে থেকে দীর্ঘ পরিকল্পিত পাইপলাইন সম্প্রসারণের মাধ্যমে এলএনজি সরবরাহের দিকে ঝুঁকবে। ইউরোপের অর্থনীতির চালিকাশক্তি জার্মানি এ রকম একটি সময়ের মুখোমুখি হতে প্রস্তুত ছিল না। ইউক্রেন আক্রমণের আগে জার্মানির অর্ধেকের বেশি প্রাকৃতিক গ্যাস রাশিয়া থেকে আসত। রাশিয়ার গ্যাস ছাড়া পুরোপুরি চলার মতো অবস্থা জার্মানির নেই।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর