মঙ্গলবার, ১০ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

ফের আলোচনায় ইভিএমে ভোট

আপাতত ১০০ আসনে প্রস্তুতি আছে, ৩০০টিতে ভোট করতে লাগবে সাড়ে ৪ লাখ ইভিএম হাতে দেড় লাখ, ইভিএম পরীক্ষায় রাজনৈতিক দলের আইটি দক্ষদের আমন্ত্রণ জানাবে ইসি

গোলাম রাব্বানী

ফের আলোচনায় ইভিএমে ভোট

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে ফের আলোচনায় রয়েছে ইলেকট্র্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) ভোট গ্রহণ। নির্বাচন কমিশন বলছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রায় ১০০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের সক্ষমতা রয়েছে। তবে দলগুলোর আস্থা অর্জন হলে আরও বেশি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের চিন্তাও রয়েছে কমিশনের। এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ইভিএমে ভোট গ্রহণ নিয়েই বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। গত শনিবার গণভবনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সভায় আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ইভিএম পদ্ধতিতে। এ নির্বাচনে আমরা সব দলের অংশগ্রহণ চাই।

রবিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানান, ইভিএমে তো পরের ব্যাপার। আওয়ামী লীগের সরকার পদত্যাগ এবং সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে নির্বাচনের কোনো প্রশ্নই উঠতে পারে না।  কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়েই সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং আস্থা অর্জনে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। ধারাবাহিক সংলাপে বিভিন্ন পেশাজীবীও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে-বিপক্ষে মত দিচ্ছেন। এ বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও সংলাপ করবে ইসি। তবে সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আগামী দেড় বছরের মধ্যে প্রশিক্ষণ, দক্ষ জনবল তৈরি, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দসহ সার্বিক কাজও গুছিয়ে নিতে হবে সাংবিধানিক সংস্থাটিকে। ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। বর্তমানে ইসির হাতে যে পরিমাণ ইভিএম সংরক্ষিত আছে, তা দিয়ে প্রায় ১০০ আসনে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে, সেই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ইসির হাতে এখনো পর্যাপ্ত সময় রয়েছে। তারা জানান, ১১ কোটি ৩২ লাখেরও বেশি ভোটারের জন্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪২-৪৫ হাজারেরও বেশি ভোট কেন্দ্র থাকতে পারে। ভোট কক্ষ থাকবে প্রায় আড়াই লাখেরও বেশি। ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে সাড়ে ৪ লাখ ইভিএম প্রয়োজন হবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. আহসান হাবিব খান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইভিএমে ভোট গ্রহণ প্রক্রিয়া স্বচ্ছ ও ত্রুটিমুক্ত, কোনো প্রকার অসাধুতা অবলম্বন করার সুযোগ নেই। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা অর্জনে ইসি সচেষ্ট এবং এ সংক্রান্ত জাতীয় কারিগরি কমিটির সঙ্গে আলোচনায় বসা হবে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের আইটিতে দক্ষ প্রকৌশলীদের ইভিএম পরিদর্শনের জন্য আমন্ত্রণ জানানো হবে। তিনি বলেন, এ মুহূর্তে প্রায় ১০০ আসনে ইভিএম ব্যবহারের সক্ষমতা আমাদের রয়েছে। আরও বেশি আসনে ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কমিশন মিটিংয়ে আলোচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।

সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার মো. আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, সংলাপে ইভিএমের পক্ষে-বিপক্ষে অনেকেই মতামত দিয়েছেন। আমরা এগুলো পর্যালোচনা করছি। আমাদের ইভিএম ভারতের ইভিএমের চেয়ে অনেক আপডেটেড এবং মানের দিকেও অনেক উন্নত। এটা অবিশ্বাস করার মতো না। ভারত যেভাবে অবিশ্বাসটা কাটিয়ে উঠেছে, আমরাও সেভাবে কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করব। তিনি বলেন, ইভিএমে যদি আস্থার জায়গা ঠিক হয়ে যায়, তাহলে ১০০ বা ২০০ অথবা ২৫০ আসনে ভোট করা সম্ভব। ৩০০ আসনেই যে করতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তবে আস্থার জায়গা তৈরি হলে এ সময়ে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ সম্ভব-অসম্ভব কি না কিছুই বলতে পারছি না। রাজনৈতিক দলগুলোর আস্থা তৈরি হলেই আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারব। তাছাড়া সব আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে প্রকল্প নিতে হবে। তারপর ইভিএম কেনা সম্ভব হবে। যদি আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে আমাদের কাছে যত ইভিএম আছে, সেগুলো সবই ব্যবহার করা সম্ভব।

এ বিষয়ে ইভিএম প্রকল্পের পরিচালক সৈয়দ রাকিবুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইসির কাছে এখন মোট দেড় লাখ ইভিএম আছে। ইভিএম রাখার স্থান সংকুলনায় না হওয়ায় ৮০ হাজার ইভিএম বিএমটিএফে (সেনাবাহিনীর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি) আছে। বাকিগুলো ইসি সচিবালয় ও দেশের বিভিন্ন জায়গায় ইসির কার্যালয়গুলোতে আছে। ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আরও প্রায় ৩ লাখ ইভিএম প্রয়োজন হবে। নির্বাচন কমিশন যথাসময়ে সিদ্ধান্ত দিলে সারা দেশে আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব হবে। প্রয়োজনীয় লোকবল প্রশিক্ষণ দেওয়াও সম্ভব হবে। এ জন্য মোট ৫ লাখের মতো প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন হবে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৪৫ জনকে (প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে।

২০১০ সালে ইভিএম চালুর পর স্থানীয়ভাবে তা অব্যাহত থাকে। এটিএম শামসুল হুদা কমিশন ওই ইভিএম স্থানীয় নির্বাচনে সিটি করপোরেশনে বড় পরিসরে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সংসদে ব্যবহার করে যেতে পারেননি। ২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসি আগের ইভিএমকে অনেকটা অকেজো অবস্থায় ফেলে গিয়েছিল, সিটি নির্বাচনেও হোঁচট খায় ইভিএম ব্যবহার। কে এম নূরুল হুদা কমিশন নতুন করে ইভিএম নিয়ে এগোয়। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আইন সংশোধন করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি সংসদীয় আসনেও ইভিএম ব্যবহার করে। এ ধারাবাহিকতায় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন ইভিএম নিয়ে এগোতে চাইছে। 

ইসির সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আগামী সব নির্বাচনেই ইভিএম ব্যবহারের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। বর্তমানে স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার বাড়ানো হচ্ছে। বিগত ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ সংসদ নির্বাচনে পরীক্ষামূলকভাবে ছয়টি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণ করে সফলতা পায় ইসি। এরপর উপজেলা ও পৌরসভা নির্বাচনে ব্যাপক ব্যবহারে যায় কমিশন। মাঝে বেশ কয়েকটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন, সিটি নির্বাচনেও ইভিএমে ভোট নেওয়া হয়। সর্বশেষ গত ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ সিটি নির্বাচনে পুরোপুরি ইভিএমে ভোট গ্রহণ করা হয়। আসন্ন কুমিল্লা সিটি নির্বাচনেও ইভিএম ব্যবহার করা হবে। ২০১০ সালের ১৭ জুন দেশে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ শুরু করে বিগত ড. এ টি এম শামসুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন। পরবর্তীকালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদের নেতৃত্বাধীন কমিশন রাজশাহী সিটি নির্বাচনে ২০১৫ সালের ১৫ জুন ভোট নিতে গেলে একটি মেশিন বিকল হয়ে পড়ে। সেই মেশিন পরে আর ঠিক করতে পারেনি কমিশন। ওই মেশিনগুলো নষ্ট করে নতুনভাবে আরও উন্নত প্রযুক্তির ইভিএম তৈরির নীতিগত সিদ্ধান্ত নেন তারা। কে এম নূরুল হুদার কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই সিদ্ধান্তের ধারাবাহিকতায় নতুন ইভিএম সংগ্রহ করে। এ জন্য হাতে নেওয়া হয় একটি প্রকল্প। সেই প্রকল্পের অধীনে বর্তমানে ইভিএম সংগ্রহ চলছে। আগামী বছরের জুনে এ প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হবে। ইসির এক কার্যবিবরণীতে বলা হয়েছে- ইভিএম প্রকল্পের মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮২৫ কোটি ৩৪ লাখ টাকা।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর