বৃহস্পতিবার, ১২ মে, ২০২২ ০০:০০ টা
বিশেষ সাক্ষাৎকারে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি

ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা ও দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সহায়তা পাবে দেশি শিল্প

রুকনুজ্জামান অঞ্জন

ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা ও দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে সহায়তা পাবে দেশি শিল্প

ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা ও দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে আমদানিনির্ভরতা কমানোর পাশাপাশি দেশি শিল্পে সহায়তার ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। তিনি বলেছেন, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের পর পণ্য আমদানিতে আরও সমস্যা হতে পারে। আমরা ভোজ্য তেলসহ খাদ্যপণ্য আমদানিতে বিকল্প উৎসের সন্ধান করছি। তবে একই সঙ্গে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বাড়ানোর জন্য দেশি শিল্পের সক্ষমতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে।’ মন্ত্রী বলেন, উৎপাদন ও সরবরাহ এ দুটি খাত স্বাভাবিক রাখাই এখন মূল লক্ষ্য। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে যে চ্যালেঞ্জ সৃষ্টি হয়েছে তা মোকাবিলা করে কীভাবে সামগ্রিক ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করা যায় সে সম্পর্কে সরকারের উদ্যোগের বিষয়গুলো বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে তুলে ধরেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। গতকাল দুপুরে সচিবালয়ে তিনি এ সাক্ষাৎকারটি দেন। এক প্রশ্নের জবাবে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা করার জন্য দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বেই এক ধরনের অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। কিন্তু এসব অনিশ্চয়তার পরও দেশের শিল্পকারখানাগুলো উৎপাদন অব্যাহত রেখেছে। আমাদের কাছে বিদেশি বিনিয়োগের আকর্ষণীয় প্রস্তাব আসছে। যুক্তরাষ্ট্র-কানাডার মতো উন্নত দেশগুলো এখন বাংলাদেশে বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে।’

টিপু মুনশি জানান, ‘যুক্তরাষ্ট্রের একটি ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে এসেছে। তারা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেছেন। আমাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। দেশের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সভা-সেমিনার করে তারা তাদের বিনিয়োগ প্রস্তাবগুলো তুলে ধরছেন। বাংলাদেশে বিনিয়োগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল দেওয়ার বিষয়েও আলোচনা চলছে।’

মন্ত্রী বলেন, ‘কানাডার হাইকমিশনার আজ (বুধবার) আমার সঙ্গে বৈঠক করেছেন। তিনি (হাইকমিশনার) বলেছেন, তাঁর দেশ বাংলাদেশের সঙ্গে বাণিজ্য ও বিনিয়োগ বাড়াতে আগ্রহী। সয়াবিন ও পাম তেলের বিকল্প হিসেবে ক্যানোলা তেল রপ্তানির বিষয়েও তিনি আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কানাডায় প্রচুর ক্যানোলা উৎপাদন হয়। স্বাস্থ্যসম্মত ভোজ্য তেল ক্যানোলা বাংলাদেশে জনপ্রিয় হতে পারে। আমরা বলেছি বাংলাদেশের স্পেশাল ইকোনমিক জোনে কানাডা ক্যানোলা ভোজ্য তেল ফ্যাক্টরি স্থাপন করতে পারে। তারা দেশি শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ বিনিয়োগেও যেতে পারে। ক্যানোলা তেলের ফ্যাক্টরি করে উৎপাদন করলে বাংলাদেশের চাহিদা মিটিয়ে পাশের দেশে রপ্তানি করেও লাভবান হতে পারেন তারা।’ মন্ত্রী জানান, তিনি খুব শিগগিরই কানাডা যাবেন। সেখানে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। তাঁদের বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানাবেন যাতে কানাডার উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে বিনিয়োগে এগিয়ে আসেন। মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের দেশে বিনিয়োগের এখন সুযোগ এসেছে। সে সুযোগটা সবার কাজে লাগানো উচিত।’

এ প্রসঙ্গে টিপু মুনশি আরও বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উদ্যোগে দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ১০০ স্পেশাল ইকোনমিক জোন গড়ে তোলার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। বেশ কয়েকটির কাজ শেষ পর্যায়ে। বাংলাদেশ সরকার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বেশ কিছু সুযোগ-সুবিধার প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এসব ইকোনমিক জোনে বিদেশি বিনিয়োগের পাশাপাশি দেশি শিল্পকারখানা স্থাপন হলে ব্যবসা-বাণিজ্য আরও চাঙা হয়ে উঠবে বলে মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। যুদ্ধ, মহামারি ছাড়াও বাংলাদেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের সামনে রয়েছে এলডিসি থেকে উত্তরণের চ্যালেঞ্জ। এ উত্তরণ সম্পূর্ণ হলে দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো আর উন্নত বিশ্বে শুল্ক ও কোটা মুক্ত বাজার সুবিধা পাবে না। ফলে বিশ্বের বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে টিকে থাকতে হবে দেশি শিল্পকে। এ অবস্থায় দেশের শিল্প খাতকে সুরক্ষা দিতে সক্ষমতা বাড়ানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান বাণিজ্যমন্ত্রী। এলডিসি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে- এ প্রশ্নের জবাবে টিপু মুনশি বলেন, ‘উত্তরণের জন্য আমরা তৈরি হচ্ছি। আমাদের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। বিশেষ করে আমাদের দেশি শিল্পপণ্যের গুণগত মান বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে, যাতে তারা আন্তর্জাতিক বাজারে বিশ্বখ্যাত শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারে। এজন্য দেশি শিল্পকে সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে বেশ কিছু প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়েছে।’

টিপু মুনশি বলেন, বাংলাদেশ তৈরি পোশাক রপ্তানিতে বিশে^ দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে। বাংলাদেশ এখন উন্নত ও আধুনিক পদ্ধতিতে পোশাক তৈরি ও রপ্তানি করছে। ইউএস গ্রিন বিল্ডিং কাউন্সিল বিশে^র ১৫৭টি ফ্যাক্টরিকে লিড গ্রিন ফ্যাক্টরির সার্টিফিকেট দিয়েছে, এর মধ্যে প্রথম ১০টির নয়টিই বাংলাদেশে। বাংলাদেশে এখন নিরাপদ ও কর্মবান্ধব পরিবেশে শ্রমিকরা কাজ করছেন। শ্রম আইন সংশোধন করে শ্রমিকদের অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এ সবই দেশের শিল্প খাতের সক্ষমতার উদাহরণ বলে মনে করেন বাণিজ্যমন্ত্রী।

টিপু মুনশি বলেন, ‘দক্ষতা বাড়ানোর পাশাপাশি বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে এফটিএ (মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি) ও পিটিএ (অগ্রাধিকার বাণিজ্য চুক্তি) করার বিষয়ে আলোচনা চলছে। পাশাপাশি যেটা আমরা চাইছি যে ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণের পর যাতে আমাদের প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় দেওয়া হয়, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সে সময়টা যত দূর সম্ভব বাড়িয়ে নিতে।’ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্যের সম্ভাবনা নিয়ে জানতে চাইলে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আমেরিকার সঙ্গে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে আমাদের আরও অপেক্ষা করতে হবে। এর আগে আমাদের দেখতে হবে যে রাজস্ব আয়ে কী ধরনের প্রভাব পড়ে। সবকিছু বিবেচনা করেই আমরা এগোচ্ছি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ বিষয়ে আমাদের প্রত্যক্ষ নির্দেশনা দিচ্ছেন।’ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘গ্লোবাল মার্কেটে পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। সে দামের সঙ্গে আমাদের সমন্বয় করতে হচ্ছে। কারণ বেসরকারি খাতের যারা উদ্যোক্তা তারা আমদানি করেই দেশের বাজারে পণ্য সরবরাহ করেন। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয় রেখে দেশে দাম ঠিক করতে হয়। তার পরও আমরা চাই যেন পণ্যের সরবরাহ স্বাভাবিক থাকে।’ মন্ত্রী বলেন, এ মুহূর্তে আন্তর্জাতিক বাজারে সবচেয়ে বেশি সংকট সৃষ্টি হয়েছে ভোজ্য তেলের দাম নিয়ে। ইন্দোনেশিয়া পাম তেল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়ার পর এ সংকট আরও ঘনীভূত হয়েছে। তবে ভোজ্য তেলের সংকট বেশিদিন থাকবে না বলেও আশা প্রকাশ করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তারা খুব শিগগিরই পাম তেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেবে বলে আমরা আশা করছি।’ পাশাপাশি বিকল্প ও নতুন উৎস থেকে পণ্যটি আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।

বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেশি থাকলেও দেশের দরিদ্র মানুষের যাতে কষ্ট না হয় সে বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্পষ্ট নির্দেশনা রয়েছে। রমজানে ১ কোটি মানুষকে আমরা ন্যায্যমূল্যে খাদ্যসহায়তা দিয়েছি টিসিবির মাধ্যমে। এ ১ কোটি মানুষের পরিবারে ৫ কোটি লোক আছে। তার মানে সারা দেশে প্রায় ৫ কোটি মানুষ ভর্তুকিমূল্যে খাদ্যসহায়তা পেয়েছে।’ মন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের এ উদ্যোগ অব্যাহত থাকবে। এ বিষয়ে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। আগে যেভাবে রেশন কার্ড ছিল সেভাবে কার্ড করে ১ কোটি মানুষকে ভর্তুকিমূল্যে নিত্যপণ্য সরবরাহ করা হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তেমনটাই চান, যাতে দারিদ্র্যসীমার নিচে সারা দেশে যেসব প্রান্তিক জনগোষ্ঠী আছে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়।’ ভারত থেকে পিঁয়াজ আমদানি বন্ধের বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, ‘দেশের কৃষককে সুরক্ষা দিতেই এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কারণ পিঁয়াজের দাম একেবারেই কমে গিয়েছিল। কৃষক বলছে তারা দাম পাচ্ছে না। আবার দাম বেশি বেড়ে গেলেও সমস্যা। তো আমরা চাই যাতে কৃষক বাঁচে। কৃষক যদি না বাঁচে তবে উৎপাদন ব্যাহত হবে। আমরা চাই পণ্যটি এমন একটা দামে বিক্রি হোক যাতে কৃষক ন্যায্য দাম পায়; আবার ভোক্তারাও সহনীয় দামে কিনতে পারে।’

সর্বশেষ খবর