শনিবার, ১৪ মে, ২০২২ ০০:০০ টা
শাহজাহানপুরে টিপু হত্যা

তথ্য দেয়নি শুটার মাসুম অনুমানেই চলছে তদন্ত

সাখাওয়াত কাওসার

তথ্য দেয়নি শুটার মাসুম অনুমানেই চলছে তদন্ত

দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও গ্রেফতার হয়নি মতিঝিলের জাহিদুল ইসলাম টিপু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া মোটরসাইকেল চালক এবং অস্ত্র সরবরাহকারী। প্রকৃতপক্ষে কারা এই হত্যার মদদদাতা কিংবা পরিকল্পনাকারী সে সম্পর্কে এখনো পরিষ্কার হতে পারেননি তদন্ত সংশ্লিষ্টরা। অনেকটা অনুমানের ওপর ভর করেই তদন্ত কার্যক্রম চলছে বলে নিশ্চিত করেছে একাধিক সূত্র। মূল শুটার মাসুম  মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেফতার করতে পারলেও তার কাছ থেকে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। মোটরসাইকেল চালকের নাম মোল্লা শামীম জানলেও বের করা সম্ভব হয়নি অস্ত্রদাতার নাম কিংবা উদ্ধার হয়নি সেই অস্ত্রটিও। গত ২৪ মার্চ রাত সোয়া ১০টার দিকে মতিঝিল এজিবি কলোনি থেকে বাসায় যাওয়ার পথে খিলগাঁও ফ্লাইওভারের নিচে মাইক্রোবাসে গুলি করলে টিপু (৫৪) ও পাশের রিকশাযাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতি (২০) খুন হন। এ ঘটনায় ডিবির হাতে গ্রেফতার হয় শুটার মাসুম মোহাম্মদ আকাশ। ডিবি তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী আবৃত্তিকার আহকাম উল্লাহর ছোট ভাই যুবলীগ নেতা এরফান উল্লাহ দামালকে গ্রেফতার করে। খুনের এক সপ্তাহ পর র‌্যাব এ ঘটনায় মতিঝিলের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক (৫২), আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ (৩৮), নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির (৩৮) এবং মোরশেদুল আলম ওরফে কাইলা পলাশকে (৫১) গ্রেফতার করে। গোয়েন্দা সূত্র বলছে, চাঞ্চল্যকর এই টিপু হত্যাকাণ্ডে কেবলমাত্র সম্বল ছিল একটি সিসিটিভি ফুটেজ। তবে মাথায় হেলমেট থাকায় মোটরসাইকেলচালক এবং আরোহীকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে গোয়েন্দা বিভাগের মতিঝিলের এডিসি শাহিদুর রহমান রিপন মুনশিয়ানার পরিচয় দিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঠিক পরদিনই কিলার আকাশের বিষয়ে নিশ্চিত হন। জয়পুরহাট সীমান্ত পার হতে ব্যর্থ হয়ে পুনরায় বগুড়া ফিরে আসলে সেখান থেকেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। তবে তার কাছ থেকে কেবল সুমন শিকদার ওরফে মুছার নাম ছাড়া আর কোনো তথ্য বের করতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। অস্ত্র সরবরাহকারীর নামও অজানা রয়ে গেছে। তাদের ধারণা, আরও দুটো ব্যাকআপ টিম ছিল কিলিং মিশনে। কারণ আগের রাতে অর্থাৎ ২৩ মার্চের মিশন ব্যর্থ হয়। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের মতিঝিল বিভাগের উপ-কমিশনার রিফাত রহমান শামীম বলেন, আমরা আমাদের সর্বোচ্চটাই দিচ্ছি এই মামলার ক্লু বের করার জন্য। হত্যাকাণ্ডের প্রধান শুটার আকাশ স্বীকার করেছে তার সঙ্গে কেবল মুছার কথা হতো। তার নির্দেশেই সে কাজটি করেছে। তবে এর ওপরে কারা রয়েছে সে সম্পর্কে তার কাছ থেকে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। গ্রেফতার অন্যদের কাছ থেকেও খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আমরা পাইনি। তাদের দফায় দফায় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। এখন আমাদের মূল ফোকাস হলো শামীম এবং মুছাকে গ্রেফতার করা। অস্ত্র উদ্ধার কিংবা কতটি আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছিল এর উত্তরে তিনি বলেন, উদ্ধার করা গুলির খোসার ফরেনসিক রিপোর্ট এখনো পাওয়া যায়নি। ফরেনসিক রিপোর্ট পেলে নিশ্চিত হওয়া যেত যে এ হত্যায় একাধিক আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার হয়েছে কি না। হত্যায় ব্যবহৃত আগ্নেয়াস্ত্র আমরা উদ্ধার করার চেষ্টা করছি। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েলের মন্তব্যও অনেকটা এ ধরনের। তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, টিপু হত্যার পরিকল্পনাকারীদের অন্যতম একজন হলো মুছা। তাকে গ্রেফতার করা সম্ভব হলে অন্যদের নামও বেরিয়ে আসত। একইসঙ্গে মোল্লা শামীমকেও আমরা খুঁজছি। র‌্যাব সূত্র বলছে, ঘটনার তিন থেকে চার মাস আগে টিপু হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। এর পেছনে কাজ করে এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ-প্রকাশের অন্যতম শুটার ও বোচা হত্যা মামলার অন্যতম আসামি সুমন শিকদার ওরফে মুছার সঙ্গে ১৫ লাখ টাকার চুক্তি করে ওমর ফারুক। প্রাথমিকভাবে দেওয়া হয় ৯ লাখ টাকা। টাকার বড় একটি অংশের জোগান দেন ওমর ফারুক। হত্যাকাণ্ডের ঠিক ১২ দিন আগে সব কিছু ঠিক করে ১২ মার্চ দুবাইয়ে চলে যান মুছা।

যেভাবে গ্রেফতার শুটার আকাশ : শুরুতে খুুনের কোনো ক্লু না থাকায় ঢাকা শহরের পাঁচজন শুটারের বিষয়ে খোঁজ নিতে শুরু করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম। যদিও শুটাররা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে না। তাদের আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুদের খুঁজে বের করে তাদের ওপর নজরদারি শুরু করেন তারা। এর মধ্যেই তাদের কাছে তথ্য আসে হত্যার পরপরই আশপাশের এলাকা থেকে একজন শুটার ঢাকা থেকে খুলনার দাকোপের দিকে আর একজন শুটার রাত সোয়া ১১টার দিকে গোড়ান ক্লাব এলাকা থেকে জয়পুরহাট জেলার দিকে চলে যায়। এরপর গোয়েন্দারা মুহূর্তেই সন্দেহের তালিকা পাঁচজন থেকে দুজনে নামিয়ে আনেন। এক টিম চলে যায় খুলনার দাকোপে। অন্য টিম জয়পুরহাটের দিকে। নজরদারির একটি নম্বরে হঠাৎ একজন কল দিয়ে বলেন ‘ও কই? জবাবে সে বলে আমার সাথে নাই’। এই বলে সে তার ফোন কেটে দেয়। এর পাঁচ মিনিট পরই তার মোবাইল নম্বরে একই নম্বর থেকে কল আসে। মোবাইলের অন্য প্রান্ত থেকে বলা হয়, ‘দিনা (শুটার আকাশের স্ত্রী) বারবার ফোন দিচ্ছে, ও মনে হয় সন্দেহ করেছে গতকালের ঘটনা। এর পরই ফোন কেটে যায়। এর ১০ মিনিট পর আবার একই নম্বর থেকে কল করে বলা হয়, দিনা বারবার ফোন দিচ্ছে, আমি কী বলব? তখন শুটারের সঙ্গীর প্রান্ত থেকে বলা হয়, তুই ২০ হাজার টাকা দিয়ে বাসা ভাড়া দিয়ে আয়। দিনাকে ২০ হাজার টাকা দিতে গিয়েই গ্রেফতার হয় চক্রের একজন। সে বলেছে, টিভিতে প্রচার হওয়া ফুটেজের ব্যক্তিকে স্বামী আকাশের মতো মনে হওয়ায় তাকে বারবার ফোন করছিল দিনা। তার কাছ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতেই এডিসি শাহিদুর রহমান রিপনের নেতৃত্বাধীন টিম বগুড়া থেকে গ্রেফতার করে আকাশকে। পরবর্তীতে গোয়েন্দারা আকাশের স্ত্রী দিনাকে ডিবি অফিসে নিয়ে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করেন। এ সময় শুটার আকাশের তিন বছরের কন্যা মাহিরাও সেখানে ছিল।

যে দুই ঘটনায় অনুমান : ২০১৬ সালে রিজভী হাসান ওরফে বোচা বাবু নিহত হন। বাবুর বাবা আবুল কালাম টিপুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু। বাবু হত্যা মামলায় পুলিশের দেওয়া চার্জশিটে টিপু হত্যায় র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হওয়া ওমর ফারুক, আবু সালেহ শিকদার ও নাসির উদ্দিনের নাম রয়েছে। সেই মামলাটি বর্তমানে দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের রায়ের অপেক্ষায় আছে। বোচা বাবু হত্যাকাণ্ডের মামলার যাবতীয় খরচসহ সবকিছু দেখভাল করছিলেন টিপু। আসামিরা ৫০ লাখ টাকা দিয়ে মামলার রফা করার জন্য টিপুকে প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু টিপু রাজি হননি। আসামিদের আশঙ্কা ছিল, এ মামলায় তাদের কারও ফাঁসি হবে। তাই মামলার স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত করতে প্রথমে মামলার বাদী আবুল কালামকে হত্যার পরিকল্পনা করে। পরবর্তীতে আসামিরা ভেবে দেখলেন, বাদীর পরিবর্তে টিপুকে হত্যা করলে মামলার কার্যক্রম ব্যাহত করা যাবে। এর আগে ২০১৩ সালের ২৯ জুলাই রাতে গুলশান-১ নম্বরে শপার্স ওয়ার্ল্ডের সামনে ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের সাংগঠনিক সম্পাদক রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে (৪৩) সন্ত্রাসীরা এলোপাতাড়ি গুলি করে হত্যা করে। ওই ঘটনায় মিল্কীর ছোট ভাইয়ের দায়ের করা মামলায় টিপু আসামি ছিলেন। র‌্যাবের হাতে টিপু গ্রেফতার হয়ে কয়েক মাস জেলেও ছিলেন। পরে র‌্যাবের দেওয়া চার্জশিটে টিপুর নাম বাদ দেওয়া হয়। এরপর টিপুকে অনেকটাই একঘরে করে রাখে মতিঝিলের প্রভাবশালীরা। তবে ক্যাসিনো অভিযানের পর আবারও এলাকায় প্রভাব বিস্তার শুরু করেন টিপু। তা স্থানীয় কয়েকজন প্রভাবশালী মেনে নিতে পারছিলেন না।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর