রবিবার, ১৫ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

পি কে হালদার ভারতে গ্রেফতার

♦ নেওয়া হয়েছে রিমান্ডে ♦ দ্রুত দেশে আনার চেষ্টা করব : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ♦ বিচারের মুখোমুখি করা হবে : দুদকের আইনজীবী

দীপক দেবনাথ, কলকাতা

পি কে হালদার ভারতে গ্রেফতার

ভারতের পশ্চিমবঙ্গে গ্রেফতার হয়েছেন পি কে হালদার। ভিডিও ফুটেজ থেকে নেওয়া ছবি

প্রায় সাড়ে ৩ হাজার কোটি টাকা লোপাট এবং বিদেশে পাচারের অভিযোগে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংক ও রিলায়েন্স ফাইন্যান্স লিমিটেডের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক পি কে হালদার নামে পরিচিত প্রশান্ত কুমার হালদারকে ভারতে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল সকালে পশ্চিমবঙ্গে অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট ও দুদকের অনুরোধে ভারতে এ অভিযান চালানো হয়। এর আগে শুক্রবার পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সন্ধানে ভারতের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালানো হয়। এদিকে পি কে হালদারকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে দেশটির পুলিশ। পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মামলাকারী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) প্রধান কৌঁসুলি খুরশীদ আলম খান জানিয়েছেন, তারা পি কে হালদারের ভারতে আটক হওয়ার খবরটি পেয়েছেন। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানও বিভিন্ন মাধ্যমে আটকের খবর পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন জানিয়েছেন, তাকে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ইডি সূত্রে খবর, পি কে হালদারসহ মোট ছয়জনকে গ্রেফতার করেছে ইডি। এর মধ্যে রয়েছেন পি কে হালদারের সহযোগী স্বপন মৈত্র ও উত্তম মৈত্র নামে দুই ভাই। তারা বাংলাদেশি হলেও দুই দেশের পাসপোর্টের অধিকারী এবং নাগরিকত্ব রয়েছে স্বপন ও উত্তমের। আটক হওয়াদের মধ্যে পি কে হালদারের ভাই প্রণব কুমার হালদারও রয়েছেন। তাদের প্রত্যেককেই এ দিন সল্টলেকের সিজিও কমপ্লেক্সে ইডির আঞ্চলিক দফতরে নিয়ে আসা হয়েছে। গ্রেফতার প্রসঙ্গে পি কে হালদার কিছু না বললেও তার ভাই প্রণব বলেন, ‘প্রশান্ত আমার ভাই। আমি মায়ের চিকিৎসার জন্য ভারতে আসি।’ তবে অর্থ পাচার বা আত্মসাতের বিষয়ে কিছুই বলতে চাননি তিনি। জানা গেছে, পি কে হালদারের বিরুদ্ধে দেশে মামলা হওয়ার পর পরই পালিয়ে নাম বদল করে শিবশঙ্কর হালদার নামে পশ্চিমবঙ্গে বসবাস করছিলেন তিনি। ভারতেই রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড, প্যান কার্ড ও আধার কার্ড বানিয়েছিলেন। তবে পি কে হালদারই নন, তার সহযোগীরাও ভারতে প্রবেশ করে স্থানীয় সব নথিই সংগ্রহ করেছিলেন। এ ব্যাপারে উত্তমের স্ত্রী রচনা মৈত্র গতকাল জানান, ইডির কর্মকর্তারাই স্বপন ও উত্তম নামে দুই ভাইকে আটক করে নিয়ে গেছেন। তিনি আরও জানান, স্বপন পেশায় মৎস্য ব্যবসায়ী। উত্তম তার ভাইকে সহায়তা করতেন। রচনা মৈত্র বলেন, আমি ডাক্তার দেখাতেই দেড় বছর আগে ভারতের কলকাতায় আসি। কিন্তু করোনার কারণে দেশে ফেরা সম্ভব হয়নি। তিনি এও স্বীকার করেন, বাংলাদেশের পাশাপাশি ভারতেও রেশন কার্ড, ভোটার কার্ড সবকিছুই তাদের আছে। শুক্রবার দিনভর পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগরসহ একাধিক জায়গায় পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের সন্ধানে অভিযান চালায় ইডি। কয়েক ঘণ্টা অভিযান চালানোর পর আয়ের সঙ্গে সঙ্গতিহীন সম্পত্তির সন্ধান মেলায় রাতেই পি কে হালদারের অন্যতম সহযোগী সুকুমার মৃধার অশোকনগরের ১৬২/৮ দক্ষিণ পল্লীর বাড়ি থেকে বেশকিছু দলিল, বাংলাদেশি ফোন নম্বর ও নথি সংগ্রহ করে নিয়ে যান তারা। এরপর রাতেই বাড়িটিকে সিলগালা করে দেন ইডির কর্মকর্তারা। সুকুমারের বাড়ির প্রধান ফটকে ইডির তরফে একটি নোটিসও টাঙিয়ে ‘প্রিভেনশন অব মানি লন্ডারিং অ্যাক্ট’-এর ১৭ ধারার ১এ উপধারা মোতাবেক তার সম্পত্তি ফ্রিজ করার কথা বলা হয়। গতকাল সকালে সেই খবর জানাজানি হতেই সুকুমারের বাড়ির বাইরে ভিড় জমান অনেক উৎসাহী মানুষ। বাইরে থেকে উঁকি মেরে অনেকেই ভিতরের দৃশ্য দেখার চেষ্টা করেন। তবে গোটা ঘটনাটি জেনে অনেকেই হতবাক হয়ে ওঠেন। তাদের অভিমত, আর্থিক কেলেঙ্কারিতে অভিযুক্ত এ ধরনের মানুষ এলাকায় থাকলে সেই এলাকার পরিবেশ নষ্ট হয়। এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রচুর অর্থের মালিক হওয়ায় জমিদারের মতো চলাফেরা করতেন সুকুমার। এ ব্যাপারে স্থানীয় বাসিন্দা বিষ্ণুপদ চক্রবর্তী বলেন, ‘সুকুমার মৃধা খুবই বিত্তশালী ব্যক্তি। তার প্রচুর অর্থ আছে এবং সেভাবেই তিনি চলাফেরা করতেন। জমিদারের মতো ঠাটবাট নিয়ে চলাফেরা করতেন তিনি। ফলে অনেক মানুষই তার পেছনে ঘুরঘুর করতেন।’ তিনি বলেন, ‘এলাকায় বিপুল সম্পত্তির অধিকারী সুকুমারের বেশ কয়েকটি বাড়ি ছিল। কিন্তু আমাদের কারোরই কোনো সন্দেহ হয়নি। এর কারণ অনেকেই বাংলাদেশ থেকে টাকা-পয়সা নিয়ে এসে এপার বাংলায় বাড়িঘর তৈরি করেছেন। আমরাও তেমনটাই ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন জানতে পারছি বাংলাদেশে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের সঙ্গে তিনি জড়িত।’

আরও তদন্ত-অভিযানের কথা জানাল ইডি : বাংলাদেশের তিন নাগরিক প্রশান্ত কুমার হালদারের (পি কে হালদার), প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রাণেশ কুমার হালদার এবং তাদের বেশকিছু সহযোগীর ভারতের পশ্চিমবঙ্গে থাকা বিভিন্ন সম্পত্তিতে অভিযান চলছে বলে জানিয়েছে ভারতের এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। গতকাল দুপুরে এক বিবৃতিতে ইডি জানিয়েছে, প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) নিজেকে শিবশঙ্কর হালদার পরিচয় দিয়ে ভারতের বেশকিছু সরকারি পরিচয়পত্র, যেমন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রেশন কার্ড, ভারতের ভোটার পরিচয়পত্র, আয়কর দফতরের পরিচয়পত্র পিএএন (প্যান), নাগরিকত্বের পরিচয়পত্র, আধার কার্ড ইত্যাদি পরিচয়পত্র জোগাড় করেছিলেন। প্রশান্ত হালদার এবং তার অন্য সহযোগীরা একই কাজ করেছিলেন। এই পরিচয়পত্রের সাহায্যে ভারতে, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গে বেশকিছু সংস্থা (কোম্পানি) পি কে হালদার ও তার সহযোগীরা খুলেছিলেন। তারা বিভিন্ন জায়গায় জমিজমাও কিনেছিলেন। কলকাতার বিভিন্ন অভিজাত এলাকাতেও তাদের বেশকিছু বাড়ি রয়েছে। ইডি আরও বলেছে, প্রশান্ত কুমার হালদার বাংলাদেশে বহু কোটি টাকার আর্থিক কেলেঙ্কারিতে জড়িত। এই টাকা ভারতসহ অন্যান্য দেশে ঢোকানো হয়েছে। প্রধানত, আর্থিক কেলেঙ্কারি, বেআইনিভাবে টাকা দেশে ঢোকানো, বিদেশে পাচার করা এবং আইনবহির্ভূত সম্পত্তির বিষয় নিয়ে তদন্ত করে ইডি। ২৪ ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে ইডি পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তে, মূলত উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা এবং কলকাতায় প্রশান্ত কুমার হালদারের বিভিন্ন সম্পত্তিতে অভিযান চালাচ্ছে। এ বিষয়ে তদন্ত ক্রমে এগোবে বলেও জানিয়েছে ইডি।

রিমান্ডের আবেদন : এদিকে প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারকে তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়ার আবেদন জানিয়েছে পুলিশ। গতকাল উত্তর চব্বিশ পরগনার একটি আদালতে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার এ আবেদন জানানো হয়।   

পি কে হালদারকে দ্রুত দেশে আনার চেষ্টা করব বললেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী :  গতকাল বিকালে সচিবালয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, আনুষ্ঠানিকভাবে এখনো আমাদের কাছে খবর আসেনি। আসলে পরে সিদ্ধান্ত নেব। ওনার (পি কে হালদার) নামে আমাদের এখানে মামলা রয়েছে। আমরা নিশ্চয়ই তাদের (ভারতের) কাছে সহযোগিতা চাইব তাকে ফেরত আনার জন্য। পরবর্তী প্রক্রিয়া সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমরা তাকে দ্রুত ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করব।

প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বললেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী : গতকাল রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে এক অনুষ্ঠান শেষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন বলেন, পি কে হালদার ভারতে গ্রেফতার হওয়ার বিষয়ে আমরা এখনো আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। তবে জানামাত্র তাকে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, অর্থ পাচারকারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এটা নিয়ে দুদক কাজ করছে। অনেকে নামে-বেনামে দেশ থেকে টাকা পাচার করছে। তারা দেশের শত্রু। তাদের ধরে নিয়ে আসা ভালো। পি কে হালদারের মতো ধরে নিয়ে আসার দু-একটি দৃষ্টান্ত হলে তা আরও ভালো হবে।

বিচারের মুখোমুখি করার কথা বললেন দুদক আইনজীবী : এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের হাজার কোটি টাকা লোপাট মামলার আসামি প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে বলে জানিয়েছেন দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান। তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি, পি কে হালদার ভারতে গ্রেফতার হয়েছেন। এখন সেখানে তিনি যদি কোনো অপরাধ করে থাকেন, তবে সেখানকার আদালতে নেওয়া হবে। অথবা আমাদের সঙ্গে বহিঃসমর্পণ যে চুক্তি রয়েছে, সেই চুক্তির মাধ্যমে পি কে হালদারকে ভারত থেকে দেশে ফেরত এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। দেশে ফেরানো মাত্রই পি কের বিচার শুরু হবে জানিয়ে দুদক আইনজীবী আরও বলেন, ভারতে গ্রেফতার হওয়ায় আমাদের জন্য কাজটি সহজ হয়েছে। খুরশীদ আলম আরও বলেন, বাংলাদেশে ফেরানোর পর তাকে আদালতে তোলা হবে এবং বিচার প্রক্রিয়া শুরু হবে। এ ছাড়া যেসব তদন্ত অসম্পূর্ণ রয়েছে, তাকে জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে সেসব তদন্ত সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর