মঙ্গলবার, ১৭ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

ব্যবসায়ীদের মামলা দিয়ে হয়রানি করে বাজার স্থিতিশীল হবে না

এফবিসিসিআই সভাপতির অভিমত

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রতিযোগিতা কমিশন কর্তৃক দেশের আটটি ভোজ্য তেল পরিশোধন কোম্পানির নামে মামলার সমালোচনা করে ব্যবসায়ী ও শিল্প খাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে, বাজার অভিযানের নামে হয়রানি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা ও বাজারে অভিযান পরিচালনা প্রসঙ্গে গতকাল রাজধানীতে প্রতিযোগিতা কমিশনের একটি সেমিনারে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসমি উদ্দিন ওই কমিশনের চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে বলেন, ১৬ কোটি মানুষের জন্য যেসব ব্যবসায়ী তেল-চাল আমদানি করছেন, আপনারা তাদের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন। তারা তো ব্যবসা বন্ধ করেও দিতে পারে।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, প্রতিদিন দেড় লাখ টন ভোজ্য তেলের চাহিদা রয়েছে দেশে। ৫৪ লাখ দোকান রয়েছে। অভিযান চালিয়ে আপনারা কত টন তেল পেয়েছেন? তিনি বলেন, আমরা অভিযানের বিরুদ্ধে না। খারাপ ব্যবসায়ীদের ধরেন। কিন্তু ঢালাওভাবে দেশের ব্যবসায়ীদের হয়রানি করা যাবে না। দেশের ৯৫ থেকে ৯৭ শতাংশ ব্যবসায়ী ভালো বলেও মন্তব্য করেন ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠনের এই নেতা। ওয়ান-ইলেভেন সরকারের সময় ব্যবসায়ীদের হয়রানি করায় অনেক ব্যবসায়ী ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন বলেও জানান এফবিসিসিআই প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, চট্টগ্রামে অনেক আমদানিকারক ছিলেন, যারা ওয়ান ইলেভেনের পর থেকে আর ব্যবসা করছেন না।

প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ‘ব্যবসা-বাণিজ্যে সুষ্ঠু প্রতিযোগিতা নিশ্চিতকরণে ব্যবসায়ী সংগঠনের ভূমিকা’ শীর্ষক এ সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। কমিশনের চেয়ারম্যান মো. মফিজুল ইসলামের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন, বাংলাদেশ ঔষধ শিল্প সমিতির সভাপতি নাজমুল হাসান এমপি, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, ঢাকা মেট্রোপলিটন চেম্বার্স অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির ভাইস প্রেসিডেন্ট হাবিবুল্লাহ এম করীম, উইম্যান চেম্বারের প্রতিনিধি প্রীতি চক্রবর্তী, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প সমিতির ভাইস প্রেসিডেন্ট মনিরুজ্জামান স্বপন প্রমুখ। এ ছাড়া চট্টগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম চেম্বার্স অ্যান্ড কমার্সের প্রেসিডেন্ট মো. মাহবুবুল আলম ভার্চুয়াল মাধ্যমে সেমিনারে বক্তব্য দেন। সেমিনারে প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, ২০১২ সালে আইনের মাধ্যমে এ কমিশন গঠন হলেও দেশের মানুষ এর কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই জানে না। তিনি প্রতিযোগিতা কমিশনের কাছে স্বচ্ছ প্রতিযোগিতা প্রত্যাশা করে বলেন, সারা পৃথিবীতে যখন পণ্যের দাম বাড়ে, তখন বেশি দামে কিনতেই হবে। সরকার বাজার সহনীয় রাখতে ভর্তুকি দিতে পারে। যেটা টিসিবির মাধ্যমে করছে। কিন্তু ধরপাকড় আর অভিযান চালিয়ে বাজার স্থিতিশীল করা যাবে না। ভোজ্য তেলের বিরুদ্ধে অভিযান চালিয়ে বাজারে কি দাম কমানো গেছে? এ প্রশ্ন রাখেন তিনি।

জসিম উদ্দিন বলেন, ৪০০ ডলারের ভোজ্য তেল এখন ১৮ শ ডলারে উঠেছে। আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে দেশেও দাম বাড়বে। ভোজ্য তেলের দোকানগুলোতে সরকারি সংস্থাগুলো অতি উৎসাহিত হয়ে অভিযান পরিচানা করছে বলেও অভিযোগ করেন ব্যবসায়ী এ নেতা। তিনি বলেন, আইনে স্পষ্ট করা উচিত কতদিন পণ্য রাখা যাবে। কী পরিমাণ পণ্য মজুদ করা যাবে। সে আইন অনুসরণ করে অভিযান পরিচালনা করা উচিত।

এফবিসিসিআই সভাপতি বলেন, বাজার স্থিতিশীল করতে চাইলে সারা দেশের ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। সারা দেশে ৪০০’র ওপর অ্যাসোসিয়েশন আছে। ১০০’র ওপর চেম্বার আছে। জেলায় জেলায় চেম্বারগুলোকে সম্পৃক্ত করে সরকার বাজার স্থিতিশীল করার উদ্যোগ নিতে পারে।

প্রতিযোগিতা কমিশনকে উদ্দেশ করে এফবিসিসিআই সভাপতি আরও বলেন, সরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানের দক্ষতার অভাব আছে। তাদের কারণে ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা কমছে কি না সেসব বিষয় দেখতে হবে। যারা ব্যবসা করছেন, তারা ঠিকমতো নীতি-সহায়তা পাচ্ছেন কি না, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ঋণ-সহায়তা দিচ্ছে কি না, সেসব বিষয় নিশ্চিত করা উচিত। তিনি অভিযোগ করেন, করোনা মহামারির কারণে প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের ২২ হাজার কোটি টাকার ঋণ সহায়তা এখনো ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের হাতে পৌঁছায়নি। তৃণমূলে ছোট ছোট ব্যবসায়ীদের ঋণ দিতে ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা উচিত বলেও মন্তব্য করেন এফবিসিসিআই সভাপতি।

প্রতিযোগিতা কমিশনের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলে নাজমুল হাসান ওই কমিশনের চেয়ারম্যানকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনার প্রতিষ্ঠান থেকে সম্প্রতি আমাদের কাছে একটি চিঠি দেওয়া হয়েছে। কমিশন জানতে চেয়েছে  আমরা কত টাকায় ওষুধ বিক্রি করি। কোম্পানির টার্নওভার কত ইত্যাদি ইত্যাদি। তিনি বলেন, ওষুধে প্রাইসিংয়ে আমাদের কোনো হাত নেই। ওষুধ শিল্প সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত। প্রতিযোগিতা কমিশনের এসব তথ্য চাওয়ার আগে বিষয়টি জানা উচিত ছিল। ওষুধের দাম প্রসঙ্গে নাজমুল হাসান বলেন, ওষুধ তৈরির জন্য কত দামে কাঁচামাল আমদানি হচ্ছে, প্রতি বছর ডলারের যে দাম বাড়ছে, ওষুধের মূল্যে তা সমন্বয় হচ্ছে কি না সে তথ্যও নেওয়া উচিত প্রতিযোগিতা কমিশনের। তিনি বলেন, দেশে প্যারাসিটামল ওষুধ লোকসানে বিক্রি হচ্ছে। সাধারণ মানুষের জনস্বাস্থ্য চিন্তা করেই এটি করা হচ্ছে। যখন একটি পণ্য লোকসানে বিক্রি হয়, সেখানে প্রতিযোগিতা কমিশন কীভাবে প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করবে? প্রশ্ন রাখেন ওষুধ শিল্প সমিতির সভাপতি। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, ২০১২ সালে প্রতিষ্ঠা পেলেও এখনো এ কমিশনের কার্যত্রম সম্পর্কে সাধারণ মানুষ জানে না। তিনি বলেন, কেউ কেউ মনে করেন ভোক্তাদের বেনিফিট দিতে কমিশন কাজ করছে- এটাই শেষ কথা নয়। কোনো মহলকে হয়রানি করার জন্যও সরকার প্রতিযোগিতা কমিশন গঠন করেনি। কমিশনকে সবার আস্থা অর্জন করতে হবে বলেও মন্তব্য করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। ভোজ্য তেলের বাজারে অভিযান প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, বাজারে যে অভিযান চলছে তা কাউকে হয়রানি করার জন্য নয়। সারা দেশে যেখানে হাজার হাজার দোকান রয়েছে, তার মধ্যে বড় জোর ২০০ দোকানে অভিযান পরিচালিত হয়েছে। অসাধু ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে সরকার যে পদক্ষেপ নিচ্ছে বাজারে এমন একটি সতর্কবার্তা দেওয়ার জন্যই এ ধরনের অভিযান পরিচালিত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন বাণিজ্যমন্ত্রী। তিনি বলেন, কাউকে বিচলিত করা আবার কাউকে প্রটেক্ট করা সরকারের কাজ না। সরকারকে ব্যবসায়ী এবং ভোক্তা উভয়ের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

সর্বশেষ খবর