বুধবার, ১৮ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞায় কর্মকর্তাদের হাপিত্যেশ

ক্ষোভ প্রকাশ অনেকের

উবায়দুল্লাহ বাদল

খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে প্রশিক্ষণ নিতে ২১ মে ইন্দোনেশিয়া ও মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের একটি প্রতিনিধি দলের। সাত দিনব্যাপী ওই প্রশিক্ষণে খাদ্য মন্ত্রণালয়সহ

প্রতিষ্ঠানটির ৩২ জন কর্মকর্তার যাওয়ার প্রস্তাব ছিল। যথারীতি এ বিষয়ে প্রস্তাবসহ সার-সংক্ষেপ পাঠানো হয়েছিল মন্ত্রণালয়ে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে প্রজ্ঞাপন জারি করত খাদ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু বিধিবাম, গত ১১ মে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল গণমাধ্যমকে বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী পরিষ্কার বলে দিয়েছেন, কোনো প্রয়োজন না থাকলে বিদেশ সফর নয়।’ পরদিনই এ বিষয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করে অর্থ বিভাগ। এরপর আর বিদেশ প্রশিক্ষণে যাওয়ার ওই সার-সংক্ষেপ অনুমোদনের জন্য পাঠায়নি খাদ্য মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগের ১০ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ১৬ মে জাপান ও থাইল্যান্ড প্রশিক্ষণে যাওয়ার কথা ছিল। আট দিনের ওই প্রশিক্ষণের বিষয়ে গত এপ্রিলে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়। অর্থ বিভাগের ১২ মের জারি করা প্রজ্ঞাপনের কারণে প্রশিক্ষণটি স্থগিত করা হয়েছে। এতে হতাশ হয়ে পড়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিষয়টি নিয়ে আলাপকালে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অনেকে ক্ষোভ ও হতাশা প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ প্রতিদিনের কাছে।

শুধু খাদ্য মন্ত্রণালয় বা স্থানীয় সরকার বিভাগ নয়, একের পর এক স্থগিত হচ্ছে সরকারসংশ্লিষ্টদের বিদেশ সফরসংক্রান্ত জিও (গভর্নমেন্ট অর্ডার)। গতকাল পর্যন্ত স্থগিত হয়েছে ৩৫০ কর্মকর্তার জিও। বৈশ্বিক সংকট মোকাবিলায় কৃচ্ছ্র সাধনের অংশ হিসেবে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হয়। তবে উল্টো চিত্রও দেখা গেছে কোনো কোনো দফতরে। বিদেশ ভ্রমণের যেসব জিও আগে জারি হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রী অনুমোদন দিয়েছেন, সেসব কর্মকর্তা বিদেশ ভ্রমণের জন্য সংশ্লিষ্ট দফতরে ভিড় করছেন। অনেকে তড়িঘড়ি করে ট্যুরের টাকাও উত্তোলন করেছেন। অনেকে তদবির করে দ্রুত বিদেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন বলেও অভিযোগ উঠেছে।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর চাপ কমাতে গত ১২ মে রাজস্ব ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় বিদেশ সফরের ওপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে পরিপত্র জারি করা হয়। এতে বলা হয়- কভিড-১৯ পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং বর্তমান বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সব প্রকার এক্সপোজার ভিজিট, স্টাডি ট্যুর ও ইনোভেশনের আওতাভুক্ত ভ্রমণ এবং ওয়ার্কশপ, সেমিনারে অংশগ্রহণসহ সব প্রকার বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ থাকবে। তার আগের দিন সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির বৈঠক শেষে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সাংবাদিকদের জানান, বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিদেশ সফরে যেতে পারবেন না। বৈদেশিক মুদ্রার অহেতুক ব্যয় কমাতে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরপর গত ১৬ মে রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরও বিদেশ ভ্রমণ সীমিতকরণের নির্দেশ দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়-পরিচালন ও উন্নয়ন বাজেটের আওতায় রাষ্ট্রায়ত্ত, স্বায়ত্তশাসিত, আধা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদেরও বিদেশ ভ্রমণ বন্ধ থাকবে।

সরকারের এ সিদ্ধান্তে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। প্রশাসনের নিচের স্তরের (সহকারী সচিব থেকে উপসচিব) কর্মকর্তাদের অনেকে বলেছেন, সরকারি সিদ্ধান্তটি যুগোপযোগী। বিদেশি কোনো ট্যুর আসলেই মন্ত্রণালয়ের কর্তাব্যক্তি ও বড় স্যারের নিজেদের নাম লেখান। যেখানে একজন সিনিয়র সহকারী সচিব যাওয়ার কথা সেখানে পাঠানো হচ্ছে অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম-সচিবদের। আবার কোথাও বা সচিব নিজেই চলে যান। বিদেশ ট্যুরে নেওয়ার নামে মূলত পণ্য বিক্রিকারী দেশগুলো আমাদের দেশের কর্মকর্তাদের উপঢৌকন দিয়ে ম্যানেজ করে নিম্নমানের পণ্য সরবরাহ করে থাকেন। এখন বিদেশ ট্যুর এক ধরনের ‘ঘুষ’। এটা বন্ধ হওয়ায় দেশের জন্য ভালো হয়েছে।

তবে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মতে, কর্মকর্তারা বিভিন্ন নামে বিদেশ গেলেও দেশের প্রয়োজনেই তারা যান। সেখানে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন তারা। বিদেশ গিয়ে নানা ধরনের প্রয়োজনীয় জিনিস সরাসরি দেখে ক্রয় করা হয়। এখন বিদেশ না যেতে পারলে প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি না দেখেই কিনতে হবে। এতে দেশের ক্ষতি হবে।

ইতোমধ্যে যাদের বিদেশ ট্যুর স্থগিত হয়েছে তাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে হাপিত্যেশ। খাদ্য মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক প্রশিক্ষণ প্রার্থী কর্মকর্তা প্রায় অভিন্ন ভাষায় বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমাদের টিমে এমন কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন যারা কোনোদিন দেশের বাইরে যাননি। তারা জীবনের প্রথম বিদেশ যাচ্ছেন। ট্যুরের পরিকল্পনা ও বিদেশ যাওয়ার উত্তেজনায় অনেকের রাতের ঘুম হচ্ছিল না। এমন পরিস্থিতির মধ্যে বিদেশ ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞায় অনেকে নিজের ভাগ্যকে দায়ী করছেন। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশার সৃষ্টি হচ্ছে।’ স্থানীয় সরকার বিভাগের একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘এপ্রিলে জিও জারির পর যথাযথ প্রক্রিয়ায় প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ হয়ে গেছে। যেসব দেশে যাওয়ার কথা ছিল তারাও হোটেল বুকিংসহ এ বিষয়ে চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করেছিল। এখন বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার কারণে ট্যুর স্থগিত করা হয়েছে। স্থানীয় সরকার বিভাগের সিনিয়র সচিব বর্তমানে স্পেনে রয়েছেন। তিনি সেখান থেকে  মৌখিকভাবে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশনা দিয়েছেন যে, প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা জানার পরই তারা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন।’

ক্ষুব্ধ ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘এভাবে বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয় সম্ভব নয়। অনেকে ‘ঘুষ’ নেন ডলারে। তারা এর মাধ্যমে টাকা পাচার করছেন। তাদের বিষয়ে সরকার দেখছে না। কোনো কর্মকর্তা বছরে কতবার বিদেশ যাচ্ছেন, কী কারণে যাচ্ছেন সে বিষয়ে প্রতিবছর তদন্ত করলেই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।’

জিও নিয়ে অস্পষ্টতা : বিদেশ ভ্রমণে নিষেধাজ্ঞার পরিপত্রে একধরনের অস্পষ্টতা রয়েছে- এমন অভিযোগ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের। তাদের মতে, ভিসা, হোটেল বুকিং, বিমান টিকিটসহ যারা সব প্রস্তুত করে ফেলেছেন, তারা কী করবেন- এই প্রশ্ন অনেকের। কেউ বলছেন, বিদেশ ভ্রমণ বন্ধে পরিপত্র প্রকাশের আগে জারি করা সরকারি আদেশ (জিও) অনুযায়ী বিদেশ ভ্রমণে সমস্যা নেই। কিন্তু তারপরও পরিপত্র জারির আগের জিওতেও বিদেশ ভ্রমণ স্থগিত করেছে একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ। পরিপত্র অনুযায়ী, ঠিক কোন তারিখ থেকে এবং কী কী কারণে বিদেশ সফর যাওয়া যাবে না, কোন কোন ক্ষেত্রে যাওয়া যাবে, তা নিয়ে বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জারি করা পরিপত্রের আলোকে সুনির্দিষ্ট নির্দেশনা না থাকায় এ ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি হয়েছে। এ বিষয়ে অর্থ বিভাগ থেকে নির্দিষ্টভাবে কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে অর্থ বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিব জানান, সাধারণত সরকারি কোনো পরিপত্রে সুনির্দিষ্ট তারিখ উল্লেখ না থাকলে পরিপত্রটি যে তারিখ থেকে জারি হয়, সেই তারিখ থেকেই কার্যকর বলে ধরে নেওয়া হয়।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর