শিরোনাম
সোমবার, ২৩ মে, ২০২২ ০০:০০ টা
৩০৩ কোটি টাকা আত্মসাৎ

নর্থ সাউথের চার ট্রাস্টিকে জামিন না দিয়ে পুলিশে দিল হাই কোর্ট

নিজস্ব প্রতিবেদক

নর্থ সাউথের চার ট্রাস্টিকে জামিন না দিয়ে পুলিশে দিল হাই কোর্ট

বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগের মামলায় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চার সদস্যকে জামিন না দিয়ে পুলিশে দিয়েছে হাই কোর্ট। এই চার ট্রাস্টি হলেন- রেহানা রহমান, এম এ কাশেম, মোহাম্মদ শাহজাহান ও বেনজীর আহমেদ। তাদের পৃথক আগাম জামিনের আবেদন সরাসরি খারিজ করে গতকাল বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল  হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ এ আদেশ দেয়। পরে রাত ১১টা ৫ মিনিটে আদেশের পূর্ণাঙ্গ অনুলিপি প্রকাশ হওয়ার পর চার ট্রাস্টিকে হাই কোর্ট থেকে নিয়ে যায় শাহবাগ থানা পুলিশ। এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদার বলেন, হাই কোর্ট নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চার সদস্যের জামিন আবেদন খারিজ করে তাদের আমাদের হাতে তুলে দিয়েছে। এই চার ট্রাস্টি রাতে আমাদের থানার হাজতখানায় থাকবেন। যেহেতু মামলাটি দুদক তদন্ত করছে তাই আমরা জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড আবেদন করব না। আমরা দায়িত্ব অনুযায়ী আগামীকাল (আজ) তাদের নিম্ন আদালতে সোপর্দ করা হবে। আদালত আদেশে বলে, আবেদনকারী অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ। অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় আবেদনকারী অভিযুক্তরা আগাম জামিন পেতে পারেন না। তাছাড়া আগাম জামিন পাওয়ার মতো যৌক্তিক, গ্রহণযোগ্য কারণ তারা আদালতকে দেখাতে পারেননি। এ কারণে আগাম জামিনের আবেদন সরাসরি খারিজ করে তাদের পুলিশে সোপর্দ করা হলো। শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) নির্দেশ দেওয়া হলো, হেফাজতে পাওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যেন আসামিদের সংশ্লিষ্ট আদালতে হাজির করা হয়। আদালতে আসামি রেহানা রহমান ও এম এ কাশেমের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী আজমালুল হোসেন কিউসি, মোহাম্মদ শাহজাহানের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী ফিদা এম কামাল। আর বেনজীর আহমেদের পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী এ এফ হাসান আরিফ। তাদের সহযোগিতা করেন আইনজীবী মিজান সাঈদ। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। সঙ্গে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল বিশ্বজিৎ দেবনাথ ও এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। আর দুদকের পক্ষে শুনানি করেন মো. খুরশীদ আলম খান। শুনানিতে আইনজীবী মিজান সাঈদ জামিন আবেদনকারীদের পারিবারিক, সামাজিক ও ব্যবসায়িক পরিচয় তুলে ধরে বলেন, এই আবেদনকারীরা প্রত্যেকে এদেশের নাগরিক। তারা সবাই বয়স্ক। তার মধ্যে একজন নারীও আছেন। নিজেদের টাকায় তারা এ বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে দুদক অনুমানের ভিত্তিতে মামলা করেছে। এ মামলায় তারা হয়রানির শিকার হলে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। যে কারণে তারা আগাম জামিন চেয়ে আবেদন করেছেন। জামিন পেলে তারা পালিয়ে যাবেন না।  

শুনানির একপর্যায়ে আদালত বলে, বর্তমানকালে অর্থ পাচার এবং দুর্নীতি হত্যার চেয়েও বিপজ্জনক অপরাধ। হত্যা একটা পরিবারকে ধ্বংস করে মাত্র। অর্থ পাচার বা দুর্নীতি দেশ-সমাজকে ধ্বংস করে। জামিনের বিরোধিতা করে দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান শুনানিতে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি), শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন পাশ কাটিয়ে, টেন্ডার (দরপত্র) না করে অতিরিক্ত দাম দিয়ে জমি কিনেছেন। একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানকে তারা ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন। তাছাড়া আসামিদের জামিন আবেদনে কোথাও তারা বলেননি, দুদক তাদের হয়রানি করছে বা করতে পারে। জামিনের অপব্যবহার করে তাদের দেশের বাইরে চলে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে। সুতরাং তাদের জামিন আবেদন খারিজ করে কাস্টডিতে দেওয়া হোক। জামিন আবেদনকারী ট্রাস্টি মোহাম্মদ শাহজাহানের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের নথি জালিয়াতির ঘটনায় মামলা হয়েছে জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল শুনানিতে বলেন, এ মামলার বিরুদ্ধে রিট মামলা করে আদেশ নিয়ে তিনি দেশের বাইরে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। পরে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে গিয়ে হাই কোর্টের সে আদেশে স্থগিতাদেশ নেয়। ওই মামলায় তিনি এখন জামিনে আছেন। সুতরাং তাদের জামিন দেওয়া হলে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারেন। তাছাড়া আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থ পাচার গুরুতর অভিযোগ। এসব বিবেচনায় জামিন আবেদন খারিজ করা হোক। আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, ট্রাস্টি হলেন যাকে ট্রাস্ট করা হয়। একজন ট্রাস্টি হিসেবে যদি সেই ট্রাস্ট ভঙ্গ করেন তা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। এই চার আসামি ট্রাস্টের টাকার সদ্ব্যবহার করেননি। নিজেদের স্বার্থে টাকা ব্যবহার করার অভিযোগ রয়েছে তাদের বিরুদ্ধে। শুধু তাই না, বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য জমি কিনেছেন অতিরিক্ত দাম দিয়ে। বিপুল পরিমাণ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে তাদের বিরুদ্ধে। আপিল বিভাগের নির্দেশনা ও সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অর্থ আত্মসাৎ বা দুর্নীতি গুরুতর অপরাধ। আর অপরাধের গুরুত্ব বিবেচনায় হাই কোর্ট তাদের জামিন আবেদন খারিজ করেছে বলে মনে করি। নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের জমি কেনা বাবদ অতিরিক্ত ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ টাকা ব্যয় দেখিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগে বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারম্যানসহ ছয়জনের বিরুদ্ধে গত ৫ মে মামলা করেন দুদকের উপ-পরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী। এ মামলার এজাহারে বলা হয়, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে পাশ কাটিয়ে ট্রাস্টি বোর্ডের কয়েকজন সদস্যের অনুমোদন/সম্মতির মাধ্যমে ক্যাম্পাস উন্নয়নের নামে ৯০৯৬ দশমিক ৮৮ ডেসিমেল জমির দাম ৩০৩ কোটি ৮২ লাখ ১৩ হাজার ৪৯৭ টাকা বেশি দেখিয়ে তা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ের তহবিলের টাকা আত্মসাতের হীন উদ্দেশ্যে কম দামে জমি কেনা সত্ত্বেও বেশি দাম দেখিয়ে তারা প্রথমে বিক্রেতার নামে টাকা প্রদান করেন। পরে বিক্রেতার কাছ থেকে নিজেদের লোকের নামে নগদ চেকের মাধ্যমে টাকা উত্তোলন করে আবার নিজেদের নামে এফডিআর করে রাখেন এবং পরে নিজেরা ওই এফডিআরের অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেন। অবৈধ ও অপরাধলব্ধ আয়ের অবস্থান গোপনের জন্য ওই অর্থ হস্তান্তর ও স্থানান্তরের মাধ্যমে মানি লন্ডারিংয়ের অপরাধও সংঘটন করেন আসামিরা।

এক ট্রাস্টির কান্ড : আগাম জামিনের আবেদন সরাসরি খারিজ করে আদেশ দেওয়ার পরপরই এন এক্স ভবনের তিন তলার ২৭ নম্বর আদালত কক্ষ থেকে বের হয়ে প্রথমে আদালত কক্ষের পাশের সিঁড়ি দিয়ে দ্রুত চার তলায় ওঠেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি বেনজীর আহমেদ। তার সঙ্গে সঙ্গে দুই-তিনজনকেও উঠতে দেখা যায়। কিছুক্ষণ পরই আবার নেমে আসেন তিন তলায়। কিন্তু আদালত কক্ষে না ঢুকে দ্রুত হেঁটে ভবনের মূল সিঁড়ির দিকে এগিয়ে যান। তখন তার পেছন পেছন সংবাদ কর্মীরাও ছুটতে থাকেন। ততক্ষণে বিষয়টি একজন সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের নজরে আসে। পরে আদালতের কর্মকর্তারা তাকে আদালত কক্ষে নিয়ে আসেন। তিনি পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন কি না, সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নে কোনো জবাব দেননি ট্রাস্টি বেনজীর আহমেদ।

সর্বশেষ খবর