রবিবার, ২৯ মে, ২০২২ ০০:০০ টা
জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস

সেবা ও ত্যাগের অনন্য স্বীকৃতি থ্যাংক ইউ বাংলাদেশ

শিমুল মাহমুদ

সেবা ও ত্যাগের অনন্য স্বীকৃতি থ্যাংক ইউ বাংলাদেশ

বিশ্বশান্তি রক্ষায় অনন্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে এখন এক নতুন উচ্চতায় অধিষ্ঠিত বাংলাদেশ। আন্তরিক সেবা ও আত্মত্যাগের কারণে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা অপারেশনে দুই বছর ধরে শীর্ষ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী দেশের মর্যাদায় রয়েছে বাংলাদেশ। শান্তিরক্ষা মিশনে অংশগ্রহণকারী বিশ্বের ১২২টি দেশের মধ্যে ৬ হাজার ৭১০ জন শান্তিরক্ষী নিয়ে শীর্ষে থাকা বাংলাদেশ বিশ্বশান্তি রক্ষায় ৩৩ বছর ধরে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এরমধ্যে রয়েছে ৬ হাজার ২৩ জন মিলিটারি (সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সদস্য)। বাকিরা হচ্ছেন ফরমড পুলিশ, মিশন এক্সপার্ট ও স্টাফ অফিসার। এর আগেও সামরিক ও পুলিশ শান্তিরক্ষী পাঠানোর ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক বছর শীর্ষ অবস্থান ধরে রাখে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালের জানুয়ারি থেকে ২০১৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত বাংলাদেশ শীর্ষ অবস্থানে ছিল। এর আগে ও পরে সর্বোচ্চ শান্তিরক্ষী প্রেরণকারী প্রথম সারির দেশগুলোর তালিকায় নিজের অবস্থান ধরে রাখতে সক্ষম হয় বাংলাদেশ।

৩৩ বছর ধরে ব্লু হেলমেট পরে আফ্রিকার সংঘাতপূর্ণ দেশসহ বিশ্বের ৪০টি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা। এসব অনন্য অবদানের প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশের দুই নারী বৈমানিক নাইমা হক এবং তামান্না ই লুৎফীর ছবি দিয়ে জাতিসংঘ লিখেছে, ‘থ্যাংক ইউ বাংলাদেশ ফর ইউর সার্ভিস অ্যান্ড সেক্রিফাইস’। বাংলাদেশের এই গৌরবোজ্জ্বল স্বীকৃতি সামনে রেখে আজ বিশ্বজুড়ে আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস পালিত হচ্ছে। দিবসটি উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পৃথক বাণীতে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের সব শান্তিরক্ষীকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানিয়েছেন। বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, বিশ্বশান্তি রক্ষার মহান দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আত্মোৎসর্গকারী বীর শান্তিরক্ষী সদস্যদের আমি পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। বাংলাদেশ আজ বিশ্বদরবারে শান্তি ও সম্প্রীতির এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা আমি গর্বভরে স্মরণ করছি এবং শান্তিরক্ষা-মিশনে কর্মরত বাংলাদেশের সব সদস্যকে আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি নিহত শান্তিরক্ষীদের যারা বিশ্বশান্তির জন্য অকাতরে জীবন বিসর্জন দিয়ে বিশ্বদরবারে দেশের পতাকাকে সমুন্নত করেছেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এক ভিডিওবার্তায় বলেছেন, শান্তিকে কখনই মঞ্জুরি হিসেবে গ্রহণ করা যায় না। তিনি আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষী দিবসে বিশ্বজুড়ে জাতিসংঘ মিশনে দায়িত্ব পালনকারী সব কর্মীকে সম্মান জানান।

বছরের ফোকাস : সংঘাতের অবসান এবং দীর্ঘস্থায়ী শান্তি সুরক্ষিত করতে হোস্ট সরকার ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে শক্তিশালী অংশীদারিত্ব।

প্রসঙ্গত, ১৯৮৯ সালে ইরাকে সামরিক পর্যবেক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনের সূচনা। এরপর দীর্ঘ ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বারবার শীর্ষ অংশগ্রহণকারী শান্তিরক্ষীর দেশের তালিকায় উঠেছে। জাতিসংঘের ‘ডিপার্টমেন্ট অব পিসকিপিং অপারেশন্স’-এর ওয়েবসাইটে শান্তিরক্ষা মিশনে কোন দেশ কত সামরিক ও পুলিশ সদস্য পাঠিয়েছে, তার মাসভিত্তিক প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে সব সময় বাংলাদেশের গৌরবোজ্জ্বল অংশগ্রহণ তুলে ধরা হয়।

শান্তি প্রতিষ্ঠা ৪০ দেশে : জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনে অংশ নিয়ে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীরা গত ৩৩ বছরে আফ্রিকার সংঘাতপূর্ণ আইভরি কোস্ট, সিয়েরালিওন, লাইবেরিয়া, হাইতি, অ্যাঙ্গোলা, কসোভো, পূর্ব তিমুর, দারফুর, সুদান, বুরুন্ডিসহ বিশ্বের ৪০টি দেশে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেছেন। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আর্তমানবতার সেবার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। এ সময়ে বীরত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে বাংলাদেশের শান্তিরক্ষীদের ১৫৯ জন প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন প্রায় আড়াই শ’ জন। তাদের মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী ও বিমান বাহিনীর সদস্যরা রয়েছেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে গণতান্ত্রিক রিপাবলিক কঙ্গোতে সর্বোচ্চ ১ হাজার ৭৪২ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী নিয়োজিত রয়েছেন। এরমধ্যে সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৩৫৫ জন, বিমান বাহিনীর ৩৭৩ জন এবং নৌবাহিনীর ১৪ জন সদস্য রয়েছেন। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৬২০ জন শান্তিরক্ষী আছেন সাউথ সুদানে। সেখানে সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৪১৪ জন, নৌবাহিনীর ২০৩ জন এবং বিমান বাহিনীর ৩ জন সদস্য রয়েছেন। তৃতীয় সর্বোচ্চ ১ হাজার ৪৩৯ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী আছেন মালিতে। এরমধ্যে সেনাবাহিনীর ১ হাজার ৩২২ জন, বিমান বাহিনীর ১১৩ জন এবং নৌবাহিনীর ৪ জন সদস্য রয়েছেন। মিশনের কার্যক্রম, ঝুঁকি এবং চাহিদা বিবেচনায় শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা হয়। লেবাননে রয়েছেন শুধুই নৌবাহিনীর ১১৬ সদস্য।

স্বল্পতম সময়ে শান্তিরক্ষী মোতায়েন : জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশন সুদান ও দক্ষিণ সুদানের মধ্যবর্তী আবেই এলাকায় মোতায়েনের জন্য প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একটি কন্টিনজেন্টের ১৬০ সদস্যের দল সেখানে গেছে। আন্তবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) জানায়, সেখানে পর্যায়ক্রমে ৫১২ জন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষী মোতায়েন করা হবে। এই মিশন বাংলাদেশি শান্তিরক্ষীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। বাংলাদেশ বর্তমানে দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিশ্বের যে কোনো প্রান্তে শান্তিরক্ষী মোতায়েন করতে পারে। গত কয়েক বছরে এই সক্ষমতা তৈরি করেছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। কেবলমাত্র মৌলিক অস্ত্র সরঞ্জামাদি নিয়ে অপারেশন এলাকায় স্বল্পতম সময়ে মোতায়েন শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের একটি নতুন সংযোজন। জাতিসংঘ সদর দফতরের আহ্বানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী অত্যন্ত দ্রুততার সঙ্গে আবেইতে পাঠানো কন্টিনজেন্টকে প্রস্তুত করে এবং অপারেশনাল এলাকায় নিয়োগের সব কার্যক্রম সম্পন্ন করে।

এরই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বিভিন্ন মিশনে বাংলাদেশের জনবল এবং সরঞ্জামাদি উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মধ্যে মধ্য আফ্রিকান প্রজাতন্ত্রে লাইট কুইক রিয়েকশন ফোর্স ও স্পেশাল ফোর্স কোম্পানির ৫০ জন জনবল বৃদ্ধি ও একটি লেভেল-২ হাসপাতাল (৬৯ জন), মালিতে একটি মেকানাইজ ইনফেন্ট্রি কোম্পানি-কুইক রিয়েকশন ফোর্স (২৬৬ জন) মোতায়েন হচ্ছে। কঙ্গোতে একটি এক্সপ্লোসিভ অর্ডন্যান্স ডিসপোসাল প্লাটুন (৩৬ জন) মোতায়েনের অনুরোধ প্রক্রিয়াধীন। এ ছাড়াও জাতিসংঘ সদর দফতর থেকে বাংলাদেশের আরও একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন, হেলিকপ্টার ইউনিটকে মোতায়েন প্রস্তুতির জন্য সবুজ সংকেত দেওয়া হয়েছে। জাতিসংঘ সদর দফতর এবং বিভিন্ন মিশনের নেতৃত্ব স্থানীয় পদে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ পদায়নও বৃদ্ধি পেয়েছে। যার মধ্যে জাতিসংঘ সদর দফতরে চিফ অব স্টাফ (ডি-১), দক্ষিণ সুদান ও আবেইতে একজন করে ডেপুটি ফোর্স কমান্ডার ও বিভিন্ন মিশনে চারজন বাংলাদেশি সেক্টর কমান্ডার পদে দায়িত্ব পালন করছেন। শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের এসব অর্জনের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি জাতিসংঘ সদর দফতরে শীর্ষ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করে এসেছেন। এর সুফলও পর্যায়ক্রমে পেতে থাকবে বাংলাদেশ। সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এস এম শফিউদ্দিন আহমেদের অভিজ্ঞ নির্দেশনা, সামরিক কূটনীতি এবং দক্ষ নেতৃত্বের ফলই হচ্ছে এ ধরনের জরুরি মোতায়েনে সেনাবাহিনীর সক্ষমতা অর্জন।

দিবসের কর্মসূচি : আইএসপিআর জানায়, আন্তর্জাতিক জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী দিবস উপলক্ষে আজ সকালে শহীদ শান্তিরক্ষীদের স্মরণের মাধ্যমে দিবসের কর্মসূচি শুরু হবে এবং সকাল সাড়ে ১০টায় বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত অনুষ্ঠানে শহীদ শান্তিরক্ষীদের নিকট-আত্মীয় এবং আহত শান্তিরক্ষীদের জন্য সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংযুক্ত থাকবেন। এর আগে সকালে ‘শান্তিরক্ষী দৌড়-২০২২’ অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী উপস্থিত থাকবেন।

দিবসটির তাৎপর্য তুলে ধরে বিশেষ জার্নাল ও জাতীয় দৈনিকগুলোতে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশিত হবে এবং বাংলাদেশ টেলিভিশন, বাংলাদেশ বেতারসহ বিভিন্ন বেসরকারি চ্যানেলে বিশেষ টকশো প্রচার হবে। শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের কার্যক্রমের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্র বাংলাদেশ টেলিভিশনসহ অন্যান্য বেসরকারি চ্যানেলে প্রচার হবে।

সর্বশেষ খবর