রবিবার, ২৯ মে, ২০২২ ০০:০০ টা

টিকটক-লাইকিতে সর্বনাশ

লেখাপড়া ছেড়ে টিকটকে ব্যস্ত তরুণ প্রজন্ম, ভাইরাল হতে নিজের অশ্লীল ভিডিও তৈরি, টিকটক করায় খুন-তালাক, সেলিব্রেটি বানানোর নামে নারী পাচার-ধর্ষণ

শামীম আহমেদ

টিকটক-লাইকিতে সর্বনাশ

২৭ মে বেলা ২টা। রাজধানীর ভাটারা এলাকার একটি চায়ের দোকানে বসে এক যুবক ফোনে কাউকে বলছিলেন, ‘এখনি তোমার টিকটক ভিডিও ডিলিট করো। এগুলো কাকে দেখাও? ফাজলামির সীমা আছে।’ পরমুহূর্তে  ফোনে উচ্চ স্বরে কথা বলতে বলতে দোকান থেকে বেরিয়ে যান। পরের ঘটনা জানা না গেলেও গত বছর মে মাসে বাগেরহাটের দশানী এলাকায় টিকটক করা নিয়ে পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রী শ্রাবণী আক্তার সুমাকে (২০) হত্যা করে থানায় আত্মসমর্পণ করেন স্বামী আবদুল্লাহ নাহিন শান্ত (২৫)।

অন্যদিকে টিকটক করতে বাধা দেওয়ায় চলতি মাসের ৭ তারিখে নড়াইলের কালিয়ায় কীটনাশক পানে আত্মহত্যা করেন সুমি আক্তার (১৯) নামে এক তরুণী। স্থানীয়রা জানান, সুমি টিকটকে আসক্ত হয়ে পড়েন। জনপ্রিয়তা পেতে স্থানীয় ছেলেদের সঙ্গে ছবি ও ভিডিও তৈরি করে টিকটকে পোস্ট করতেন। এ নিয়ে মায়ের সঙ্গে ঝগড়া হলে সুমি আত্মহত্যা করেন। একইভাবে টিকটক করতে নিষেধ করায় গত বছর সেপ্টেম্বরে বগুড়ার  ধুনটে গলায় ফাঁস নিয়ে আত্মহত্যা করে সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী রাইসা আকতার (১৪)।

সম্প্রতি ঢাকার এক কলেজ শিক্ষকের সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, করোনার সময় অনলাইন ক্লাসের জন্য মেয়েকে মোবাইল কিনে দিই।  মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে। কিছুদিন আগে সহকর্মীরা আমাকে তার টিকটক ভিডিও দেখিয়ে বলছে, ‘মেয়ে তো বড় হয়ে গেছে। খেয়াল রাখবেন।’ ভিডিওর নিচে নানা অশ্লীল মন্তব্য। আত্মীয়-স্বজনরা ফোন করে নানা কথা বলছে। বাবা হিসেবে এর চেয়ে কষ্টের কী আছে? মানুষ আমাকে সম্মান করে, নানা পরামর্শ নেয়। সবার কাছে মাথা নিচু হয়ে গেছে। বাসায় গিয়ে মোবাইল নিয়ে নিয়েছিলাম। রাগ করে সে বিভিন্ন জিনিসপত্র ভাঙচুর করেছে। সারা দিন কিছু খায়নি। উল্টাপাল্টা কিছু করে ফেলবে ভয়ে মোবাইল ফিরিয়ে দিয়েছি। এসব অ্যাপ বন্ধ করে দেওয়া উচিত।

ভয়াবহ সামাজিক ক্যান্সারে রূপ নিয়েছে ‘টিকটক’ ও ‘লাইকি’র মতো ভিডিও শেয়ারিং সামাজিক মাধ্যমগুলো। এগুলো শুধু মাদকের মতো আসক্তিই সৃষ্টি করছে না, ভেঙে দিচ্ছে অনেক সংসার। ঘটছে খুনোখুনি। একই সঙ্গে নানা অপরাধের জন্ম দিচ্ছে। গত দুই বছরে টিকটক মডেল বানানোর লোভ দেখিয়ে অসংখ্য নারী পাচার, অনৈতিক কাজে ব্যবহার ও ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এ নিয়ে গত বছরই টিকটকের আড়ালে নানা অপরাধের মূলহোতা টিকটক হৃদয়, নদী আক্তার, বস রাফি, ম্যাডাম সাহিদাসহ প্রায় ২০০ জনকে আটক করা হয়। তারা অল্প বয়সী কিশোরী, তরুণী ও মধ্যবয়সী নারীদের ফাঁদে ফেলে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন, পতিতালয়ে বিক্রি, ভারতের বিভিন্ন হোটেলে আটকে দেহব্যবসা, পর্নো ভিডিও তৈরিসহ নানা অপরাধ করে আসছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, সারা দেশ থেকে টিকটকের আড়ালে এসব চক্রের মাধ্যমে কয়েক হাজার মেয়ে পাচার হয়েছে। রাফির মাধ্যমেই ৫ শতাধিক নারীকে পাচার করা হয়েছে। বাবা-মায়ের উঠতি বয়সী বখে যাওয়া তরুণ-তরুণী, প্রবাসীর স্ত্রী, হতাশাগ্রস্ত নারীরাই ছিল তাদের টার্গেট। টিকটকে যে মেয়েগুলোর আচরণ উগ্র তাদেরকে সহজে ফাঁদে ফেলা যেত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে অনেকে।

এদিকে সরকার বিভিন্ন পর্নোগ্রাফি ওয়েবসাইট বন্ধ করলেও বর্তমানে টিকটকেই হচ্ছে পর্নোগ্রাফির চর্চা। ভাইরাল হওয়ার নেশায় তরুণ-তরুণীরা কিছু না বুঝেই নিজেদের অশ্লীল ভিডিও তৈরি করে নিজেরাই ছড়িয়ে দিচ্ছে সারা বিশ্বে। সেখানে থাকছে খোলামেলা পোশাক, আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি ও কথা। অনেকে টিকটক গ্রুপে যোগ দিয়ে ছেলেদের সঙ্গে তৈরি করছেন অশ্লীল ভিডিও। এসব গ্রুপের মাধ্যমে চলছে মাদক বেচাকেনাও।

দ্রুত জনপ্রিয়তা পাচ্ছে টিকটক। ২০১৬ সালে চীনের তৈরি অ্যাপ্লিকেশনটি চালুর পর গতকাল পর্যন্ত শুধু গুগল প্লে স্টোর থেকেই ১০০ কোটির বেশি বার ডাউনলোড হয়েছে। প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, করোনার দুই বছরে সবচেয়ে দ্রুত বেড়েছে টিকটকের ব্যবহার। স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় ছেলেমেয়েরা বিনোদনের জন্য এটার ব্যবহার শুরু করে এখন আসক্তিতে পড়ে গেছে।

নিষিদ্ধ হচ্ছে দেশে দেশে : অনৈতিক ও অশ্লীল ভিডিও প্রচারের অভিযোগে গত বছর টিকটক নিষিদ্ধ করে ইরাক। এর আগে পাকিস্তান ও ভারতেও নিষিদ্ধ করা হয়।

এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, অনলাইনের ক্ষতিকর দিক থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে নিরাপদ রাখা আমার দায়িত্ব। এ জন্য পর্নো সাইটগুলো বন্ধ করেছি। কিন্তু ডিজিটাল মাধ্যমের সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া সম্ভব নয়। টিকটক ছাড়াও অসংখ্য কারণে দেশে আত্মহত্যা ঘটছে। আগেও নারী পাচার হয়েছে। সন্তানকে কীভাবে মানুষ করবেন, কীভাবে শাসন করবেন এ ব্যাপারে অভিভাবকদের সচেতন হতে হবে। কেউ টিকটকে আসক্ত হয়ে পড়ছে কি না, খারাপ কাজে ব্যবহার করছে কি না- অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে। টিকটকের বিরুদ্ধে বড় কোনো অভিযোগ এখনো পাইনি। কেউ রিপোর্ট করলে ব্যবস্থা নেব। তবে সামাজিক মাধ্যমগুলোর মধ্যে টিকটকই সবচেয়ে বাধ্য সংস্থা। তাদেরকে যে কোনো কনটেন্ট সরিয়ে নিতে বললে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর