বৃহস্পতিবার, ২ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

সৌদি-দুবাই হুন্ডির হোতারা চট্টগ্রামের

♦ ২৪০ কোটি টাকা মানি লন্ডারিং করে নামে-বেনামে অঢেল সম্পদ ♦ ফার্নিচার আর গ্লাস ব্যবসার ভাউচারে ২১ ব্যাংক হিসাবে লেনদেন ♦ পাচার হয়েছে ৭০০ কোটি টাকার বেশি

মাহবুব মমতাজী

সৌদি-দুবাই হুন্ডির হোতারা চট্টগ্রামের

সৌদি আরব আর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই কেন্দ্রিক শীর্ষ হুন্ডি ব্যবসায়ীর দুজনকে চিহ্নিত করেছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তারা হলেন, আবু আহাম্মদ ওরফে আবু এবং ইকবাল মোহাম্মদ ওরফে নেজাম ওরফে নিজাম। দুজনের বাড়িই চট্টগ্রামের ফটিকছড়িতে।

এরা প্রায় গত ১২ বছরে হুন্ডি আর সোনা চোরাচালানের মাধ্যমে ২৪০ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার ১৬০ টাকা মানি লন্ডারিং করে নামে-বেনামে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন। ফার্নিচার আর গ্লাস ব্যবসার ভাউচারে অন্তত ২১টি ব্যাংক হিসাবে হুন্ডির টাকা লেনদেন হয়েছে। এভাবে প্রায় ৭২১ কোটি টাকার বেশি পাচার হয়েছে। সিআইডির পুলিশ পরিদর্শক সাদেক আলীর দেওয়া এক চার্জশিটে তাদের বিরুদ্ধে এসব তথ্য পাওয়া গেছে। তিনি গত ৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম আদালতে এই চার্জশিট দাখিল করেছেন।

এর আগে চট্টগ্রাম মহানগরের কোতোয়ালি থানায় ২০২০ সালের ১৮ মার্চ তাদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা করেন সিআইডির এসআই হারুন উর রশীদ। ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরের তামাকুণ্ডু লেনে গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে সিন্দুক ভর্তি সোনা ও টাকা জব্দের ঘটনায় অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্যে এ মামলা হয়। মামলায় আবু ও নেজাম ছাড়াও আবু রাশেদ, আসিফুর রহমান, ওবায়দুল আকবর, রফিক, মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন বাবলু, ইমরানুল হক মো. কপিল চৌধুরী, এমতিয়াজ হোসেন, মোহাম্মদ আলী, ফরিদুল আলম, মোহাম্মদ এরশাদুল আলম, হাসান, রুবেল চক্রবর্তী, মিনহাজ উদ্দীন, সাগর মহাজন, দিনবন্ধু সরকার, আলতাফ হোসেন চৌধুরী, শাহজাহান, টিটু ধর এবং খোরশেদ আলমসহ আরও ১৯ জনকে আসামি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (ফাইন্যান্সিয়াল ক্রাইম) হুমায়ুন কবির এ প্রতিবেদককে জানান, মামলা পাওয়ার পরই হুন্ডি চোরাচালানদের বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেন। আর এভাবে আইনি ব্যবস্থা নেওয়াতে দেশের অর্থনীতির ক্ষতি কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। ওই মামলায় গ্রেফতার হওয়া আবু রাশেদ, ওবায়দুল আকবর, মোহাম্মদ জিয়া উদ্দিন বাবলু, ইমরানুল হক মো. কপিল চৌধুরী, এমতিয়াজ হোসেন, মোহাম্মদ আলী, ফরিদুল আলম, মোহাম্মদ এরশাদুল আলম, হাসান, রুবেল চক্রবর্তী, সাগর মহাজন এবং টিটু ধরসহ মোট ১২ জন হুন্ডি ব্যবসায় সম্পৃক্ততার কথা জানিয়ে আদালতে বিভিন্ন সময়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ তদন্তভার নেওয়ার পর থেকে সিআইডি যা জানতে পারে, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড থেকে মামলার আসামিদের আয়করের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে আবু আহাম্মদের নামে ২০০৫ সালের ৩ এপ্রিল থেকে ২০১৭ সালের ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত কেনা ৩২টি জমির দলিল পাওয়া যায়। এগুলোর মূল্য প্রায় ৭ কোটি ৪০ লাখ ৩৯ হাজার টাকা। এর মধ্যে একটি ছয় তলা বাড়ি, একটি ১০ তলা নির্মাণাধীন বাড়ি এবং দ্বিতীয় তলা বিশিষ্ট একটি পল্লীকানন কনভেনশন (কমিউনিটি) সেন্টার রয়েছে। ২১টি ব্যাংক হিসাবে সর্বমোট প্রায় ৭২১ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৮০০ টাকা জমা হয়। আর ৭১৯ কোটি ৯১ লাখ ৮৩ হাজার ৯৭২ টাকা উত্তোলন করা হয়। মামলার তদন্তকালে প্রায় ১ কোটি ২৫ লাখ ৫৫ হাজার ৮২৮ কোটি টাকা স্থিতি পাওয়া যায়। ২০১৯ সালের ৭ নভেম্বর থেকে ওইসব ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করে রাখা হয়েছে।

ফার্নিচার আর গ্লাস ব্যবসার ভাউচারে হুন্ডির টাকা লেনদেন : সিআইডির তদন্তে জানা যায়, আবু আহাম্মদ একসময় সামান্য সিগারেটের দোকানদার ছিলেন। এরপর কাজের জন্য দুবাই চলে যান। সেখানে থাকার একপর্যায়ে সে সোনা চোরাচালান ও অবৈধ হুন্ডি ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন। তিনি দেশি ও বিদেশি মুদ্রা পাচার বা হুন্ডি ব্যবসাকে আড়াল করতে ফরহাদ ট্রেডিং, রিয়াল ট্রেডিং, নাইস টেলিকম সেন্টার, রুপা টেলিকমিউনিকেশন, রিয়েল ট্রেডিং, এমএস ওয়ার্ল্ড সেন্টার, ফরহাদ ট্রেডিং, এবি ট্রেড ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব পরিচালনা করেন। এসব প্রতিষ্ঠানের নামে খোলা ব্যাংক হিসাবে বিভিন্নস্থান থেকে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা ফার্নিচার ব্যবসা, অটোমোবাইল, স্পাইস, গ্লাস, মোবাইলফোন এবং কয়লা ব্যবসার ভাউচার দিয়ে লেনদেন করেন। অথচ সরেজমিন তদন্ত কর্মকর্তারা ফরহাদ ট্রেডিং ছাড়া কোনো ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাননি। মামলার আসামি ফরিদুল আলম তার জবানন্দিতে জানিয়েছেন, তার সহোদর খোরশেদ আলমের কথামতো তিনি আবু আহাম্মদ ও নেজামের কাছ থেকে ব্যাংক চেক আনতেন। মোবাইলে মেসেজ দিয়ে খোরশেদ তাকে জানাতেন কাকে কত টাকা দিতে হবে। পরে ব্যাংক চেক ভাঙিয়ে বিভিন্ন জনকে টাকা দিতেন।

আবু আহাম্মদ নেজামের নামে আরও যেসব মামলা : ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকার বিমানবন্দর থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে একটি মামলা হয়। মামলা নম্বর ৫৬। এ মামলার চার্জশিট দেওয়া হয়েছে ২০২০ সালের ১২ জানুয়ারি। ৯০৪ পিস সোনার বার জব্দের ঘটনায় মামলাটি হয়। ২০১৬ সালের ২৬ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরের কোতোয়ালি থানায় বিশেষ ক্ষমতা আইনে আরেকটি মামলা হয়। মামলা নম্বর ৫১। সে সময়ের ৬০ লাখ টাকার ২৫০ পিস সোনার বার জব্দের ঘটনায় মামলাটি হয়। ২০১৪ সালের ২৬ ডিসেম্বর ঢাকার পল্টন থানায় আবুর নামে একটি মামলা হয়। মামলা নম্বর ৪০। ২০১৬ সালের ২ নভেম্বর এ মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এই মামলাও হয়েছে ৫২৮ পিস সোনার বার এবং ৩ কোটি ৫৬ লাখ সমপরিমাণ সৌদি রিয়েল ও ৫ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা জব্দের ঘটনায়। ২০১৬ সালের ২০ নভেম্বর শাহবাগ থানায় আরেকটি মামলা হয়। মামলা নম্বর ২৮। এ ছাড়া ইকবাল মোহাম্মদ ওরফে নেজামের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা মডেল থানায় ২০০৭ সালের ৫ অক্টোবর মামলা হয়। মামলা নম্বর ৩। ২০০৮ সালের ৭ এপ্রিল এ মামলায় চার্জশিট দেওয়া হয়েছে। এতে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার আনার অভিযোগ করা হয়। এদের চক্র হুন্ডি, সোনা চোরাচালান, চোরাই ও অন্যান্য দ্রব্যের অবৈধ ব্যবসার সর্বমোট ২০৪ কোটি ৩৭ লাখ ৪৫ হাজার ৮৬৭ টাকা জমা এবং ২৪০ কোটি ৫ লাখ ১২ হাজার ১৬০ টাকা উত্তোলন করে মানি লন্ডারিং করেছে।

৭০০ কোটি টাকা পাচার : তাদের ২১টি ব্যাংক হিসাবে সর্বমোট প্রায় ৭২১ কোটি ১৭ লাখ ৩৯ হাজার ৮০০ টাকা জমা ও প্রায় সমপরিমাণ টাকা উত্তোলন করে বিদেশে পাচার করেছে বলে সিআইডির তদন্ত কর্মকর্তারা পেয়েছেন। ব্যাংক লেনদেনকালে প্রতিবারে ১০ লাখ, ৯ লাখ ৫০ হাজার, ১৫ লাখ, ২০ লাখ ও ৩০ লাখসহ বিভিন্ন পরিমাণ টাকা জমা ও উত্তোলন করা হয়েছে। এদের চক্রের অন্য সদস্যরা সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই ও সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে থাকা প্রবাসী শ্রমিকদের কাছ থেকে বাংলাদেশে পাঠানোর জন্য বৈদেশিক মুদ্রা সংগ্রহ করে। সেই মুদ্রা দেশে না পাঠিয়ে বিদেশে রেখে চোরাচালান (স্বর্ণ চোরাচালান) কাজে ব্যবহার করে। অপরদিকে বাংলাদেশ থেকে বিদেশে টাকা পাচারকারীদের কাছ থেকে সমপরিমাণ টাকা আবু আহাম্মদ ও নেজাম তাদের ২১টি ব্যাংক হিসাবে জমা নেয়। পরে এদেশে সংগ্রহ করা টাকা প্রবাসীদের পরিবারের লোকদেরকে নগদে প্রদান করে।

হুন্ডি লেনদেনে যাদের যেসব ছিল ভূমিকা : জিয়া উদ্দিন বাবলু গত ২০১৩ সাল থেকে ২০১৫/২০১৬ সাল পর্যন্ত চট্টগ্রাম রিয়াজ উদ্দিন বাজারে আবু আহম্মেদের ফরহাদ ট্রেডিং নামের দোকানে সেলসম্যান হিসেবে চাকরি করতেন। তিনি চাকরিকালে আবু আহম্মেদ ও আবু আহম্মেদের চাচাতো ভাই নেজামের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব নম্বর থেকে অনুমান দেড় কোটি টাকা উত্তোলন করেন, যা হুন্ডির ব্যবসা ও স্বর্ণ চোরাচালান ব্যবসার টাকা। এমতিয়াজ হোসেন ২০১৪ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আবু আহম্মেদ ও নেজামের ঢাকার শান্তিনগরের অফিসে চাকরি করার সময় তাদের বিভিন্ন ব্যাংক হিসাব নম্বরে অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার অনুমান ৩ কোটি টাকা জমা দেন। মোহাম্মদ আলী তার মোবাইল নম্বর (০১৮১৯১৮০০১৭) ব্যবহার করে আবু আহাম্মেদ ও নেজামের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে ২/৩ বারে হুন্ডি ব্যবসার অনুমান ৩০/৩৫ লাখ টাকা উত্তোলন করেন। আর ফরিদুল আলম সৌদি প্রবাসী খোরশেদ আলমের ছোট ভাই। খোরশেদ আলম বিদেশে অবস্থানরত প্রবাসীদের অর্জিত অর্থ বাংলাদেশে রেমিট্যান্স হিসাবে দেশে না পাঠিয়ে আবু আহাম্মেদের চোরাচালানির অবৈধ ব্যবসায় হস্তান্তর ও রূপান্তর করতেন। টিটু ধর পুরাতন সোনা ক্রয়-বিক্রয়লব্ধ ২০ লাখ টাকা ব্যাংকে লেনদেনের কথা স্বীকার করেন। ওবায়দুল আকবর ব্র্যাক ব্যাংকের ৪টি চেকে অবৈধ হুন্ডি ব্যবসার মোট ৩৮ লাখ ৩৮ হাজার টাকা উত্তোলন করার কথা স্বীকার করেছেন। আবু রাশেদ ব্যাংকে হুন্ডি ব্যবসার ২/৩ কোটি টাকা কিংবা এর বেশি পরিমাণ টাকার ব্যাংক চেক ক্যাশ করার কথা স্বীকার করেছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর