শুক্রবার, ৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

ডেল্টা লাইফের দুর্নীতি অনিয়মের তদন্ত হচ্ছে

বিশেষ প্রতিনিধি

অডিটে উঠে এলো শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্সের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের তথ্য। সম্প্রতি বীমা খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বীমা উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ (আইডিআরএ) থেকে কোম্পানিটিতে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়ার পর নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান দিয়ে এই অডিট পরিচালনা করা হয়।

প্রশাসকের অধীনে নিয়োজিত নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর দেওয়া অডিট প্রতিবেদনে কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ ও বরখাস্ত করা পরিচালনা পর্ষদের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে উল্লেখ করা হয়েছে। নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদনে বলছে, কোম্পানির ডাটা বেস থেকে বিপুল পরিমাণ তথ্য মুছে ফেলা হয়েছে যা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ব্যাংক স্টেটমেন্ট, ব্যাংক বুক, ব্যাংক রিকন্সিলিয়েশন না থাকার কারণে ২ হাজার ২০০টি হিসাবে ব্যাংক ব্যালেন্স নিশ্চিত করা যায়নি।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, ভুয়া এজেন্ট কমিশন এবং জাল ভাউচারের মাধ্যমে ৫ কোটি ১৪ লাখ ৬২ হাজার ৭৯ টাকা আত্মসাৎ, ম্যানুপুলেশনের মাধ্যমে ২ হাজার ৫১৩ কোটি ৮৪ হাজার ৩৫০ টাকা দাবির প্রভিশন কম দেখিয়ে অতিরিক্ত লভ্যাংশ নেওয়ার মাধ্যমে কোম্পানির আর্থিক ক্ষতিসাধন এবং সরকারি রাজস্ব ফাঁকি দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি।

নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিবেদনে আরও জানানো হয়, ৮৯ লাখ ৪৯ হাজার ৭৮৫ টাকা রিটায়ারমেন্ট বেনিফিট প্রভিশন না করে অতিরিক্ত লভ্যাংশ প্রদান করা হয়েছে, মঞ্জুরুর রহমানের ব্যক্তিগত ‘রেমা টি’ নামক কোম্পানিতে ডেল্টা লাইফের ১৪ লাখ ২০ হাজার টাকা মূল্যমানের গাড়ি ব্যবহার এবং গাড়িটির রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় হয়েছে ৯০ লাখ ১৩ হাজার ৩৬৯ টাকা। কতিপয় কর্মকর্তা মঞ্জুরুর রহমানের ব্যক্তিগত কোম্পানিতে কাজ করেছেন অথচ বেতন নিয়েছেন ডেল্টা লাইফ থেকে, যার পরিমাণ ৪ কোটি ৪২ লাখ ৭৮ হাজার ৭৮ টাকা, বীমা আইন পরিপন্থী ট্রাস্ট গঠনের মাধ্যমে কোম্পানির ৭৮ লাখ টাকার ফান্ড স্থানান্তর করা হয়।

তারা আরও বলছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন ব্যতীত বিদেশি নাগরিকের মাসিক বেতন ১০ লাখ টাকা থেকে শুরু করা হত। প্রতি মাসে ৩ লাখ থেকে ৪ লাখ টাকা কোনো কারণ ছাড়াই কোম্পানির কর্মকর্তারা পুনরায় নগদে গ্রহণ করতেন। হিসাবভুক্ত না করে নগদে বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রদান এবং সন্দেহজনক ৮৮ লাখ ৪ হাজার ৮২৪ টাকা নগদ উত্তোলন করা হয়। পরিচালক ব্যক্তিগত প্রয়োজনে কোম্পানির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয় এমন ব্যক্তিসহ বিদেশ ভ্রমণের মাধ্যমে কোম্পানির ১ কোটি ১০ লাখ ৬ হাজার ৫২২ টাকার তহবিলের অপব্যবহার করেন।

অডিট প্রতিবেদন বলছে, কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অমান্য করে প্রতিষ্ঠানটির প্রাক্তন সিইও আদিবা রহমান ১৫ লাখ ৯৪ হাজার ৯৩ টাকার বেতন গ্রহণ করেন, ক্রয় নীতি না মেনে ভারত থেকে সফটওয়্যার ক্রয়ের মাধ্যমে পলিসি গ্রাহকের তহবিলের ৩ কোটি ৭০ লাখ ৮৩ হাজার ১৬৯ টাকা ক্ষতিসাধন করা হয়, আয়কর ফাঁকি দেওয়ার জন্য ব্যবস্থাপনা ব্যয়কে ভুল খাতে হিসাবভুক্তকরণ এবং আয়কর বাবদ ৩৮৫ কোটি ৭২ লাখ ৩৪ হাজার ১৮৪ টাকা বকেয়া রাখা বা ফাঁকি দেওয়া হয়।

তারা বলছে, বিএসইসির আরোপিত ব্যক্তিগত জরিমানা ৬ লাখ ৮৬ হাজার ২৫০ টাকা কোম্পানি থেকে প্রদান করা হয়েছে। ডেলিস্টেড এবং ওটিসি শেয়ার ক্রয় করে কোম্পানির আর্থিক ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। শেয়ারের ক্লোজিং ব্যালান্সে ১ কোটি ৩৩ লাখ ৪০ হাজার ৯৪৬ টাকার গরমিল পাওয়া গেছে। কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা লঙ্ঘন করে কোম্পানির সম্পদ তথা গাড়ির অপব্যবহারের মাধ্যমে পলিসি গ্রাহকের তহবিলের ৪ কোটি ৮৩ লাখ ১৩ হাজার ৪৭৪ টাকার ক্ষতিসাধন করা হয়েছে।

এ ছাড়াও বীমা পলিসি গ্রাহকদের মেয়াদ উত্তীর্ণ বীমা দাবি এবং মৃত্যু দাবির পাওনা বাবদ ১৩৮ কোটি টাকা দীর্ঘদিন ধরে বকেয়া রেখে বীমা পলিসি গ্রাহকদের স্বার্থ ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। যা প্রশাসক নিয়োগের পর পরিশোধ করা হয়েছে বলে জানানো হয়েছে। তাছাড়া কর্পোরেট গভর্নেন্স সংক্রান্ত গুরুতর বিভিন্ন অনিয়মও পাওয়া গেছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে। এগুলো হলো- একই পরিবার কর্তৃক কোম্পানির ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ শেয়ারধারণ; একই পরিবার থেকে দুজনের অধিক সদস্য নিয়ে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ গঠন; এজিএমে কোম্পানির কর্মকর্তাদের মাধ্যমে এজেন্ডা প্রস্তাব ও সমর্থন করানো; কারণ ছাড়া সময়ে সময়ে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদের আকার কমানো; কম্পানির প্রাক্তন চেয়ারম্যান মঞ্জুরুর রহমানের নিয়ম বহির্ভূতভাবে কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ এবং অডিট কমিটিতে উপস্থিত থাকা; বিকল্প পরিচালক নিয়োগ আইনের ব্যত্যয়; আনক্লেইমড ডিভিডেন্ড ব্যাংক হিসাবে না থাকা; কোম্পানির পরিচালককে লভ্যাংশ প্রদানে অনিয়ম। কোম্পানির তৎকালীন ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ এবং বরখাস্ত করা পরিচালনা পর্ষদের বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের পরিমাণ প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, বীমা কোম্পানিটির অনিয়ম, দুর্নীতি ও অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে নিরীক্ষা প্রতিবেদন ও সংশ্লিষ্ট প্রমাণ দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। এরপর অনুসন্ধানের জন্য সংশ্লিষ্ট রেকর্ডপত্র/তথ্যাদি সরবরাহকরণের জন্য দুদক থেকে ডেল্টা লাইফের প্রশাসককে পত্র দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। তবে ডেল্টা লাইফের প্রাক্তন পরিচালনা পর্ষদ বা ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে এখনো তলব করা হয়নি।

সর্বশেষ খবর