শনিবার, ৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
মতিঝিলে টিপু হত্যাকাণ্ড

শুটার মুসা ওমানে গ্রেফতার

সাখাওয়াত কাওসার

শুটার মুসা ওমানে গ্রেফতার

ওমানের মাসকাটে আটক হয়েছেন রাজধানীর মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুল ইসলাম টিপু ও কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান প্রীতি হত্যার প্রধান সন্দেহভাজন সুমন শিকদার ওরফে মুসা। আন্তর্জাতিক পুলিশ সংস্থা ইন্টারপোলের সহায়তায় মুসাকে আটক করা হয়। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে ৬ জুন ওমান যাচ্ছে পুলিশের তিন সদস্যের একটি দল। এদিকে ওমানে মুসা আটকের বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম। নির্দিষ্ট করে কোনো তারিখের বিষয়ে না বললেও তাঁর দাবি, আগামী সপ্তাহে তিন সদস্যের দল ওমানে যাবে।

একাধিক সূত্র বলছেন, টিপু হত্যা মিশনের সব ঠিকঠাক করে ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করেছিলেন মুসা। আন্ডারওয়ার্ল্ডে তিনি ‘শুটার মুসা’ নামে পরিচিত। জোড়া খুনের তদন্তে তার নাম আসার পরই নড়েচড়ে বসেছিলেন গোয়েন্দারা। এরপর দেখা যায় কিলিং অপারেশনের ১২ দিন আগে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর হয়ে তিনি পালান। এরপর বাংলাদেশ পুলিশের পক্ষ থেকে তাকে বিদেশ থেকে ফেরানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়। মুসা প্রথমে দুবাই গেলেও পরে সেখান থেকে ওমান পালিয়ে যান। এরপর এনসিবি, ঢাকা ১০ মে এনসিবি, মাসকাটকে গ্রেফতারের অনুরোধ করে। পরে মুসাকে গ্রেফতারের বিষয়টি এনসিবি, মাসকাট ১৭ মে ঢাকা এনসিবিকে অবহিত করে। সবশেষ ৩০ মে পুলিশ সদর দফতর বিধি মোতাবেক ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহিদুর রহমান, এডিসি রফিকুল ইসলাম ও পুলিশ সদর দফতরের সহকারী পুলিশ সুপার মোহাম্মদ ফয়েজ উদ্দীনের সমন্বয়ে একটি টিমকে ওমান যাওয়ার সম্মতি প্রদান করে।

জানা গেছে, সুমন শিকদার হিসেবে পাসপোর্ট নিয়েছেন মুসা। সেখানে বাবার নাম আবু সাঈদ শিকদার। মা জরিনা আক্তার। স্ত্রী নাসিমা আক্তার। গ্রাম কইখাইন, পরাইখারা, আনোয়ারা, চট্টগ্রাম। তার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামে। ইমিগ্রেশনের তথ্য বলছে, ভ্রমণ ভিসায় বৈধ পথেই দেশ ছেড়েছেন মুসা। একসময় মুসা মিরপুরকেন্দ্রিক সন্ত্রাসী থাকলেও ধীরে ধীরে ঢাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তার নামে কেবল পল্লবী ও মতিঝিল থানায় ১১টি হত্যা, অস্ত্র, মাদক ও চাঁদাবাজি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে কেবল পল্লবী থানায়ই ১০টি মামলা। সবশেষ শাহজাহানপুরে দায়ের করা টিপু হত্যা মামলার এজাহারে মুসার নাম না থাকলেও তদন্তে উঠে এসেছে তার জড়িত থাকার তথ্য। টিপু হত্যার প্রধান শুটার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ এরই মধ্যে ফৌজদারি কার্যবিধি আইনের ১৬৪ ধারা মোতাবেক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। সেখানে মুসার জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে এসেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এ ছাড়া বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসী বিকাশ-প্রকাশের আস্থাভাজন হিসেবে আন্ডারওয়ার্ল্ডে তার সুখ্যাতি রয়েছে।

এদিকে মুসা আটকের খবরে স্বস্তি প্রকাশ করেছেন নিহত টিপুর স্ত্রী ও হত্যা মামলার বাদী ফারহানা ইসলাম ডলি। গতকাল তিনি এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘মুসাকে ফিরিয়ে আনতে পারলে আমার স্বামী হত্যায় জড়িত মদদদাতা, আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা, অর্থ সরবরাহকারী- সবার মুখোশ উন্মোচিত হবে। ন্যায়বিচার পাওয়ার পথ তৈরি হবে। একজন বিধবা নারী হিসেবে ওমান সরকারের কাছেও আমার এ অনুরোধ থাকবে যেন তারা আমার স্বামী হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী মুসাকে ফিরিয়ে দেন।’

গতকাল বিকালে পুলিশ সদর দফতরের এনসিবি শাখার সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) মহিউল ইসলাম বলেন, চলতি সপ্তাহেই পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে দু-তিন সদস্যের একটি টিম ওমানে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবকিছু ঠিক থাকলে শিগগিরই মুসাকে নিয়ে দেশে ফিরবেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওমানের সঙ্গে বাংলাদেশের বন্দিবিনিময় চুক্তি নেই। মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট সিস্টেমও দীর্ঘ প্রক্রিয়ার ব্যাপার। কাজেই ইন্টারপোলের নিয়মের মধ্যে থেকে এনসিবি টু এনসিবির সুসম্পর্কের ভিত্তিতে এসকর্টের মাধ্যমে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে দুই দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহায়তা নেওয়া হবে।

২৪ মার্চ রাত ১০টার দিকে শাহজাহানপুরের আমতলায় অস্ত্রধারীর গুলিতে নিহত হন গাড়িতে থাকা মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক টিপু। এলোপাতাড়ি গুলিতে আহত হন গাড়ির পাশে রিকশায় থাকা ২৪ বছর বয়সী কলেজছাত্রী প্রীতি। পর দিন টিপুর স্ত্রী ফারজানা ইসলাম ডলি শাহজাহানপুর থানায় মামলা করেন। মামলায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তিদের আসামি করা হয়। তবে সবশেষ তদন্তে উঠে এসেছে ১২ জন আসামির নাম। ২৬ মার্চ রাতে বগুড়া থেকে এডিসি শাহিদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল প্রধান শুটার মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশকে গ্রেফতার করে। তার দেওয়া তথ্যানুযায়ী আবৃত্তিকার আহকাম উল্লাহর ছোট ভাই যুবলীগ নেতা এরফান উল্লাহ দামালকে গ্রেফতার করা হয়। খুনের এক সপ্তাহ পর র‌্যাব এ ঘটনায় মতিঝিলের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক (৫২), আবু সালেহ শিকদার ওরফে শুটার সালেহ (৩৮), নাছির উদ্দিন ওরফে কিলার নাছির (৩৮) ও মোরশেদুল আলম ওরফে কাইলা পলাশকে (৫১) গ্রেফতার করে।

তদন্তকারী দলের সুপারভাইজার ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) রিফাত রহমান শামীম বলেন, ‘হত্যাকাণ্ডের প্রধান শুটার আকাশ স্বীকার করেছেন তার সঙ্গে কেবল মুসার কথা হতো। তার নির্দেশেই তিনি কাজটি করেছেন। মুসাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হলে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য আদায় করা সম্ভব হবে বলে আশা করছি।’

র‌্যাব জানায়, ঘটনার তিন-চার মাস আগে টিপু হত্যার পরিকল্পনা হয়। এর পেছনে কাজ করেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ১০ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে শীর্ষ সন্ত্রাসী বিকাশ-প্রকাশের অন্যতম শুটার ও বোচা হত্যা মামলার আসামি সুমন শিকদার ওরফে মুসার সঙ্গে ১৫ লাখ টাকার চুক্তি করেন ওমর ফারুক। প্রাথমিকভাবে দেওয়া হয় ৯ লাখ টাকা। টাকার বড় একটি অংশের জোগান দেন ওমর ফারুক। হত্যাকাণ্ডের ঠিক ১২ দিন আগে সবকিছু ঠিক করে ১২ মার্চ দুবাইয়ে চলে যান মুসা।

একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা জানান, টিপুকে খুন করতে শুটার হিসেবে মাসুম মোহাম্মদ আকাশ ও শামীমকে ভাড়া করেন মুসা। মূলত আকাশ ও মাসুম দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। টিপুকে হত্যার ছক চূড়ান্ত করার পর ঢাকায় যে পরিকল্পনা বৈঠক হয় সেখানে মুসা, শামীম, ফ্রিডম মানিকসহ চার-পাঁচ জন ছিলেন। কার কী দায়িত্ব তা ভাগ করে দেন মুসা। আকাশকে অস্ত্র ও মোটরসাইকেল সরবরাহ করেন তিনি।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর