বুধবার, ৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বহুমুখী সংকটের মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি

রাবি প্রতিনিধি

বহুমুখী সংকটের মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর অধ্যাপক ড. আতিউর রহমান বলেছেন, বড় ও বহুমুখী সংকটের মুখে বৈশ্বিক অর্থনীতি। মহামারির কারণে আগে থেকেই খাদ্য সংকট ছিল।

বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনগুলোও করোনার কারণে ঝুঁকিতে ছিল। এরপরে পুনরুদ্ধার শুরু হতে না হতেই অনাকাক্সিক্ষত রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ। এর ফলে সাপ্লাই চেইনগুলোতে ঝুঁকি আরও বেড়েছে। তেলসহ সব ধরনের জ্বালানির মূল্য বেড়েছে। খাদ্যপণ্যেরও মূল্য বেড়েছে। সার্বিক মূল্যস্ফীতিতে চাপে পড়েছে মানুষ।

গতকাল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) আয়োজিত ‘বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশের বাস্তবতা’ শীর্ষক সেমিনারে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সিনেট ভবনে অনুষ্ঠিত হয় সেমিনারটি। বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার অধ্যাপক আবদুস সালামের সঞ্চালনায় সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন রাবি উপাচার্য অধ্যাপক গোলাম সাব্বির সাত্তার, উপ-উপাচার্য অধ্যাপক চৌধুরী মো. জাকারিয়া ও কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক (অব.) অবায়দুর রহমান প্রামাণিক। সভাপতিত্ব করেন রাবির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক সুলতান-উল-ইসলাম। ড. আতিউর রহমান বলেন, মুদ্রার অবমূল্যায়নের ফলে সব দেশেই জনসাধারণ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়েছে। ব্রাজিলে মাঠে ফসল থাকলেও শহরাঞ্চলে খাদ্যের দাম উচ্চ। জীবনযাপনের ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নিউজিল্যান্ডের মানুষ পাড়ি জমাচ্ছে অস্ট্রেলিয়ায়।

ঘানায় পানির দাম বেড়ে যাওয়ায় রেস্টুরেন্ট ব্যবসায় ধস। ইতালির ইস্পাত শিল্পে ক্রয় আদেশ থাকলেও ইউক্রেন থেকে কাঁচামাল না আসায় বিপাকে উদ্যোক্তারা। থাইল্যান্ডের চালের রপ্তানি চাহিদা থাকলেও আমদানি করা সারের উচ্চমূল্যে কৃষকরা চাপে আছেন।

তিনি বলেন, সংকট মোকাবিলায় গত ১২ মাসে প্রায় সব অর্থনীতিতেই নিজস্ব মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়। চীনের মুদ্রার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৫ শতাংশ। ভারতে ডলারের বিপরীতে রুপির দাম কমেছে ৬ শতাংশ। গ্রেট ব্রিটেনের পাউন্ডের পতন হয়েছে ১২ শতাংশ। ইউরোর পতন আরও বেশি ১৪ শতাংশ।

এমন সংকটের দৃষ্টান্ত সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিরল উল্লেখ করে তিনি বলেন, এপ্রিল ২০২০ থেকে মার্চ ২০২২ এ জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে চার গুণ। এ সময়ে সারের দাম বেড়েছে ২২০ শতাংশ, অর্থাৎ, তিন গুণেরও বেশি। যেসব খাদ্যপণ্য রাশিয়া ও ইউক্রেনে বেশি উৎপন্ন হয়, সেগুলোর দাম বেড়েছে ৮৪ শতাংশ অর্থাৎ, প্রায় দ্বিগুণ।

মূল্যস্ফীতির চাপ দক্ষিণ এশিয়াতে কিছুটা বেশি উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, শ্রীলঙ্কা ও ভারতের কনজুমার প্রাইস ইনডেক্স ইনফ্লেশন ২১ শতাংশ এবং ৮ শতাংশ। বাংলাদেশ এ বৃদ্ধি তুলনামূলক কম। তবুও ৬% পেরিয়ে গেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত লক্ষ্য ৫.৩% এর চেয়ে বেশি।

বিশ্ব সংকটের প্রভাব বাংলাদেশেও পড়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, পণ্য আমদানির ব্যয় বেড়ে গেছে। আগের বছরের তুলনায় রপ্তানি এখন পর্যন্ত বর্ধিষ্ণু থাকলেও বৈশ্বিক মন্দার কারণে ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধির আশঙ্কাও দেখা যাচ্ছে। খাদ্যপণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে তুলনামূলক কম আয়ের মানুষেরা বিপাকে পড়েছেন। একদিকে আমদানি কমানোর চাপ রয়েছে, অন্যদিকে পুনরুদ্ধার বেগবান রাখাও দরকার।

তিনি আরও বলেন, করোনাকালে দেওয়া ব্যাপক প্রণোদনার কারণে ২০২০ সাল থেকেই বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির আশঙ্কা ছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনার কারণে চীনে শিল্প-কারখানা বন্ধ থাকা এবং অন্যান্য কারণে সাপ্লাই চেইন ডিজরাপশন, করোনাকালে সেবা খাতের তুলনায় পণ্য খাতে বেশি ব্যয় এবং সর্বশেষ রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ।

বাংলাদেশের বর্তমান সংকটটি মূলত আমদানিকৃত মূল্যস্ফীতির উল্লেখ করে তিনি বলেন, বর্তমানে আমাদের মাসিক বাণিজ্য ঘাটতি ২.৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যদিও রেমিট্যান্স কিছুটা বাণিজ্য ঘাটতি সামাল দিচ্ছে। তারপরও মাসিক নিট বাণিজ্য ঘাটতি ১.৫৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক এই গভর্নর আরও বলেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের জন্য বাজারে ডলার ছেড়ে ব্যবসা-বাণিজ্য চাঙা রাখার পদ্ধতিটি কাজে দিলেও নতুন সংকটের প্রেক্ষাপটে নীতিতে পরিবর্তন জরুরি হয়ে পড়েছে। এ অবস্থায় যথেষ্ট সংবেদনশীলতার পরিচয় দিচ্ছে বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ব্যাংক। মে মাসের তিন সপ্তাহে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ২.৫৫ শতাংশ, যেটা অন্য অধিকাংশ দেশের চেয়ে কম। ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সংগঠন ও ফরেন এক্সচেঞ্জ ডিলারস অ্যাসোসিয়েশনকে সঙ্গে নিয়ে অংশগ্রহণমূলক পদ্ধতিতে এগোনো হচ্ছে। তবে, দুষ্টচক্রের সুযোগসন্ধানী তৎপরতা এড়াতে মনিটরিং জোরদার করা দরকার।

সর্বশেষ খবর