সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

সীতাকুন্ডে আগুনে মৃত্যু বেড়ে ৪৮

নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম

চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আহতদের মধ্যে আরও দুজনের মৃত্যু হয়েছে। গতকাল সকাল এবং দুপুরে তাদের মৃত্যু হয়। এর মধ্যে একজন ঢাকায় ও একজন চট্টগ্রামে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। ফলে বিস্ফোরণের ঘটনায় প্রাণহানি বেড়ে দাঁড়াল ৪৮ জনে। এদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় আহতদের মধ্যে ৬৩ জন চোখ নিয়ে টেনশনে আছেন। তারা কোনো না কোনোভাবে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছেন। অন্যদিকে বিস্ফোরণের ঘটনায় বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের তদন্ত কমিটি আরও পাঁচ কর্মদিবস বৃদ্ধির আবেদন করে।

জানা যায়, বিস্ফোরণে দগ্ধ হয়ে গাউছুল আজম (২২) নামে ফায়ার সার্ভিসের এক কর্মী আহত  হন। ওই দিনই তাকে ঢাকার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে ভর্তি করা হয়। আট দিন পর তিনি গতকাল ভোরে লাইফ সাপোর্টে মারা যান। নিহত গাউসুল আজম যশোর জেলার মনিরামপুর গ্রামের আজগর আলীর ছেলে। তার ছয় মাস বয়সী ছেলে সন্তান আছে। তিনি চাকরিতে যোগদান করেন ২০১৮ সালে।

ইনস্টিটিউটের আবাসিক সার্জন ডা. এস এম আইউব হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, গাউছুল আজমের শরীরের ৭০ শতাংশ দগ্ধ ছিল। পুড়ে গিয়েছিল তার শ্বাসনালি। বর্তমানে ১৯ জন রোগী ভর্তি আছেন। এর মধ্যে আইসিইউতে দুজন। এদিকে চট্টগ্রামে বেসরকারি হাসপাতাল পার্কভিউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান ডিপোতে গাড়ির মেকানিক নুরুল কাদের (২২)। গতকাল দুপুরে তার মৃত্যু হয়। তিনি বাঁশখালীর পূর্ব চেচুরিয়ার এ কে এম ফাইজুর রহমান চৌধুরীর ছেলে। পার্কভিউ হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ডা. এ টি এম রেজাউল করিম বলেন, আগুনে নুরুল কাদেরের শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে যায়। সকাল থেকে তার কন্ডিশন ভালো ছিল না। তাকে লাইফ সাপোর্টও দেওয়া হয়েছিল। সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, সীতাকুন্ডে বিস্ফোরণের ঘটনায় বর্তমানে চারটি হাসপাতালে মোট ৭৪ জনের চিকিৎসা চলছে। এর মধ্যে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল ৫৪ জন, সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ১০ জন, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালে একজন এবং পার্ক ভিউ হাসপাতালে নয়জন।

এদিকে বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় তিন শতাধিক আহতের মধ্যে অন্তত ৬৩ জন কোনো না কোনোভাবে চোখে আঘাতপ্রাপ্ত হন। ইতোমধ্যে উন্নত চিকিৎসায় সাতজনকে নেওয়া হয়েছে রাজধানীর জাতীয় বিজ্ঞান ইনস্টিটিউটে। এর মধ্যে একজনের চোখের একটি কর্ণিয়া নষ্ট হয়ে গেছে। অন্যরা চিকিৎসাধীন আছেন চট্টগ্রামে। চিকিৎসাধীন সবারই টেনশন চোখ নিয়ে।

গত সোমবার শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের প্রধান সমন্বয়ক ডা. সামন্ত লাল সেন এবং মঙ্গলবার ন্যাশনাল আই কেয়ারের সাবেক মহাপরিচালক আধ্যাপক দীন মোহাম্মদ নুরুল হক চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতলে চিকিৎসাধীনদের পরিদর্শন করে চোখের সমস্যার কথা বলেছেন।

জানা যায়, বিস্ফোরণে অনেকের চোখে কেমিক্যাল ও গ্লাসের গুঁড়া এসে পড়েছে। ফলে কারও কর্ণিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারও চোখ ঝলসে গেছে, কারও চোখ ফেটে গেছে, কারও চোখ লালচে হয়ে গেছে ও কারও দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে গেছে। ফলে বেশির ভাগ রোগীই চোখে ঝাপসা দেখছেন। সঙ্গে আছে আলোর দিকে তাকাতে না পারা, চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়া, জ্বালা-পোড়া করা, মাথা ব্যথাসহ নানা সমস্যা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতলের চক্ষু বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ড. তনুজা তানজিন বলেন, ‘বিস্ফোরণে অনেক রোগীর চোখে কেমিক্যাল ও গ্লাসের গুঁড়া এসে পড়েছে। ফলে তাদের চোখে নানা সমস্যা দেখা দিচ্ছে। ফলোআপ চিকিৎসার মাধ্যমে তারা ভালো হবেন। তারা সুস্থ হওয়ার ব্যাপারে আমরা আশাবাদি। তিনি বলেন, প্রতিটি রোগীর সমস্যা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। একই সঙ্গে চক্ষু বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ নিয়ে কাজ করা হচ্ছে।’ গতকাল দুপুরে চমেক হাসপাতালের চক্ষু বিভাগে গিয়ে দেখা যায়, আহত রোগীরা হাসপাতালের বেডে টেনশন নিয়ে দিনাতিপাত করছেন। বিস্ফোরণে কনটেইনার ডিপোর কাভার্ড ভ্যানচালক মো. সেকান্দারের (৪৫) শরীরের কিছু অংশ পুড়ে যায়। চিকিৎসায় সেই ক্ষত শুকিয়ে আসে। চোখটা এখনো ভালো হয়নি। সেকান্দার বলেন, বিস্ফোরণের সময় ডিপোর ভিতরে ছিলাম। চারদিকে আগুন ছড়িয়ে পড়ে। বিস্ফোরণে ধ্বংসাবশেষের একটি অংশ আমার শরীরেও পড়ে। শুরু হয় চোখ জ্বালাপড়া। চিকিৎসা চলছে। তবে দেখতে সমস্যা হচ্ছে। চিকিৎসক বলছেন, আস্তে আস্তে ভালো হয়ে যাবে।

তদন্তকাজে সময় বৃদ্ধির আবেদন : বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের ঘটনায় বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের গঠিত তদন্ত কমিটি ঘটনার কারণ অনুসন্ধানে সময় বৃদ্ধির আবেদন করে। গতকাল দুপুরে তদন্তকাজে আরও পাঁচ দিনের সময় চেয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আবেদন করেন কমিটির প্রধান অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমান।

জানা যায়, গত ৪ জুন ঘটনার পরদিন বিভাগীয় কমিশনার ঘটনা তদন্তে পাঁচ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটিকে পাঁচ কর্মদিবস সময় দেওয়া হয়। এ কমিটির সদস্যরা হলেন- পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি জাকির হোসেন খান, চট্টগ্রাম কাস্টমস হাউসের অতিরিক্ত কমিশনার আবু নুর রাশেদ আহমেদ, পরিবেশ অধিদফতর চট্টগ্রাম জেলার পরিচালক মুফিদুল আলম, সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের ১ ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়নের মেজর আবু হেনা মো. কাউসার জাহান, চট্টগ্রাম বন্দরের পরিচালক (পরিবহন) এনামুল করিম, চট্টগ্রামের বিস্ফোরক পরিদর্শক তোফাজ্জল হোসেন এবং সদস্য সচিব অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট সুমনী আক্তার। তদন্ত কমিটির প্রধান বলেন, তদন্তকাজে আরও পাঁচ কর্মদিবস সময় চেয়ে বিভাগীয় কমিশনারের কাছে আবেদন করা হয়েছে। এদিকে, চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসনও একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। এ কমিটিকে সাত কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে। তদন্ত কমিটির প্রধান জেলা প্রশাসনের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপপরিচালক বদিউল আলম বলেন, তদন্তের কাজ চলছে। ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলেছি। তদন্তের বাকি কাজ চলছে। প্রসঙ্গত, গত ৪ জুন শনিবার রাত ৯টায় চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের সোনাইছড়ি ইউনিয়নের কেশবপুর এলাকার বিএম কনটেইনারে বিস্ফোরণের ঘটনায় ৪৮ জন মারা যান এবং আহত হন তিন শতাধিক।

সর্বশেষ খবর