সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

সব দলকে ভোটে আনার তাগিদ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সব দলকে ভোটে আনার তাগিদ

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ ছাড়া গ্রহণযোগ্য হবে না বলে মত দিয়েছেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি), নির্বাচন কমিশনার ও নির্বাচন কমিশনের সচিবেরা। গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন ভবনে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে সাবেক সিইসি, ইসি ও ইসি সচিবেরা মতবিনিময় সভায় এই মত দেন।

এদিকে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও ঐকমত্য না থাকলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে ভোট করা কষ্টকর হবে বলে জানিয়েছেন বর্তমান প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। গতকাল সংলাপ শেষে তিনি এসব কথা বলেন। সিইসি বলেন, সবাই বলেছেন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। নির্বাচন যদি ইনক্লুসিভ না হয়, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাস্তব অর্থে থাকবে না। তিনি বলেন, অতিথিরা বলেছেন বর্তমানে যে সিস্টেম আছে তাতে এখানে খুব বেশি  ভালো করা সম্ভব নয়। এটা একটু কম-বেশি কিছু হতে পারে। আমরা যদি দৃঢ় থাকি, আইন দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করি, তাহলে অনেকটা উন্নয়ন সম্ভব। অন্যদিকে দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপিকে ভোটে আনতে নির্বাচন কমিশনকেও ভূমিকা নিতে হবে বলে মনে করেন সাবেক প্রধান নির্বাচন কমিশনার ড. এ টি এম শামসুল হুদা। সাবেক এই সিইসি বলেন, আমি কম্পিকেটেড দেখতে পাচ্ছি- এবারের ইলেকশনটায় সব দল যদি না আসে এটা কিন্তু গ্রহণযোগ্য হবে না। সুতরাং কীভাবে আনবেন এটা আপনাদের দেখতে হবে, আপনাদের পাওয়ার অব পারস্যুয়েশন, আপনারা কী অফার করবেন এটার ওপর নির্ভর করছে। এ টি এম শামসুল হুদা বলেন, আমাদের সময়ও বিএনপি ওয়াজ প্রোবলেমেটিক। অনেক সময় লাগছে আমাদের টেক দ্যায়ার কনফিডেন্স। আসতে চাননি, কিন্তু অনেক সময় ব্যয় করতে হয়েছে। এখানে তো খুবই অ্যাডামেন্ট মনে হয়েছে, অন্তত যেসব কথাবার্তা বলে বেড়াচ্ছেন ওনারা কারেন্ট সিচুয়েশনে (নির্বাচনে) যেতে রাজি নেই। বিদ্যমান আইন বিধিতে ভালো নির্বাচন সম্ভব মন্তব্য করে নতুন আইন সংস্কারে হাত না দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি। তিনি জানান, জাতীয় পরিচয়পত্রের বিদ্যমান আইনে এটি প্রস্তুত, বিতরণ, সংরক্ষণসহ যাবতীয় কাজ ইসির অধীনে রয়েছে। আইন পরিবর্তন না করে এনআইডি উইংকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নেওয়া সম্ভব হবে না।

সাবেক সিইসি কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, নির্বাচনে পুলিশ, বিজিবি, র‌্যাব, আনসার-ভিডিপিসহ অনেক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য থাকে। সেক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে মাঠে নামানোর দরকার নেই। নির্বাচনে সেনাবাহিনীর একেবারেই দরকার নেই। তিনি জানান, জাতীয় নির্বাচন ছাড়া সব নির্বাচনে ইসির নিজস্ব লোকবল দিয়ে ভোট হয়েছে। জাতীয় নির্বাচনে জেলা প্রশাসকরাই রিটার্নিং কর্মকর্তা হচ্ছেন। আর পরীক্ষামূলকভাবে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়ে ইসির কিছু কর্মকর্তা রিটার্নিং কর্মকর্তা থাকতে পারেন। সাবেক সিইসি নূরুল হুদা বলেন, নির্বাচন কমিশনকে যতই স্বাধীন বলুন না কেন, কিছু কাজ সরকারের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। আচরণবিধি মানার ক্ষেত্রে কমিশনকে অনেক সময় বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়।

সাবেক সিইসি বিচারপতি আবদুর রউফ সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন পদ্ধতি চালুর সুপারিশ করেন। সেই সঙ্গে প্রতি ৫০০ ভোটারের জন্য একটি কেন্দ্র করার প্রস্তাব রাখেন। তিনি বলেন, আপনারা যদি এজ ইট ইজ রাখেন, কোনো চেঞ্জ করতে সাহস না করেন, তাহলে প্রতি ৫০০ জনের জন্য ১টি পোলিং স্টেশন তৈরি করুন। এতে ভোটের সময় কমে যাবে, ৮টা থেকে ১২টার মধ্যে ভোট শেষ হবে। দিনে দিনে ভোট গণনা শেষ করতে পারবেন। যে জিনিসটা সবচেয়ে খারাপ- ভোট গণনার সময় শুরু হয় সন্ধ্যার পর। আর আমরা দেখি সন্ধ্যার পর জিন, ভূত যা কিছু আছে সব দেখা যায়। বাতি নিভতে শুরু করলে শুরু হয় তাদের আনাগোনা।

এ সংলাপে তিন সিইসি ছাড়াও সাবেক নির্বাচন কমিশনার মো. শাহনেওয়াজ, সাবেক নির্বাচন কমিশনার মোহাম্মাদ আবু হাফিজ ও নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার; সাবেক ইসি সচিব ড. মোহাম্মাদ সাদিক ও সচিব মোহাম্মাদ আবদুল্লাহ এবং ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী ও সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান অংশ নেন। বর্তমান ইসির চার নির্বাচন কমিশনার, ইসি সচিব, অতিরিক্ত সচিব উপস্থিত ছিলেন।

এদিকে বিশ্বমানের নির্বাচন করতে হলে জনপ্রশাসন ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের অধীন ন্যস্ত করতে হবে বলে মনে করেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, আমার মতে আগামী জাতীয় নির্বাচনের একটাই চ্যালেঞ্জ। তা হলো সব দলের অংশগ্রহণে নির্বাচন করা। বিশ্বমানের নির্বাচন করতে হলে একটি নিরপেক্ষ সরকার দরকার।

দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় জাতীয় নির্বাচনের প্রতিটি আসনে অধিষ্ঠিত সংসদ সদস্যদের পদে বহাল রেখে সুষ্ঠু নির্বাচনের ধারণা বাতুলতামাত্র উল্লেখ করে মাহবুব তালুকদার বলেন, নির্বাচনের আগে সংসদ সদস্যরা পদত্যাগ না করলে ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’, অর্থাৎ সবার জন্য সমসুযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

তিনি বলেন, ইভিএম বা ভোট কেন্দ্রের পাহারা এই মুহূর্তের চ্যালেঞ্জ নয়। আমার নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, বিশ্বমানের নির্বাচন করতে হলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্বাচনকালে নির্বাচন কমিশনের অধীন ন্যস্ত করতে হবে। পুলিশের কার্যক্রম কঠোরভাবে মনিটর ও নিয়ন্ত্রণ করা আবশ্যক। অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে হলে নির্বাচন কমিশন ও সরকারের সংলাপ প্রয়োজন বলেও মনে করেন মাহবুব তালুকদার। তিনি বলেন, ‘আমি যে রূপরেখা উপস্থাপন করলাম, তার বাস্তবায়ন করতে হলে সংবিধান সংশোধন করা অপরিহার্য। ইভিএম হ্যাকিংয়ের সুযোগ নেই মন্তব্য করে সাবেক নির্বাচন কমিশনার শাহ নেওয়াজ বলেন, এটাতে ইন্টারনেট নেই। এ জন্য মক ভোটিং সিস্টেম বাড়াতে হবে। গোপন কক্ষে একজন লোক দাঁড়িয়ে থেকে বলছে, ভোট দিয়ে দেই। সেই ডাকাত সরাতে না পারলে ইভিএম মানুষ গ্রহণ করবে না।

নির্বাচনকালীন সরকারের আচরণ দেখতে হবে বলে মনে করেন সাবেক কমিশনার আবু হাফিজ। তিনি বলেন, যেখানে কমিশনের লোক দিয়ে দায়িত্ব পালন সম্ভব সেখানে কমিশনের লোক নিয়োগ দিতে হবে রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসেবে। সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এই বিষয়ে নির্বাচন কমিশনকে ইনভলভ হওয়া যাবে না।

বর্তমান কমিশনকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য দিন-ঘণ্টা হিসাব করে রোডম্যাপ তৈরি করার পরামর্শ দেন ইসির সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিক। তিনি বলেন, ব্যালট ভোট গণনায় নানা সমস্যা হয়। এ ক্ষেত্রে ইভিএম আপনাদের মুক্তি দিতে পারে। কেন্দ্রে বুথের সংখ্যা বাড়িয়ে কেন্দ্র কমানোর পরামর্শ দেন তিনি।

ইসির সাবেক সচিব মোহাম্মাদ আবদুল্লাহ বলেন, নির্বাচনী কাজ চ্যালেঞ্জিং এবং কঠিন। নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ দরকার। সংসদ নির্বাচন ৫/৬ দিনে অনুষ্ঠানের পরামর্শ দেন তিনি।

ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব জেসমিন টুলী বলেন, প্রার্থীরা আইনকে বৃদ্ধাঙুলি দেখাচ্ছে। আগামী নির্বাচনের জন্য নতুন চিন্তাভাবনার আলোকে আচরণবিধি তৈরি করা দরকার। ইসির সাবেক অতিরিক্ত সচিব মোখলেছুর রহমান বলেন, ইভিএম কিংবা ব্যালট যেভাবেই নির্বাচন হোক, গোপন কক্ষে যেন কোনো লোক দাঁড়িয়ে না থাকে।

দলগুলোর ঐকমত্য না থাকলে নির্বাচন কষ্টকর : রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সমঝোতা ও ঐকমত্য না থাকলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) পক্ষে ভোট করা কষ্টকর হবে। কমিশনের একার পক্ষে ভালো নির্বাচন করা সম্ভব নয়। গতকাল সংলাপ শেষে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল এমন মন্তব্য করেছেন।

কাজী হাবিবুল আউয়াল সাংবাদিকদের বলেন, ‘অতিথিরা বলেছেন বর্তমানে যে সিস্টেম আছে তাতে এখানে খুব বেশি ভালো করা সম্ভব নয়। এটা একটু কম-বেশি কিছু হতে পারে। আমরা যদি দৃঢ় থাকি, আইন দৃঢ়ভাবে বাস্তবায়নের চেষ্টা করি, তাহলে অনেকটা উন্নয়ন সম্ভব।

সাবেক সিইসি রউফ সাহেব প্রার্থী অনুযায়ী নয়, দলভিত্তিক নির্বাচনের কথা বলেছেন। নির্বাচনে দেখা গেল যে অনেক আগে থেকে দলগুলো তাদের টোটাল প্রার্থীর নাম দিয়ে যাবে। সবাই ৩০০ আসনে প্রার্থী দিল। পার্টি ক, খ, গ, ঘ। যে যত ভোট পেয়েছে, সেভাবে আসন পাবে। এ ধরনের একটা সিস্টেম আছে। তবে এটা আমাদের বিষয় নয়। দলগুলোকেই দেখতে হবে। সিইসি বলেন, কেউ কেউ বলেছেন একাধিক দিনে নির্বাচন করলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ সহজ হবে। কেউ কেউ আবার বলেছেন এতে সমস্যাও হবে। এ নিয়ে কোনো ঐকমত্য হয়নি। কাজেই একাধিক দিনে নির্বাচন করলে আমাদের জন্য অসুবিধাও হতে পারে। ওই ধরনের প্রস্তুতি আমাদের নেই।’

দলগুলোকে পরামর্শ দিতে সমস্যা কোথায়- এমন প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, এখনো দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করিনি। সবাই বলেছেন নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হতে হবে। নির্বাচন যদি ইনক্লুসিভ না হয়, নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা বাস্তব অর্থে থাকবে না। আমাদের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনেকটা নষ্ট হয়ে গেছে। এই কালচারের মধ্যে কিছু ইতিবাচক গুণ আনতে হবে। তাদের মধ্যে পরমতসহিষ্ণুতা, ঐকমত্য যদি না থাকে নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে খুব ভালো নির্বাচন করা সম্ভব হবে না। এটা আমরা যেমন আগে বলেছি, ওনারাও বলেছেন।

কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে সিটি করপোরেশন ভোটে এলাকা ছাড়তে ইসি চিঠি দিলেও তা বাস্তবায়ন হয়নি। এমন বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে আইনবিধির কিছু সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরে সিইসি বলেন, সংসদ সদস্যের জন্য ইসির অনুরোধই ‘যথেষ্ট’। এরপরও না মানলে এবং মামলার ফলাফল না পেলে করার কিছু থাকে না সাংবিধানিক সংস্থাটির। তিনি বলেন, ইসির কিছু আইনগত ক্ষমতা আছে। কিছু ক্ষমতা আংশিক, কিছু ক্ষমতা পরিপূর্ণ। কোনো কোনো নির্বাচনে কারও কারও প্রার্থিতা বাতিল করতে পারে। কিন্তু কুমিল্লার বিষয়ে আচরণবিধিতে বলা রয়েছে-সরকারি সুবিধাভোগী ব্যক্তিরা কারও এলাকায় অবস্থান করে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রচারে অংশ নিতে পারবেন না। কুমিল্লার মাননীয় সংসদ সদস্য অনেকটা তেমনটাই করেছেন বলে আমাদের কাছে           প্রতীয়মান হয়েছে। আমরা তাকে এখান থেকে চিঠি দিয়েছি। বলেছি- স্থান ত্যাগ করার জন্য। উনি ত্যাগ করেননি। আমরা শুনেছি- উনি আদালতে মামলা করেছেন। মামলার ফলাফলটা না পেলে আমরা যখন কাউকে রিকোয়েস্ট করি, আমাদের এমন কোনো ক্ষমতা নেই জোর করে একজন মাননীয় সংসদ সদস্যকে (বের করে দিতে)। কমিশনের অনুরোধই একজন সংসদ সদস্যের এলাকা ত্যাগ করার জন্য যথেষ্ট বলে মত দেন সিইসি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর