সোমবার, ১৩ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

অধিকার-এর বিরুদ্ধে যত অভিযোগ

নিজস্ব প্রতিবেদক

সদ্য নিবন্ধন বাতিল হওয়া বেসরকারি সংস্থা ‘অধিকার’-এর বিরুদ্ধে তদন্তে বেশ কিছু অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া গেছে। ‘অধিকার’-এর কার্যক্রম পর্যালোচনা করে এনজিও ব্যুরো এসব অসংগতি পায়। আর্থিক ও প্রশাসনিক এসব অনিয়মের বিষয়ে ‘অধিকার’ কোনো সন্তোষজনক ব্যাখ্যাও দিতে পারেনি।

অধিকারের বিষয়ে এনজিও ব্যুরোর প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রথমত. বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন, ২০১৬ এর ৯(১) ধারা মতে কোনো এনজিওকে বৈদেশিক মুদ্রায় অথবা দেশীয় মুদ্রায় প্রাপ্ত সব বৈদেশিক অনুদানের অর্থ যে কোনো তফসিলি ব্যাংকের একটি নির্দিষ্ট ব্যাংক হিসাবের (মাদার অ্যাকাউন্ট) মাধ্যমে গ্রহণ করতে পারবে। উল্লিখিত আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে অধিকার দুটি ব্যক্তিগত হিসাবসহ আটটি হিসাব পরিচালনা করেছে। দ্বিতীয়ত. অলাভজনক সংস্থা হিসেবে একটি এনজিও লাভজনক কোনো খাতে বিনিয়োগ করতে পারে না। কিন্তু অধিকার-এর প্রাপ্ত অনুদানের অর্থে আদিলুর রহমানের নামে একটি ব্যক্তিগত হিসাব খেলা হয় এবং অধিকার-এর অ্যাকাউন্ট থেকে ওই হিসাবে টাকা স্থানান্তর করে এফডিআর করা হয়, যা বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন, ২০১৬ এর সুস্পষ্ট লঙ্ঘন। তৃতীয়ত. পুনর্নিবন্ধনের আবেদনের সময় এনজিওটির আটটি অডিট আপত্তি বহাল ছিল। চতুর্থত. সরকারের গোয়েন্দা সংস্থা কর্তৃক অধিকারের নারী ক্ষমতায়ন, নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা ও মানবাধিকার বিষয়ক তিনটি সুনির্দিষ্ট প্রকল্পের মাধ্যমে নেতিবাচক কার্যক্রম এবং আর্থিক লেনদেনে অসংগতি বিষয়ে এনজিও ব্যুরোকে অবহিত করে। ব্যুরো পরবর্তীতে একাধিকবার তাদের নিকট ওই বিষয়ে ব্যাখ্যা চাইলেও অধিকার সন্তোষজনক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেনি। পঞ্চমত. এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর পরিপত্রের ৮ ধারা অনুযায়ী এনজিওর যে কোনো প্রজেক্ট স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে সম্পন্ন করবে এবং প্রত্যেক বছর ও প্রজেক্ট মেয়াদ শেষে স্থানীয় প্রশাসনে প্রজেক্ট রিপোর্ট জমা দেবে। কিন্তু অধিকার স্থানীয় প্রশাসনকে অবহিতকরণ অথবা প্রজেক্ট রিপোর্ট কিছুই জমা দেয়নি।

এনজিও ব্যুরো সূত্র জানায়, লাইসেন্স নবায়ন ছাড়াই অধিকার এনজিওটি সাত বছর ধরে তাদের সব কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। যে কোনো এনজিওর কার্যক্রমের বিস্তারিত তথ্যাদি তথা কার্যক্রম পরিচালনার অর্থের উৎস, সব কার্যক্রম সংক্রান্ত হালনাগাদ তথ্যাদি, কর্মরত ব্যক্তি সংক্রান্ত তথ্যাদি, চলমান প্রকল্পের তালিকা ইত্যাদি নিয়মিত এনজিও বিষয়ক ব্যুরোর কাছে প্রেরণের বাধ্যবাধকতা থাকলেও অধিকার গত সাত বছরে তা দেয়নি।  এ বিষয়ে একাধিকবার এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে লিখিতভাবে জানতে চাওয়া হলেও আদালতের রিটের দোহাই দিয়ে তারা এনজিও ব্যুরোর সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ রক্ষা ছাড়াই বেআইনিভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। পাশাপাশি আইনি প্রক্রিয়াকে দীর্ঘায়িত করার লক্ষ্যে অধিকার পক্ষের আইনজীবী ধারাবাহিকভাবে আদালতের শুনানির তারিখ পরিবর্তন করে আসছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ৫ জুন এনজিও বিষয়ক ব্যুরো থেকে সুনির্দিষ্ট কারণ এবং ব্যাখ্যা উল্লেখ করে অধিকার এনজিওটির নবায়ন আবেদন নামঞ্জুর করে চিঠি প্রদান করা হয়।

জানা যায়, বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা অধিকার ১৯৯৫ সালের ২৫ মার্চ এনজিও ব্যুরো থেকে রেজিস্ট্রেশনপ্রাপ্ত হয়, রেজিস্ট্রেশন নম্বর-০৯২৪। অধিকার সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা এবং মূল কর্ণধার আদিলুর রহমান খান অক্টোবর ২০০১ মে থেকে ২০০৭ পর্যন্ত ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই প্রতিষ্ঠানটি দেশের আইনশৃঙ্খলা ও মানবাধিকার পরিস্থিতি সংক্রান্ত বিষয়ে ত্রৈমাসিক ও বার্ষিক প্রতিবেদন তৈরি করে বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠী এবং পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাসগুলোতে প্রেরণ করে আসছে। এ ছাড়াও সমসাময়িক বিভিন্ন আলোচিত ইস্যুতে প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে মন্তব্য ও বিবৃতি প্রদান করা হয়ে থাকে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা অধিকারের প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে নিজেদের প্রতিবেদন তৈরি করে থাকে। সংবেদনশীল বিষয় নিয়ে মন্তব্য ও বিবৃতি প্রচার করলেও অধিকার কর্তৃক প্রচারিত প্রতিবেদনের স্বচ্ছতা এবং তথ্যের উৎসের ব্যাপারে বিভিন্ন সময়েই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অধিকার এনজিওটি বড় ধরনের বিতর্কের জন্ম দেয় ২০১৩ সালে ৫ ও ৬ মে ঢাকার মতিঝিলে হেফাজতের কর্মী-সমর্থকদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংঘর্ষে নিহতের তালিকা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। অধিকার এ বিষয়ে এক ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং রিপোর্ট তাদের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করে যেখানে দাবি করা হয়, ওই সংঘর্ষে হেফাজতের ৬১ জন কর্মী-সমর্থক নিহত হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রাথমিক তদন্তে ওই রিপোর্টে নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ অসংগতি পাওয়া যায়। এরমধ্যে রয়েছে, পাঁচজন ব্যক্তির নাম একাধিকবার থাকা, ১১টি কল্পিত নাম যুক্ত করা, শারীরিক অসুস্থতাজনিত কারণে স্বাভাবিক মৃত্যুবরণকারীর নাম তালিকায় ঢুকিয়ে দেওয়া, ঢাকার বাইরে মৃত্যুবরণ করা ছয়জনের নাম তালিকায় যুক্ত করা ইত্যাদি। প্রতিবেদন প্রকাশিত হওয়ার পর উদ্ভূত বিভ্রান্তি দূর করতে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে তথ্য অধিকার আইনের অধীনে অধিকার-এর কাছে ওই তালিকার বিস্তারিত তথ্য সম্বলিত প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হলেও অধিকার তা দিতে অনীহা প্রকাশ করে। এ ছাড়া এনজিও ব্যুরোকেও তারা গোপনীয়তার অজুহাতে ওই প্রতিবেদনের মূল তথ্যাদি দেয়নি। 

অধিকার-এর পক্ষ থেকে ২০১৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর এনজিও বিষয়ক ব্যুরোতে নিবন্ধন নবায়নের জন্য আবেদন দেওয়া হয়। বৈদেশিক অনুদান (স্বেচ্ছাসেবামূলক কার্যক্রম) রেগুলেশন আইন অনুসারে যে কোনো এনজিওর পুনঃনিবন্ধন আবেদন যাচাই-বাছাইয়ের সময় এনজিওটির পূর্ববর্তী ১০ বছরের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করার ভিত্তিতে সেটি সন্তোষজনক কি না তা নির্ধারণ করা হয়। অধিকারের আবেদনপত্র যাচাইয়ের সময় প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রমে আর্থিক অনিয়মসহ নানাবিধ অসংগতি পরিলক্ষিত হয়। এ কারণে  এনজিও ব্যুরো থেকে প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা তলব করে একাধিক চিঠি ইস্যু করা হয়। অধিকার ওই চিঠিগুলোতে যথাযথ ব্যাখ্যা না দেওয়ায় এনজিও ব্যুরো থেকে প্রতিষ্ঠানটির লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। পরবর্তীতে অধিকার-এর কর্ণধার আদিলুর রহমান খান ২০১৯ সালের ১৩ মে, নিবন্ধন নবায়নের নির্দেশনা চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দাখিল করেন। আদালতে এনজিও ব্যুরো প্রাসঙ্গিক ব্যাখ্যা দিলেও অধিকার পক্ষের আইনজীবীর অনীহার কারণে প্রায় তিন বছর রিটের কোনো শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। চলতি বছরের এপ্রিল মাস থেকে ওই রিটের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়।

সর্বশেষ খবর