মঙ্গলবার, ১৪ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

ভোট উৎসবের অপেক্ষা

শেষ মুহূর্তে শঙ্কা, প্রচারণা শেষ, মাঠে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে ভোট কেনার অভিযোগ

গোলাম রাব্বানী ও মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা থেকে

ভোট উৎসবের অপেক্ষা

শেষ দিনের প্রচারণায় গতকাল তিন মেয়র প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত, মনিরুল হক সাক্কু, নিজাম উদ্দিন কায়সার -রোহেত রাজীব

কুমিল্লায় সিটি নির্বাচনে উৎসবের মধ্যে শেষ মুহূর্তে বেশ কিছু শঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রচারণার শেষ দিনেও নানা অভিযোগ করেছেন মেয়র প্রার্থীরা। আওয়ামী লীগ মেয়র প্রার্থী বলছেন, ভোটে নিরপেক্ষতা প্রমাণ করতে গিয়ে ইসি আমাকে জবাই করছে।

অন্যদিকে স্বতন্ত্র দুই মেয়র প্রার্থী ভোট নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলছেন, ইসি দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। নির্বাচনে সমান সুযোগ নেই। প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা চলছে। ভোটের দিন বহিরাগতদের দিয়ে কেন্দ্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করা হতে পারে। পাড়া-মহল্লায় পাহারা বসানো হচ্ছে, যাতে ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে না পারেন।

আজ রাত পোহালে কুমিল্লা সিটি করপোরেশনে (কুসিক) ভোট গ্রহণ। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) টানা ভোট গ্রহণ চলবে সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত। কেন্দ্রে কেন্দ্রে থাকছে সিসি ক্যামেরাও। বিশেষ নিরাপত্তায় ভোট কেন্দ্রে ইভিএমসহ নির্বাচনী মালামাল পাঠানো হবে আজ। নির্বাচন কমিশনও সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ ভোট গ্রহণে সব প্রস্তুতি শেষ করছে। ভোট ঘিরে নগরজুড়ে বিরাজ করছে উৎসবের আমেজ। উৎসবমুখর পরিবেশে ভোটদানে প্রস্তুত ভোটাররাও। নির্বাচনী পরিবেশ পর্যবেক্ষণে গতকাল কুমিল্লায় এসেছিলেন দুই নির্বাচন কমিশনার। নির্বাচন সুষ্ঠু-শান্তিপূর্ণ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি নেওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা। নির্বাচনী পরিবেশ না থাকলে ভোট গ্রহণ বন্ধ করারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।

নির্বাচন বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবারের কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে পাঁচজন প্রার্থী থাকলেও ভোটের মাঠে আলোচনায় রয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত ও বিএনপির সাবেক নেতা কুমিল্লা সিটির সাবেক মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু ও সে¦চ্ছাসবক দলের সাবেক নেতা স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার। সিটি নির্বাচনে অপর দুই মেয়র প্রার্থী হলেন- ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা রাশেদুল ইসলাম, স্বতন্ত্র হিসেবে রয়েছেন কামরুল আহসান বাবুল। তবে এ নির্বাচনে ত্রিমুখী লড়াই হবে। নির্বাচন নির্বিঘ্ন করতে চার স্তরের নিরাপত্তাবলয় গড়ে তুলেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। মাঠে নেমেছে ২২ প্লাটুন বিজিবি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় বিজিবির সঙ্গে মাঠে রয়েছেন র‌্যাব-পুলিশের সদস্যরা। কেউ ভোট কেন্দ্রে বিশৃঙ্খলার চেষ্টা করলে অ্যাকশনে যাওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। নির্বাচনী আচরণবিধি অনুযায়ী গত রাত ১২টা থেকে ভোটের প্রচার-প্রচারণা বন্ধ হয়ে গেছে। ভোটারদের আসা-যাওয়ার ক্ষেত্রেও থাকছে নি-িদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। ভোটাধিকার প্রয়োগে কোনো ভোটারকে কেন্দ্রে আসা-যাওয়ার পথে কেউ বাধা দিলে বা ভয়ভীতি দেখালে, কিংবা শক্তি প্রদর্শন করলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

এ নির্বাচনে সব মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রায় ছয় হাজার সদস্য মাঠে থাকছেন। ভোট গ্রহণের আগের দুই দিন, ভোট গ্রহণের দিন ও ভোটের পরের দিনসহ মোট চার দিন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিটি এলাকায় থাকবে। তবে আনসার বাহিনী মোট পাঁচ দিন নিয়োজিত থাকবে। কুমিল্লা সিটি নির্বাচনের জন্য র‌্যাবের একটি রিজার্ভ টিম সার্বক্ষণিক নিয়োজিত থাকবে। মোবাইল স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নিয়োজিত প্রতিটি টিমে বিশেষ করে বিজিবির টহল দলে একজন করে এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় গত ১৩ জুন থেকে ১৬ জুন পর্যন্ত মোট ২৭ জন এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া কুমিল্লা সিটি নির্বাচন উপলক্ষে ১৩ জুন থেকে ১৭ জুন পর্যন্ত নয়জন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট নির্বাচনী অপরাধ বিচারের দায়িত্বে থাকবেন।

নির্বাচন উপলক্ষে আজ ১৪ জুন মধ্যরাত থেকে ভোটের দিন রাত ১২টা পর্যন্ত নির্বাচনী এলাকায় যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। গতকাল ১৩ জুন মধ্যরাত থেকে ১৬ জুন সকাল ৬টা পর্যন্ত মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। তবে প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী, নির্বাচনী এজেন্ট, দেশি/বিদেশি পর্যবেক্ষক, গণমাধ্যমকর্মী, নির্বাচনে বৈধ পরিদর্শক, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, জরুরি সেবা কাজে মোটরসাইকেল চলাচলে নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হবে না। এ ছাড়া ১৩ জুন সকাল ৬টা থেকে ১৭ জুন রাত ১২টা পর্যন্ত আগ্নেয়াস্ত্র প্রদর্শন ও আগ্নেয়াস্ত্রসহ চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকবে। ভোট কেন্দ্রের ৪০০ গজের মধ্যে কোনো প্রার্থীর নির্বাচনী ক্যাম্প স্থাপন করা যাবে না।

গতকাল নির্বাচনের শেষ প্রচার-প্রচারণা নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন মেয়র ও কাউন্সিলর প্রার্থীরা। দিনভর নগরীর অলিগলি চষে বেড়িয়েছেন তারা। মেয়র প্রার্থীরা এজেন্টদের সঙ্গে দফায় দফায় মিটিং করেছেন। গতকাল দিনভর কুমিল্লা সিটির অলিগলি, রাজপথ ছিল প্রচারণায় মুখর। নির্বাচন প্রভাবমুক্ত রাখতে যারা কুমিল্লা সিটি এলাকার বাসিন্দা নন বা ভোটার নন, তাদের নির্বাচনী এলাকা ত্যাগ করতে নির্দেশ দিয়েছে ইসি। এ ছাড়া প্রচারণার শেষ মুহূর্তে কাউন্সিলর প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ উঠেছে। এদিকে নির্বাচনী প্রচারণার শেষ মুহূর্তে কালো টাকা ছড়ানোর অভিযোগও উঠেছে প্রার্থীদের বিরুদ্ধে। বিত্তশালী প্রার্থীরা ভোট কিনতে ভোটারদের বাড়ি বাড়ি ধরনা দিচ্ছেন। নগদ অর্থ ছাড়াও ভোটারদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে উপহারসামগ্রী।

এক নজরে সিটি : নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডে মোট ভোটার সংখ্যা ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। এর মধ্যে নারী ভোটার ১ লাখ ১৭ হাজার ৯২ জন ও পুরুষ ভোটার ১ লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন দুজন। মোট কেন্দ্র ১০৫টি। পাঁচজন মেয়র প্রার্থী। ১০৮ জন সাধারণ কাউন্সিলর প্রার্থী ও ৩৮ জন সংরক্ষিত আসনের প্রার্থী।

যা বললেন মেয়র প্রার্থীরা : আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত সকালে নগরীর রানীর দিঘির পাড়ের নিজের নির্বাচনী অফিসে সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন। তিনি বলেন, আমার পক্ষ থেকে তাদের বাধা দেওয়া, নির্বাচন পরিবেশ নষ্ট করার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। আমরা চাই কুমিল্লায় শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোক। যে-ই নির্বাচিত  হোক আমি আমার এবং দলের পক্ষে সুস্বাগতম জানাব। এ সময় কালো টাকা ছড়ানো হচ্ছে দাবি করে তিনি বলেন, আমার প্রতিপক্ষ প্রার্থী যার বিরুদ্ধে আমি দুর্নীতির অভিযোগ এনেছি তিনি কালো টাকা ছড়াচ্ছেন। এমনকি আমার কর্মীদেরও টাকা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। তিনি বলেন, ইসি নিজের ক্লিন ইমেজ তৈরি করার জন্য কুমিল্লায় আমাকে জবাই করতে চাচ্ছে। আপনারা সরকার পক্ষের কেউ না। বিরোধী পক্ষেরও না। সারা বিশ্বের কাছে নিজেদের পরিচয় দিয়ে বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতার কাজ করছে- এটা প্রমাণ করুন। ইসির প্রথম পরীক্ষা এটা। এই পরীক্ষায় কি আমাকে জবাই করে প্রমাণ করবেন যে, ওনারা নিরপেক্ষ।

সাবেক মেয়র স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু গতকাল দিনভর নিজের বাসভবনে নেতা-কর্মী-এজেন্টদের সঙ্গে মিটিং করেন। পরে নিজ বাসায় সাংবাদিকদের তিনি বলেন, নির্বাচনের সব কিছু চালাচ্ছেন এমপি বাহার ভাই। ইসি এই সংসদ সদস্যকে তো চিঠি দিলেন। কিন্তু তিনি আমলেই নিলেন না। এটা তো ইসির ব্যর্থতা। সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে ইসির যে আইন আছে তা প্রয়োগ করুক। নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নাই।

তিনি বলেন, বহিরাগতদের দিয়ে কেন্দ্রে ভোটারদের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি করার শঙ্কা রয়েছে, ভোটাররা ভয় পাচ্ছেন। সিটির চতুর্দিকে ইউনিয়ন পরিষদ, আমরা শুনছি ভোটের দিন ইউনিয়ন থেকে লোক এনে ভোট কেন্দ্রে প্যানিক সৃষ্টি করবে। ভোট স্লো হবে। এটা ২০১৭ সালেও তারা করেছে। বাইর থেকে লোক এসে যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভোট কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে রাখে, তবে ভোটাররা কেন্দ্রে যাবে কেমনে? ভোট কেন্দ্রে যেতে যদি বাধা দেওয়া না হয়, তবেই মানুষ ভোট দিতে যাবেন। 

এদিকে গতকাল দুপুর ১২টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে যান ঘোড়া প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার। এ সময় বহিরাগতদের উপস্থিতির জন্য ভোটারদের মাঝে শঙ্কা ও ভয় বাড়ছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। দুপুরে নিজ বাসায় তিনি বলেন, কুমিল্লা শহরে ভোটারদের মধ্যে শঙ্কা সৃষ্টি হয়েছে। প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় করার চেষ্টা করছেন এমপি বাহার, বহিরাগতদের এনে পাহারা বসানো হচ্ছে যাতে ভোটাররা কেন্দ্রে আসতে না পারেন। তিনি বলেন, প্রধান নির্বাচন কমিশনার স্থানীয় এমপির বিষয়ে যে অসহায়ত্বের পরিচয় দিয়েছেন তাতে আমরা হতাশাগ্রস্ত। কারণ তাঁর অসহায়ত্ব মানে প্রশাসনের অসহায়ত্ব, নির্বাচন কমিশনের অসহায়ত্ব। তিনি বলেন, সিইসিকে অনুরোধ করছি। যদি মনে হয় আপনি কোনো শক্তির কাছে জিম্মি আছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন করতে না পারেন, তবে সিইসির পদ ছেড়ে দিলে বেশি সম্মানিত হবেন। 

মক ভোটিংয়ে সাড়া কম : কাল কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন। এ উপলক্ষে গতকাল মক ভোটিং (নমুনা ভোট) শুরু করে নির্বাচন কমিশন। তবে মক ভোটিংয়ে ভোটারদের তেমন উপস্থিতি দেখা যায়নি। নগরীর সবচেয়ে বড় ভোট কেন্দ্র কুমিল্লা হাইস্কুল কেন্দ্রে ১০টা ২০ মিনিটে দেখা যায় ভোটারশূন্য কেন্দ্র। এরপর ক্রমান্বয়ে নগরীর জিলা স্কুল কেন্দ্র, ভিক্টোরিয়া কলেজ কেন্দ্র, সর্বশেষ ১১টা ২০ মিনিটে গিয়ে ফয়জুন নেসা কেন্দ্রে দুজন ভোটার পাওয়া যায়। ১০ নম্বর ওয়ার্ডের নগরীর ফয়জুন নেসা কেন্দ্রের সহকারী প্রিসাইডিং কর্মকর্তা লুৎফর রহমান বলেন, ওই কেন্দ্রের ভোটার ১ হাজার ৯৭৭ জন। সবাই মহিলা ভোটার। অনেকে কাজে ব্যস্ত তাই ভোট দিতে আসছে না। মক ভোটিংয়ে তাই ভোটার কম। তবে সব পরিস্থিতি ঠিক থাকলে ভোটের দিন ভোটার আসবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর