বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

কুমিল্লায় ৩৪৩ ভোটে রিফাত জয়ী

♦ শেষ মুহূর্তে উত্তেজনা, পাল্টাপাল্টি অবস্থান, ফল ঘোষণা কেন্দ্র ঘেরাও ♦ দশ বছরের দুর্নীতি উদঘাটন হবে : রিফাত ♦ ফল কে মানল কে মানল না যায় আসে না : বাহার

জুলকার নাইন, গোলাম রাব্বানী ও মহিউদ্দিন মোল্লা, কুমিল্লা থেকে

কুমিল্লায় ৩৪৩ ভোটে রিফাত জয়ী

ফল ঘোষণার শেষ মুহূর্তে উত্তেজনায় মুখোমুখি দুই পক্ষের হাতাহাতি। নির্বাচন কমিশন অফিসে সাক্কুর অবস্থান -রোহেত রাজীব

কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত। তিনি টানা দুবারের মেয়র টেবিলঘড়ি প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কুকে ৩৪৩ ভোটে পরাজিত করেছেন। রিফাত ভোট পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০টি। সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭টি। এ সিটি ভোটে তৃতীয় অবস্থানে রয়েছেন সে¦চ্ছাসেবক দলের সাবেক নেতা ঘোড়া প্রতীকের স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী নিজাম উদ্দিন কায়সার। তিনি পেয়েছেন ২৯ হাজার ৯৯ ভোট। তবে এ ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছেন মনিরুল হক সাক্কু। তিনি আদালতে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন। বলেছেন, অজ্ঞাত ফোন পেয়ে রিটার্নিং অফিসার ফলাফল পাল্টে দিয়েছেন। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে ফলাফল নিয়ে শেষ মুহূর্তে নাটকীয়তা হয়েছে। গতকাল বিকালে ভোট গ্রহণ শেষে গণনা চলাকালে শুরু হয় হাড্ডাহাড্ডি প্রতিযোগিতা। ভোটের অঙ্কে কখনো এগিয়ে ছিলেন রিফাত, কখনো সাক্কু। একপর্যায়ে রাত ৯টার দিকে দুই পক্ষের সমর্থকরাই নিজেদের জয়ী বলে দাবি করেন। এ সময় দুই পক্ষে মিছিল-শোডাউন শুরু হয়। ফলে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে ফলাফল ঘোষণা সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। বাড়ানো হয় নিরাপত্তা। মিছিলে মিছিলে উত্তেজনা দেখা দেয়। একপর্যায়ে সাক্কুর ওপর হামলার চেষ্টা করেন বিপরীত পক্ষের সমর্থকরা। শুরু হয় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। অশান্ত পরিস্থিতির মধ্যে রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিফাতকে বিজয়ী ঘোষণা করেন রিটার্নিং অফিসার। এদিকে কুমিল্লা সিটির মেয়র প্রার্থীর তালিকায় ছিলেন হাতপাখা প্রতীক নিয়ে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মাওলানা রাশেদুল ইসলাম ও হরিণ প্রতীকের স্বতন্ত্র প্রার্থী কামরুল আহসান বাবুল। এ নির্বাচনে রাশেদুল ইসলাম পেয়েছেন ৩ হাজার ৪০ আর কামরুল আহসান বাবুল ২ হাজার ৩২৯ ভোট। বিজয়ী আওয়ামী লীগ প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত কুমিল্লা জিলা স্কুলে পড়াকালে কুমিল্লা মহানগরী আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সদর আসনের সংসদ সদস্য হাজী আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহারের অনুসারী হিসেবে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। ১৯৮০ সালে তিনি শহর ছাত্রলীগের সভাপতির পদ লাভ করেন। ১৯৮১ সালে কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া কলেজ ছাত্র সংসদের ছাত্রলীগের প্যানেলে তিনি বহিঃক্রীড়া ও ব্যায়ামাগার সম্পাদক নির্বাচিত হন। ওই সময় কলেজ ছাত্র সংসদে প্রথম জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছবি উত্তোলন করেন তিনি। একই বছর জামায়াত-শিবির কর্তৃক আক্রমণের শিকার হন রিফাত। ওই সময় তাঁর দুই হাত ও দুই পায়ের রগ কেটে দেওয়া হয়। ১৯৮৫ সাল পর্যন্ত তিনি সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হন। এ সময় এরশাদবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন রিফাত। ১৯৯৬ সালে তিনি কেন্দ্রীয় যুবলীগের সদস্যপদ লাভ করেন। পরে কুমিল্লা জেলা যুবলীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৭ সালে তিনি কুমিল্লা মহানগরী আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের পদ লাভ করেন। এ ছাড়া ১২ বছর ধরে তিনি কুমিল্লা জেলা ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। রিফাত কুমিল্লা ক্লাবের দুবারের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, বিকাল ৪টা পর্যন্ত ৬০ শতাংশের কমবেশি (১-২ শতাংশ) ভোট পড়েছে। কয়েকটি কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ের পর পর্যন্তও ভোট চলছিল। নির্বাচন কমিশন জানিয়েছে, সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত ভোট হয়। ভোট পর্যবেক্ষণে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ছিল সিসি ক্যামেরা। কেন্দ্রীয়ভাবে ঢাকা থেকে মনিটরিং করেন নির্বাচন কমিশনাররা। নির্বাচন ঘিরে নগরীজুড়েই ছিল উৎসবের আমেজ। এ নগরীর ২৭ ওয়ার্ডে মোট ভোটার ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন। নারী ১ লাখ ১৭ হাজার ৯২ ও পুরুষ ১ লাখ ১২ হাজার ৮২৬ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার দুজন। ১০৮ জন সাধারণ ও ৩৮ জন সংরক্ষিত আসনের কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। ১০৫ কেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোটাধিকার প্রয়োগ করেন ভোটাররা। বুথ ছিল ৬৪০টি।

প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নগরীর উন্নয়ন করব-রিফাত : বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হওয়ার পর এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় আরফানুল হক রিফাত বলেন, প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী নগরীর উন্নয়ন করব। আমার জীবন দিয়ে চেষ্টা করব। কুমিল্লার মানুষের কাছে যে কমিটমেন্ট করেছি তা রাখার চেষ্টা করব। কুমিল্লার মানুষের কষ্ট লাঘব করার চেষ্টা করব। এ সময় তিনি সবাইকে নিয়ে একসঙ্গে কাজ করার অঙ্গীকার করেন। তিনি বলেন, শিগগিরই সিটি করপোরেশনের গত ১০ বছরের দুর্নীতি উদঘাটন করা হবে।

ফল কে মানল কে মানল না তাতে কিছু যায়-আসে না-বাহার : কুমিল্লার আলোচিত সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার বলেছেন, জনতার ভোটে নৌকা জয়ী হয়েছে। ফল কে মানল কে মানল না তাতে কিছু যায়-আসে না। ফল যা হয়েছে তা-ই সঠিক। কুমিল্লার মানুষ এমন ফলের অপেক্ষায় ছিলেন। এই ফলে জনতার জয় হয়েছে। গতকাল রাত সাড়ে ৯টায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় তিনি এসব কথা বলেন।

এর আগে নির্বাচনের ফল প্রত্যাখ্যান করেন স্বতন্ত্র মেয়র প্রার্থী মনিরুল হক সাক্কু। গতকাল রাতে ফল প্রত্যাখ্যান করে সাক্কু বলেন, আমার হিসাবে ৯৮০ ভোটে এগিয়ে ছিলাম। শেষ মুহূর্তে ফল পাল্টে দেওয়া হয়েছে। ষড়যন্ত্র করে আমাকে হারানো হয়েছে। ভোট পুনরায় গণনার জন্য আমি আদালতে রিট করব, আইনি ব্যবস্থা নেব। গতকাল রাত সাড়ে ৯টার দিকে রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে এ ফল ঘোষণা করেন। এর আগে সকাল ৮টা থেকে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম) নগরীর ২৭টি ওয়ার্ডের ১০৫ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ শুরু হয়। বিকাল ৪টায় শেষ হয় ভোট গ্রহণ। ঘোষিত ফল অনুযায়ী, নৌকা প্রতীকের প্রার্থী আরফানুল হক রিফাত পেয়েছেন ৫০ হাজার ৩১০ ভোট। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী মনিরুল হক সাক্কু পেয়েছেন ৪৯ হাজার ৯৬৭ ভোট। মেয়র পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী অন্য তিন প্রার্থী মোহাম্মদ নিজাম উদ্দিন কায়সার ঘোড়া প্রতীকে ২৯ হাজার ৯৯, রাশেদুল ইসলাম হাতপাখায় ৩ হাজার ৪০ ও কামরুল আহসান বাবুল হরিণ প্রতীকে ২ হাজার ৩২৯ ভোট পেয়েছেন।

রিটার্নিং কর্মকর্তার দফতর সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনে মোট ২ লাখ ২৯ হাজার ৯২০ ভোটার ছিলেন। এর মধ্যে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৬৪টি ভোট পড়ে। তবে বাতিল হয় ৩১৯ ভোট। ভোট পড়েছে ৫৮.৭৪ শতাংশ। মোট ১০৫টি কেন্দ্রের ৬৪০টি কক্ষে ভোট গ্রহণ হয়েছে। নির্বাচনে সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১০৬ জন ও সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলর পদে ৩৬ জন প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

কুমিল্লা সিটি নির্বাচনে ফল ঘোষণার সময় উত্তেজনা দেখা দিলে কর্মকর্তাদের ঘিরে পুলিশের প্রহরা (উপরে)। একটি কেন্দ্রে বিজিবির লাঠিচার্জ। নারীদের দীর্ঘ লাইন    -বাংলাদেশ প্রতিদিন

সর্বশেষ খবর