বৃহস্পতিবার, ১৬ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

অবহেলিত জনপদে উন্নয়নের ছোঁয়া

রফিকুল ইসলাম রনি

পদ্মা সেতু এখন আর স্বপ্ন নয়, বাস্তব। একটু একটু করে সম্পন্ন হলো বিশাল এই কর্মযজ্ঞ। হাজারো বাধাবিপত্তি পেরিয়ে বর্তমান সরকার দেশের বৃহত্তম পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়ন করে প্রমাণ করেছে আমরাও পারি। ২৫ জুন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের জন্য উন্মোচন হবে নতুন দিগন্ত। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে প্রথমবারের মতো দক্ষিণাঞ্চলে নৌপথনির্ভর যাতায়াতে যুক্ত হচ্ছে নতুন মাত্রা। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এর প্রভাবে দীর্ঘদিন সুবিধাবঞ্চিত দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের আর্থসামাজিক কাঠামোতে আসবে দিনবদলের ছোঁয়া। পদ্মা সেতু হওয়ার পর দেশের দক্ষিণাঞ্চলের ব্যাপক উন্নতি হবে, এ অঞ্চলের পুরো চেহারাই বদলে দেবে বলে মন্তব্য করেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। সম্প্রতি তিনি গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘পদ্মা সেতু হওয়ার পর এই অঞ্চলের অর্থনীতির চেহারা বদলে যাবে। কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে। ইতোমধ্যে এখানে একটি ফার্মাসিউটিক্যাল ফ্যাক্টরি তৈরি করে দিয়েছে সরকার। আর দুশ্চিন্তা করতে হবে না।’ প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে যোগাযোগব্যবস্থা ও অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে, উন্নয়নে ঘটবে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষ তাদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম পাবে। এরই মধ্যে এসব জেলায় নতুন নতুন শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে। সেগুলোতে কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে। সব মিলিয়ে এটি বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এ অঞ্চলের মানুষের ভাগ্য বদলে যাবে। মোংলা ও পায়রা বন্দরের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশ এশিয়ান হাইওয়েতে যুক্ত হবে। এই বৃহৎ অঞ্চলে গড়ে উঠবে শিল্পপ্রতিষ্ঠান ও ইপিজেড। পিছিয়ে পড়া এই অঞ্চলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বাড়বে। সারা দেশের অর্থনীতিতে এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। এক সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু খুলে দেওয়ার পর জিডিপি ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাবে। অন্যদিকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের পিছিয়ে পড়া ২১টি জেলা ৩টি বিভাগের অন্তর্গত। এগুলো হচ্ছে- বরিশাল বিভাগের বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা ও ঝালকাঠি। ঢাকা বিভাগের গোপালগঞ্জ, ফরিদপুর, মাদারীপুর, শরীয়তপুর ও রাজবাড়ী। এ ছাড়া খুলনা বিভাগের খুলনা, যশোর, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, নড়াইল, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর, ঝিনাইদহ ও মাগুরা। স্বাধীনতার পর থেকে এই জেলাগুলো ছিল অবহেলিত। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনের পর থেকেই এসব জেলায় উন্নয়নের জোয়ার শুরু হয়। বৃহত্তর এই অঞ্চলকে ঢাকার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের জন্য শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর গুরুত্ব অনুধাবন করেই প্রকল্প হাতে নেন। শরীয়তপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য ও পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এনামুল হক শামীম বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকে দক্ষিণাঞ্চলের জেলাগুলো ছিল অবহেলিত। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর উন্নয়ন শুরু হয়। গত ১৩ বছরে বেশ উন্নয়ন হয়েছে। এখন পদ্মা সেতু উদ্বোধনের ফলে বদলে যাবে দক্ষিণাঞ্চলের অর্থনৈতিক চেহারা। শিল্প-কারখানা যেমন গড়ে উঠবে, তেমনি ঢাকার সঙ্গে যোগাযোগও দ্রুত হবে। ফলে জীবনমান অনেক বেড়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘পদ্মা সেতুকে ঘিরে মাওয়া-জাজিরাসহ শরীয়তপুর, ফরিদপুর, মাদারীপুর এলাকায় শিল্প-কলকারখানা স্থাপন শুরু হচ্ছে। বিশাল কর্মযজ্ঞ শুরু হয়েছে। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও যোগ্য নেতৃত্বে পদ্মা সেতু নির্মাণ করার ফলেই অবহেলিত জনপদে পৌঁছবে উন্নয়নের ছোঁয়া। জানা গেছে, দেশের বড় তাপবিদ্যুৎ প্রকল্প হবে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। আছে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র। দ্বিতীয় পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র বরিশাল বিভাগেই নির্মাণের পরিকল্পনা করার লক্ষ্যে কাজ শুরু হয়েছে। বিদ্যুতের সরবরাহ বাড়লে এই এলাকায় শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন হবে। পায়রা বন্দর, পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র, সাবমেরিন ক্যাবল ল্যান্ডিং স্টেশন, ফোর লেনের পায়রা সেতু, শেরেবাংলা নৌ-ঘাঁটি ও ইপিজেড স্থাপিত হলে পুরো দক্ষিণাঞ্চল গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক জোনে পরিণত হবে। পদ্মা সেতু খুলে দেওয়া হলে বরিশালের জেলাগুলোর সঙ্গে সারা দেশের সরাসরি সড়ক যোগাযোগব্যবস্থা চালু হবে। সাগরকন্যা কুয়াকাটায় পর্যটনের প্রসার বাড়ার পাশাপাশি কর্মসংস্থানের ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি হবে। পায়রা থেকে কুয়াকাটার বিস্তৃত এলাকা ঘিরে পর্যটনভিত্তিক উন্নয়নের লক্ষ্যে একটি সমন্বিত মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়েছে সরকার। এই মাস্টারপ্ল্যানে থাকছে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর, আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র, শিল্পভিত্তিক বন্দরনগরী, পরিকল্পিত নগরায়ণ, যোগাযোগ, অর্থনীতি ও কৃষি খাতের উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও দুর্যোগ ঝুঁকিসহ জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলাভিত্তিক কার্যক্রম। পদ্মা সেতু এসব ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা রাখবে। বরিশালের বাসিন্দা ও আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আনিসুর রহমান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দক্ষিণবঙ্গ মানেই যেন নৌপথ। বিশেষ করে বৃহত্তর বরিশালে যাতায়াতে যেন নৌপথের ওপরই ভরসা রাখতে হয়। লঞ্চ তো আছেই, এ অঞ্চলে সড়কে চলতে হলেও ফেরির বিকল্প ছিল না এত দিন। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সাহসী পদক্ষেপের ফলে অবসান ঘটছে দীর্ঘ প্রতীক্ষার। নৌনির্ভর এ পথে এবার দিনবদলের স্মারক এখন পদ্মার বুকে ঠায় দাঁড়িয়ে। অপেক্ষা ২৫ জুনের।’ তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে বাংলাদেশের অপ্রতিরোধ্য অগ্রযাত্রায় এবার আরও একধাপ এগিয়ে যাবে দীর্ঘদিনের অবহেলিত এ জনপদ। মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার বাসিন্দা এবং ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম সরোয়ার কবির বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘পদ্মা সেতুকে ঘিরে মুন্সীগঞ্জে পর্যটন এলাকা বিকশিত হচ্ছে। জমির মূল্য বেড়েছে কয়েক শ গুণ। হোটেল-মোটেল ও হাউজিং প্রকল্প তৈরি হচ্ছে। কৃষির খামার গড়ে উঠছে। এখন মানুষ আর ঢাকা শহরে থাকতে চাচ্ছে না, এক্সপ্রেসওয়ে রাস্তা তৈরি হওয়ায় মানুষ গ্রামে ফিরে যাচ্ছে, বাড়ি থেকে অফিস করছে। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু নির্মাণের ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে।’

সর্বশেষ খবর