শনিবার, ১৮ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

বহুমুখী ডিজিটাল অপরাধ

মোট মামলার ২৭ শতাংশ অপপ্রচারের, অনলাইন কেনাকাটায় ২১ শতাংশ, পর্নোগ্রাফি ২০ শতাংশ

আলী আজম

রাজধানীতে বহুমুখী ডিজিটাল অপরাধ বাড়ছে। সচেতনতার অভাবে এটা ক্রমেই বেড়ে চলছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগে বহুমুখী সাইবার অপরাধের অভিযোগে করা মামলার তদন্তে এসব তথ্য আসছে। চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আসা ৭৪টি মামলার ২৭ দশমিক ২ শতাংশ অপপ্রচারের, অনলাইন কেনাকাটায় ২১ দশমিক ৬১ শতাংশ, পর্নোগ্রাফি মামলা ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ। ডিবি-সাইবার বলছে, সচেতনতার অভাবে এসব অপরাধ বাড়ছে।

মোহাম্মদ রাশেদ হোসেন প্রান্ত এবং মৌসুমী খাতুন দম্পতি টেলিমেডিসিন চিকিৎসার নামে প্রতারণা করে আসছিল। রাশেদ রাজশাহীতে একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী আর মৌসুমী নার্সিং ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। করোনার শুরুতে যখন টেলিমেডিসিন চিকিৎসা জনপ্রিয়তা পায়, ঠিক তখনই তাদের মাথায় চাপে প্রতারণার বুদ্ধি। দুজন মিলে শুরু করেন টেলিমেডিসিন চিকিৎসা। অনলাইনে দিতে থাকেন চিকিৎসাসেবা। তবে নিজেদের নামে নয়, দেশের নামকরা চিকিৎসকদের নাম ভাঙিয়ে। গত দুই বছরে ভুয়া চিকিৎসাসেবা দেওয়ার নামে এ দুই প্রতারক হাতিয়ে নিয়েছেন লাখ লাখ টাকা। তাদের দেওয়া চিকিৎসাপত্রে ওষুধ কিনে আর্থিকভাবে ক্ষতির পাশাপাশি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অনেকে। গত ২০ এপ্রিল রাজশাহীর শাহ মখদুম থেকে তাদের গ্রেফতার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। গত ২৭ এপ্রিল ঢাকা, গাজীপুর, চট্টগ্রাম ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ এলাকায় অভিযান চালিয়ে মোবাইল ফোন চুরি ও ছিনতাইয়ের পর পুনরায় বাজারজাতে জড়িত চক্রের মূল হোতাসহ ১৩ জনকে গ্রেফতার করে ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তাদের কাছ থেকে ১৫৩টি মোবাইল ফোন, দুটি হার্ড ডিস্ক, তিনটি ডঙ্গল, ৪৯টি সিম ও ৩০টি মেমোরি কার্ড জব্দ করা হয়। ডিবি বলছে, গ্রেফতাররা গাড়ি নিয়ে বিভিন্ন জনসমাগমস্থল, বাস টার্মিনাল, ট্রেন স্টেশন ও মার্কেটে অবস্থান করে মোবাইল চুরি ও ছিনতাই করে। মোবাইল চুরির পর মোবাইলটি বন্ধ করে অন্য সদস্যের কাছে দিয়ে আবারও চুরির কাজে লেগে যায়। পরবর্তীতে চুরি করা মোবাইল সেটগুলো সফটওয়্যার ব্যবহার করে আইএমইআই পরিবর্তন ও স্ক্রিনলক খুলে লোকাল মার্কেটে বিক্রি করে। তবে আইফোনের লক খোলার ক্ষেত্রে এ চক্রের সদস্যরা আইটি এক্সপার্টের সহায়তা নিত। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী এলাকার একটি মাদরাসা ও এতিমখানার শিক্ষক আসাদুল ইসলাম। কিন্তু শিক্ষকতার আড়ালে প্রতারণা করে আসছিলেন তিনি। অনলাইনে মোবাইল ফোন সেট বিক্রির বিজ্ঞাপন ও পোস্ট দিয়ে গ্রাহকের অর্থ হাতিয়ে নিতেন।

দুই বছর ধরে গ্রাহকের লাখ লাখ টাকা তিনি আত্মসাৎ করেছেন। গত ৩ জুন যাত্রাবাড়ীর মির হাজিরবাগ থেকে তাকে গ্রেফতার করে সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। তিনি অন্যের নামে নিবন্ধিত সিম কার্ড ব্যবহার করে ও ভুয়া ফেসবুক আইডিতে মোবাইল বিক্রির ভুয়া বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা করতেন।

পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করেছে লিটন ইসলাম। কিন্তু প্রযুক্তিগতভাবে খুবই দক্ষ। এ প্রযুক্তিজ্ঞানের অপব্যবহার করে তিনি হ্যাক করেন মানুষের ফেসবুক আইডি। আর এর মাধ্যমে হাতিয়ে নেন মোটা অংকের টাকা। গত দুই বছরে তিনি আড়াই হাজার ফেসবুক আইডি হ্যাক করেছেন। হ্যাক করার পরই তিনি আইডি নিয়ে পর্যালোচনা করতে থাকেন। সাধারণ আইডি হলে তা ফেরত দেওয়ার বিনিময়ে ১০-২০ হাজার টাকা দাবি করতেন। আর আইডিতে স্পর্শকাতর কিছু পাওয়া গেলে কয়েক লাখ টাকা পর্যন্ত দাবি করতেন। টাকা আদায়ের জন্য তার রয়েছে সাতটি মোবাইল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্ট। দীর্ঘদিন ধরে ফেসবুক আইডি হ্যাক করে চাঁদাবাজি করলেও লিটন এর আগে কখনো গ্রেফতার হননি। তবে আনোয়ার হোসেন নামে এক ব্যক্তির আইডি হ্যাক করে তিনি গোয়েন্দা জালে ধরা পড়েন। গত ১০ এপ্রিল ঢাকার আশুলিয়া এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাকে গ্রেফতার করে ডিবি।

রাজধানীর মুগদা এলাকার এক তরুণীর সঙ্গে বন্ধুত্ব হয় রক্সি গোমেজ নামে এক যুবকের। হোয়াটসঅ্যাপে তাদের কথোপকথন হতো। রক্সি গোমেজ কৌশলে ওই তরুণীর কিছু আপত্তিকর ভিডিও ধারণ করে। পরবর্তীকালে ওই ভিডিও প্রকাশের ভয় দেখিয়ে নিয়মিত ব্ল্যাকমেইল করতে থাকে। এক পর্যায়ে ওই তরুণী রক্সি গোমেজের সঙ্গে যোগাযোগ করা বন্ধ করে দেন। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি রক্সি গোমেজ ওই তরুণীর ভাইয়ের বন্ধুর ম্যাসেঞ্জারে কিছু আপত্তিকর ভিডিওর স্ক্রিনশর্ট পাঠিয়ে তরুণীর পরিবারের কাছে ২ লাখ টাকা দাবি করে। এ ঘটনায় ভুক্তভোগী তরুণী ২০ ফেব্রুয়ারি ডিএমপির মুগদা থানায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা করেন।

এসব ভুক্তভোগীর বেশিরভাগই উঠতি বয়সের তরুণী। বেশিরভাগ মামলাই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও প্রচারের অভিযোগে করা। এ ছাড়া বিভিন্ন পর্নোসাইটে আপত্তিকর ভিডিও আপলোডের ঘটনাও রয়েছে। প্রেম, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক ও বন্ধুত্বের সুযোগে ধারণ করা আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও ফেসবুক, ইউটিউব ও বিভিন্ন পর্নোসাইটে ছেড়ে দেওয়ার ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব ঘটনায় পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা যতটা হচ্ছে তার চেয়ে বেশি হচ্ছে সাধারণ ডায়েরি (জিডি)। কারণ ভুক্তভোগীরা সামাজিক ও পারিবারিক কারণে মামলা নিয়ে বেশিদূর এগোতে চান না।

 

সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের হিসাবে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত পাঁচ মাসে মোট ৭৪টি মামলা তদন্তের দায়িত্ব পায় সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগ। এসব মামলার মধ্যে ২৭ দশমিক ২ শতাংশ অপপ্রচারের, অনলাইন কেনাকাটায় ২১ দশমিক ৬১ শতাংশ, পর্নোগ্রাফি ২০ দশমিক ২৭ শতাংশ, মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা ১৮ দশমিক ১৮ শতাংশ, ফেসবুক হ্যাকিং ৮ দশমিক ১০ শতাংশ, অনলাইনের মাধ্যমে প্রতারণা ৮ দশমিক ১০ শতাংশসহ বিভিন্ন প্রতারণা রয়েছে। ডিবি-সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগে ২০২১ সালে সাইবার অপরাধের মামলা এসেছে ২০৬টি এবং ২০২০ সালে এসেছে ৫০টি।

সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) মোহাম্মদ তারেক বিন রশিদ পরামর্শ দিয়ে বলেন, সাইবার স্পেসে অপরিচিত কোনো আইডি থেকে পাঠানো কোনো লিংকে প্রবেশ না করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অপরিচিত কোনো আইডির সঙ্গে বন্ধুত্ব না করা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে যথাযথ সিকিউরিটি সেটিংস ব্যবহার করা, ম্যাসেঞ্জারে স্পর্শকাতর তথ্য, ছবি বা ভিডিও শেয়ার না করা। একটু সচেতন হলেই বহুমুখী ডিজিটাল অপরাধ থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা সম্ভব।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর