বুধবার, ২২ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

তালিকা হচ্ছে ক্ষয়ক্ষতির

♦ সোয়া লাখ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট ♦ মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে ক্ষতি ৬০০ কোটি টাকা

উবায়দুল্লাহ বাদল

দেশের চলমান বন্যায় এ পর্যন্ত ১৬ জেলার ১ লাখ ১৩ হাজার ২৯৭ হেক্টর ফসলি জমি ডুবে গেছে। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে কমবেশি ৩২ লাখ মানুষ। ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষের লাখ লাখ বাড়িঘর এখন বন্যার পানিতে ভাসছে। বানের পানিতে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে কয়েক শ কিলোমিটার রাস্তাঘাট। ভেঙে গেছে জাতীয় ও আঞ্চলিক সড়ক-মহাসড়ক। ভেসে গেছে কমবেশি ৭২ হাজার গরু ও মৎস্য খামার। শুধু মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতেই প্রাথমিক ক্ষতির পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তবে ফসলি জমির ক্ষয়ক্ষতির এখনো কোনো হিসাব পাওয়া যায়নি। গতকাল পর্যন্ত কৃষি মন্ত্রণালয়, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট দফতর সূত্রে বন্যায় ক্ষয়ক্ষতির এই প্রাথমিক হিসাব মিলেছে।

তবে মাঠে এই মুহূর্তে তেমন কোনো ফসল না থাকায় বন্যায় ধান জাতীয় ফসল উৎপাদনে তেমন কোনো প্রভাব পড়বে না বলে জানিয়েছেন কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক। তিনি বলেছেন, তবে শাক-সবজি উৎপাদনে প্রভাব পড়তে পারে। গতকাল সচিবালয়ে মালদ্বীপের হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকের পর সাংবাদিকদের তিনি এসব কথা বলেন। কৃষিমন্ত্রী বলেন, ‘কয়েকদিন আগে চেরাপুঞ্জিতে অস্বাভাবিক বৃষ্টি হওয়াতে তিন-চার দিনে প্রায় ২ হাজার ২০০ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। এটা ১২২ বছরের রেকর্ড ভঙ্গ হয়েছে। ফলশ্রুতিতে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ এলাকায় অস্বাভাবিক পানি ঢুকে। এই মুহূর্তে কোনো ফসল তেমন মাঠে ছিল না। তারপরও সিলেটের ২২ হাজার হেক্টর জমির ক্ষতি হয়েছে। সুনামগঞ্জ হবিগঞ্জ মিলে প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর জমির আউশ ধানের ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম, নীলফামারী এই এলাকায় যে পানি আসছে তাতে ৫৬ হাজার হেক্টর জমির ক্ষতি হয়েছে।’

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, চলমান বন্যায় এখনো ক্ষয়ক্ষতির চূড়ান্ত হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত বন্যায় দেশের ১৬ জেলায় ১ লাখ ১৩ হাজার ২৯৭ হেক্টর ফসলি জমি ডুবে গেছে। বন্যার পানি কয়েকদিন থাকলে এসব ফসল নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর মধ্যে ৬৩ হাজার ১২৯ হেক্টর জমিতে আউশ ধান রয়েছে। রোপা আমন বীজতলা রয়েছে ৬০৬ হেক্টর জমিতে, বোনা আমন রয়েছে ১৮ হাজার হেক্টর, শাক-সবজি রয়েছে ৯ হাজার ৮৭০ হেক্টর এবং অন্যান্য ফসল রয়েছে ২০ হাজার ৭১৯ হেক্টর জমিতে। তবে এসব ফসলি জমি ডুবে যাওয়ায় কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখন হিসাব করা হয়নি। বন্যার পর এ বিষয়ে চূড়ান্ত হিসাব পাওয়া যাবে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের জাতীয় দুর্যোগ সাড়াদান সমন্বয় কেন্দ্রের (এনডিআরসিসি) তথ্যানুযায়ী, গতকাল পর্যন্ত বন্যায় ১৩টি জেলার ৩১ লাখ ৩২ হাজার ৮৪৩ জন মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। এসব বন্যার্ত মানুষের জন্য সরকার এ পর্যন্ত ত্রাণ সহায়তা দিয়েছে ২ হাজার ২২০ টন চাল, নগদ ৩ কোটি ৮৬ লাখ টাকা এবং ৭১ হাজার শুকনা খাবারের প্যাকেট বিতরণ করা হয়েছে।

এদিকে স্থানীয় সরকার বিভাগ বলছে, এবারের বন্যায় কয়েক শ কিলোমিটার স্থানীয়, আঞ্চলিক ও জাতীয় সড়ক-মহাসড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বানের পানিতে ডুবে গেছে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ রাস্তাঘাট, কালভার্ট-সেতুসহ বিভিন্ন স্থাপনা। বন্যার পানি নেমে গেলে ডুবে যাওয়া সব রাস্তা মেরামত করতে হবে। এখন পর্যন্ত ক্ষতিগ্রস্ত রাস্তাঘাটের পরিমাণ জানা যায়নি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব মোহাম্মদ মেসবাহ উদ্দিন চৌধুরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখনো বন্যা চলমান। বন্যার পানি নেমে যাওয়ার পর রাস্তাঘাটের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ হিসাব করা হবে।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী চলমান বন্যার পানিতে কমবেশি ৭২ হাজার গরু ও মৎস্য খামার ভেসে গেছে। এতে প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ৬০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয় ও অধিদফতর সংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে মৎস্য অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) খ: মাহবুবুল হক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন,  সোমবার পর্যন্ত বন্যায় দেশে ৫ বিভাগের ৭০ হাজার মাছের খামার ভেসে গেছে। এর মধ্যে ১৬০ কোটি ৪১ লাখ ৯১ হাজার টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গতকালের হিসাব পাওয়া যায়নি। তবে তা ২০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যেতে পারে। তিনি আরও বলেন, প্রতিদিনই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে। প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ জানতে আরও সময় লাগবে।’

প্রাণিসম্পদ অধিদফতর সূত্র জানিয়েছে, দেশের চলমান বন্যায় দেশের ১৪টি জেলার ৯৮টি উপজেলার ২ হাজার ৫৪টি গরুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে খামারিদের ক্ষতির পরিমাণ ৩১৭ কোটি টাকার বেশি। এর মধ্যে ভয়াবহ বন্যাকবলিত সুনামগঞ্জ জেলার হিসাব নেই। এ বিষয়ে প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের মহাপরিচালক (ডিজি) ডা. মনজুর মোহাম্মদ শাহজাদা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘এখন পর্যন্ত আমরা সারা দেশের ক্ষয়ক্ষতির চিত্র হাতে পাইনি, তবে প্রাথমিক হিসাব অনুযায়ী গতকাল পর্যন্ত প্রায় ২ হাজার গরুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বেশি হতে পারে। প্রতিদিনই ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ বাড়ছে।’

প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের কন্ট্রোল রুমের দায়িত্বে থাকা আলী রেজা আহম্মেদ জানান, গতকাল পর্যন্ত ৫ বিভাগের ৯৮টি উপজেলার ৫৭০টি ইউনিয়নের ২০ হাজার ৫৪টি গরুর খামার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে ক্ষতি হয়েছে ৩১৭ কোটি ১২ লাখ ২৭ হাজার ৯০০ টাকা। এ ছাড়া যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় ভয়াবহ বন্যাকবলিত সুনামগঞ্জের ১১টি উপজেলার ৮৮টি ইউনিয়নের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যায়নি। এ পর্যন্ত যতটুকু জানা গেছে তাতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৯৮ কোটি টাকা। সে হিসাবে প্রাণিসম্পদ খাতে এ পর্যন্ত ৪০০ কোটি টাকার বেশি ক্ষতি হয়েছে। যদিও এটি প্রাথমিক ক্ষয়ক্ষতির হিসাব।

 

সর্বশেষ খবর