রবিবার, ২৬ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

প্রাণের উচ্ছ্বাসে পদ্মাপাড়ে জনসমুদ্র

শামীম আহমেদ ও বেলাল রিজভী, মাদারীপুর থেকে

বহুল প্রতীক্ষিত স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ উপলক্ষে গতকাল পদ্মার দুই পাড়ে নামে মানুষের ঢল। শুধু দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার লাখ লাখ মানুষই নয়, অন্যান্য জেলা থেকেও ছুটে আসে অসংখ্য মানুষ। সেতু উদ্বোধন উপলক্ষে মাদারীপুরের শিবচরের কাঁঠালবাড়ীর বাংলাবাজার ইলিয়াস আহমেদ চৌধুরী ফেরিঘাট প্রান্তে বেলা সাড়ে ১১টায় জনসভা শুরু হওয়ার কথা থাকলেও সামনের সারিতে থেকে প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানাতে রাত ৩টা থেকেই ব্যানার-ফেস্টুন হাতে বাদ্য বাজিয়ে মিছিল নিয়ে জনসভাস্থলে হাজির হতে থাকে মানুষ। ভোরের আলো ফুটতেই বাড়তে থাকে ভিড়। চাঁদপুর, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা, ভোলাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে মানুষ নিয়ে জনসভাস্থলের পাশে ভিড়তে থাকে বড় বড় লঞ্চ। অনেকে আসেন ট্রলারে করে। বাগেরহাট, খুলনা, ফকিরহাট, মোল্লাহাট, সাতক্ষীরাসহ বিভিন্ন জেলা থেকে বাসযোগে আসে লাখ লাখ মানুষ। গাড়ির চাপের কারণে মাদারীপুরের পাঁচ্চর থেকে প্রায় ৮ কিলোমিটার পথ পায়ে হেঁটেই জনসভাস্থলে হাজির হন অনেকে। তবে এই পথ চলাতে ছিল না ক্লান্তি। ছিল উচ্ছ্বাস।

দেশের ইতিহাসে নিজস্ব অর্থায়নে নির্মিত সর্ববৃহৎ অবকাঠামো উদ্বোধনের জনসভাস্থল দুপুরের মধ্যে জনসমুদ্রে পরিণত হয়। বাদ্য যন্ত্র, ব্যান্ড পার্টি, পদ্মা সেতুর প্রতিকৃতি ব্যানার এবং প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিভিন্ন স্লোগান বুকে গেঁথে খণ্ড মিছিল নিয়ে হাজির হন বিভিন্ন জেলার মানুষ। বেলা ১১টার আগেই ১৫ একর এলাকার জনসভাস্থল কানায় কানায় মানুষে পূর্ণ হয়ে যায়। ঠাঁই না পেয়ে অনেকে জনসভাস্থল থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে রাস্তায়, মানুষের বাড়ির উঠানে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য শোনেন। নদীর মধ্যে শতাধিক লঞ্চ, ট্রলার ও নৌকায় অবস্থান নেন অনেকে। দুপুরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভাপতির ভাষণ শুরু করলে কিছুক্ষণ পরপরই জনসভাস্থল ও নদীর ভিতরে নৌযান থেকে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। জনসভায় ১০ লক্ষাধিক মানুষ উপস্থিত হয় বলে দাবি আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের।

কখনো প্রচণ্ড রোদ, কখনো বৃষ্টি- এমন বিরূপ পরিবেশেও মানুষের চোখে-মুখে ছিল বাঁধ ভাঙ্গা উচ্ছ্বাস। ১৫ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে জনসভার মাইক লাগানো হয়। বিভিন্ন জায়গা ও গুরুত্বপূর্ণ বাজারগুলোতে প্রজেক্টরে সরাসরি দেখানো হয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ। জনসভাস্থল ছাড়াও ওইসব এলাকায় মানুষের বড় সমাগম দেখা যায়। পদ্মা সেতুর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক নেই এমন জেলা থেকেও আসেন অনেকে। ১০ বছরের নাতিসহ পদ্মাপাড়ে হাজির হন কিশোরগঞ্জের ভৈরবের নুরুল ইসলাম। দাদা-নাতি দুজনই চুল কেটে মাথায় এঁকেছেন নৌকা ও বাংলাদেশের পতাকা। পদ্মা সেতু দিয়ে ভৈরবের মানুষের যাতায়াতের কোনো বিষয় না থাকলেও এতদূর থেকে জনসভায় আসার কারণ জানতে চাইলে হাত উঁচু করে বলে ওঠেন ‘জয় বাংলা’। এক কথায় উত্তর দেন- ‘পদ্মা সেতু বাংলাদেশের। আর বাংলাদেশটা আমাদের সবার।’

সেতুটি উদ্বোধন উপলক্ষে গতকাল জনসভায় আসা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের ভিতর ছিল ঈদ আনন্দ। মহাৎসবের এই আয়োজনে বরগুনা থেকে এসেছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা আবুল কালাম আজাদ। তিনি বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলাম। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ আমরা অবহেলিত ছিলাম। একটি সেতুর জন্য আমাদের ঢাকায় যেতে এক দিন লেগে যেত। এখন আমরা সহজেই পার হতে পারব, এটা বঙ্গবন্ধুর কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনার অবদান। আমরা হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা জানাতেই উপস্থিত হয়েছি। এত দূর আসা কষ্ট হলেও তা মনে হচ্ছে না।

দুই পা না থাকলে গোপালগঞ্জের মকসুদপুর থেকে জনসভায় ছুটে আসেন ফরহাদ শেখ। বলেন, ছোট এটা দোকান চালাই। বন্ধ করে অন্যদের সহযোগিতা নিয়ে জনসভায় এসেছি। একটা সেতু না থাকায় এতদিন অনেক শঙ্কটাপন্ন রোগী ফেরিতে মারা গেছে। এই সেতুটি হওয়ায় আমাদের দুরবস্থা লাঘব হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা।

রাত ৩টায় হাজির ষাটোর্ধ্ব ইয়াকুব আলী : গতকাল রাত ৩টার দিকেই ছেলেদের নিয়ে কাঁঠালবাড়ীর জনসভাস্থলে হাজির হন ষাটোর্ধ্ব ইয়াকুব আলী। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়ি কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নে। কুতুবপুর ও মাদবরের চর ইউনিয়নের লোকজন রাতেই চলে আসবে শুনেছিলাম। তাই সামনে জায়গা পেতেই আগে চলে এসেছি। শেখের বেটিকে (শেখ হাসিনা) সামনে থেকে দেখতে চাই।’ শুধু ইয়াকুব আলী নয়, হাজারো মানুষকে জনসভাস্থলের আশপাশে দেখা যায় রাত ৩টায়। কুতুবপুর ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের সেলিম দরানী বলেন, রাত ৩টায় জনসভাস্থলে এসেছি। ভোররাতেই এই ইউনিয়নের অন্তত ৭-৮ হাজার মানুষ জনসভাস্থলে পৌঁছে গেছে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পুরো এলাকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান ও টহল।

রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষের ঢল : সকাল ১০টার পরই শুরু হয় গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। ভিড়ের কারণে কাঁঠালবাড়ীর সীমানা এলাকা থেকে জনসভাস্থলের দিকে গাড়ি ঢোকা বন্ধ করে দেয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। ২ কিলোমিটার পথ বৃষ্টি ভিজেই মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসে মানুষ। কারও গায়ে হলুদ টিশার্ট, কারও গোলাপি, কারও আবার নীল। সবার টিশার্টে পদ্মা সেতুর ছবি আর প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে শুভেচ্ছাবার্তা। এদিকে সাড়ে ১০টার দিকে বৃষ্টি থামিয়ে প্রচণ্ড তাপ নিয়ে হাজির হয় সূর্য। তীব্র রোদ উপেক্ষা করে একের পর এক মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে ঢুকতে থাকে বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা আওয়ামী লীগ ও দলটির অঙ্গসংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আগতদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা, পদ্মা সেতুর ছবি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে শুভেচ্ছাবার্তা।

শত লঞ্চে লাখো মানুষ : দক্ষিণাঞ্চলসহ মাদারীপুরের আশপাশের বিভিন্ন এলাকা থেকে এক শটিরও বেশি লঞ্চে কয়েক লাখ মানুষ এসে জড়ো হয় জনসভায়। ঝালকাঠি থেকে আসা পলাশ রায় বলেন, আমাদের স্বপ্ন ছিল একদিন এই পদ্মা নদী সেতু হয়ে পার হবো। সেই সেতুর উদ্বোধন একটা ইতিহাস। ইতিহাসের সাক্ষী হতে ছুটে এসেছি। মাদারীপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শাহাবুদ্দিন আহমেদ মোল্লা বলেন, পদ্মা সেতুর জনসভা সফলভাবে সমাপ্ত হয়েছে। এই সমাবেশে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখ লাখ মানুষ যে যেভাবে পেরেছে, সেভাবেই এসে উপস্থিত হয়েছে। বাস, ট্রাক অটোতে করে এসেছে। তবে দেশের দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন এলাকা থেকে ছোট বড় প্রায় শতাধিক লঞ্চে করেও লাখ লাখ মানুষ এসেছে। লঞ্চগুলোর নোঙর করে রাখার জন্য ১৫টি পন্টুন আমরা আগে থেকেই স্থাপন করে রেখেছিলাম।

 

সর্বশেষ খবর