সোমবার, ২৭ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

ঢাকা-বরিশাল সাড়ে ৩ ঘণ্টায়

আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু যান চলাচল

আরাফাত মুন্না, মাওয়া থেকে ফিরে

রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে গতকাল সকাল ৮টায় ছেড়ে যাওয়া একটি বাস বরিশালের নথুল্লাবাদ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে পৌঁছে বেলা সাড়ে ১১টায়। সময় লাগে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টা। এ পথ যেতে আগে লাগত ৬ থেকে ৮ ঘণ্টার বেশি। একই সময়ে সাকুরা পরিবহনের বাস ছেড়ে যায় পটুয়াখালীর উদ্দেশে। পৌঁছে দুপুর দেড়টায়। ১০ ঘণ্টার বেশি সময়ের এ পথ মাত্র সাড়ে ৫ ঘণ্টায় পাড়ি দেয় বাসটি। অবিশ্বাস্য মনে হলেও এটাই পদ্মা সেতুর ফল বলছেন যাত্রী ও পরিবহন শ্রমিকরা। গতকাল পদ্মা সেতু দিয়ে নদী পার হয়ে এমন মন্তব্যই তাদের। শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতুর উদ্বোধন করলেও গতকালই যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। ভোর ৬টায় উন্মুক্ত করার কথা থাকলেও ১০ মিনিট আগেই খুলে যায় স্বপ্নের পদ্মা সেতুর দুয়ার। প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল নিয়ে মধ্যরাত থেকে সেতুর প্রবেশমুখে অবস্থান নেওয়া মানুষগুলো মুহূর্তেই ছোটেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে পিকআপ-বাসে করে সেতু পার হয় হাজার হাজার   মানুষ। এসময় সবার মধ্যেই দেখা গেছে উচ্ছ্বাস-আনন্দ। প্রথম দিনে সেতু পার হতে দূর-দূরান্ত থেকেও এসেছেন অনেকে। প্রথম দিনের প্রথম ৮ ঘণ্টায় সেতু দিয়ে পারাপার হয়েছে ১৫ হাজারের বেশি যানবাহন। ভোর ৬টা ১২ মিনিটে মাওয়া প্রান্তে সেতুতে চড়া প্রথম যাত্রীবাহী বাসটি এনা পরিবহনের। এর নম্বর ঢাকা-মেট্রো-ব-১৫-৪৬২৪। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসটির চালক মো. বাবুল বলেন, ‘আমি খুবই খুশি আমার বাস প্রথম ব্রিজ দিয়া যাবে। এই আনন্দ আপনারে বুঝাইতে পারব না। আমি দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ, কিন্তু বাস চালাই উত্তরবঙ্গ রুটে। পদ্মা সেতু দেখতাম আর ভাবতাম, এই ব্রিজে কি আমার গাড়ি চালানোর সৌভাগ্য হইব? দেখেন আল্লাহ আমার আশা পূরণ করছে। প্রথম বাস আমারটাই উঠল।’ বাসটি এই রুটে চলাচল না করলেও পদ্মা সেতু দেখতে আসা যাত্রীরা রিজার্ভ করে নিয়ে আসায় সেতুতে উঠতে পেরেছেন বলেও জানান চালক।

সেতু চালু হওয়ার পর জাজিরা প্রান্ত থেকে সেতুতে ওঠে যাত্রীবাহী ইমাদ পরিবহন। খুলনা থেকে ছেড়ে আসা বাসটির চালক মো. হানিফ টোল প্লাজায় টোল পরিশোধ করে ‘আনন্দের সীমা নাই’ বলে চিৎকার করেন। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীকে আমার পক্ষ থেকে অনেক অনেক স্যালুট।’ তিনি বলেন, ‘মনে করি নাই বাঁইচা থাকতে পদ্মা সেতুতে গাড়ি চালাইয়া যাইব। আমার অনেক খুশি লাগতাছে। আমাদের সব ড্রাইভারের পক্ষ থেকে হাজারবার স্যালুট।’ এই বাসের যাত্রীরাও সবাই আনন্দ-উচ্ছ্বাস প্রকাশ করতে থাকেন। সেতু দিয়ে প্রথম দিনেই পার হতে মধ্যরাত থেকেই মাওয়া ঘাটে অবস্থান নেওয়ার কথা জানান বাইকার্স গ্রুপ ‘বাইকার্স অব জিরো সেভেন জিরো নাইন’ সদস্যরা। ঢাকা থেকে যাওয়া ১২ জনের এই টিমের দুজন সদস্য  রংপুর ও খাগড়াছড়ি থেকে এসেছেন পদ্মা সেতু দেখতে। সেতু ঘুরে এসে দুপুরে এই টিমের সদস্য মাহাবুব হোসেন লরিন বলেন, এই অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না। সেতুতে উঠব বলে গত রাত (শনিবার দিবাগত রাত) থেকে অপেক্ষা করছি। মাওয়া ফেরিঘাটে রাতে বন্ধুরা সবাই মিলে ইলিশ খেয়েছি। পরে সেতুর প্রবেশমুখে মোটরসাইকেল নিয়ে লাইনে দাঁড়িয়েছি। এমন একটি সেতু তৈরি করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও ধন্যবাদ জানান তিনি।

প্রথম ৮ ঘণ্টায় পার হয় ১৫ হাজার ২০০ গাড়ি : পদ্মা সেতুতে গতকাল যান চলাচল শুরুর প্রথম ৮ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ২০০টি গাড়ি চলাচল করেছে। এ থেকে টোল আদায় হয়েছে ৮২ লাখ ১৯ হাজার ৫০ টাকা। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী আবুল হোসেন গণমাধ্যমকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। জাজিরা প্রান্তে তিনি বলেন, মাওয়া প্রান্তে ৮ হাজার ৪৩৮টি গাড়ি চলাচলে আয় হয়েছে ৪৬ লাখ ৮৯ হাজার ৫৫০ টাকা। জাজিরা প্রান্তে ৬ হাজার ৭৬২টি গাড়ি চলাচলে ৩৫ লাখ ২৯ হাজার ৫০০ টাকা। তিনি আরও বলেন, সকাল থেকে যেসব গাড়ি চলাচল করেছে তার ৬০ শতাংশই মোটরসাইকেল। ট্রাক কিংবা বড় যান কিছুটা কম প্রথম দিন। সেতুর টোলপ্লাজায় দায়িত্বরত এই শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, সকাল থেকে আমরা প্রস্তুত ছিলাম। ৬টার আগেই যান চলাচলের জন্য কাজ শুরু করি।

৭ মিনিটে পদ্মা পার : ৭ মিনিটে পদ্মা সেতু পার হয়েছে শরীয়তপুরের প্রথম বাসটি। গতকাল সকাল সাড়ে ৮টায় শরীয়তপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে ঢাকার সায়েদাবাদের উদ্দেশে ছেড়ে আসা শরীয়তপুর সুপার সার্ভিসের একটি বাস পদ্মা সেতুর জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজায় পৌঁছায় সাড়ে ৯টায়। এরপর কয়েক সেকেন্ডে টোল দিয়ে ৭ মিনিটে পদ্মা সেতু পার হয়ে পৌঁছায় মাওয়া প্রান্তে। এ বাসের চালক দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘৩০ বছর ধরে গাড়ি চালাই। আর নিজের এলাকায় সরাসরি গাড়ি চালিয়ে আসতে পারি নাই। ফেরিতে নানান ঝাক্কি-ঝামেলা, চাঁদা দিয়ে সামনে যাওয়া লাগছে। সরকার নির্ধারিত ২৪০০ টাকা টোল দিয়েছি মাত্র কয়েক সেকেন্ডে। সেতু পার হয়েছি মাত্র ৭ মিনিটে। এত অল্প সময়ে পদ্মা পার হব স্বপ্নেও ভাবি নাই।’ বাসের যাত্রী সাইফুল ইসলাম ও হুমায়ুন কবীর বলেন, কী যে ভালো লাগছে বোঝাতে পারব না। বারবার মনে পড়ছিল কত মানুষ পদ্মা পার হতে গিয়ে জীবন দিয়েছে। যখন পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে যাচ্ছিলাম মনে হচ্ছিল, ‘হৃদয়টা পদ্মা সেতুর চেয়েও দীর্ঘ হয়ে গেছে।’

সাড়ে ৩ ঘণ্টায় বরিশাল : আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক রাহাত খান জানান, পদ্মায় ফেরি পার হয়ে ঢাকা থেকে বরিশাল যেতে আগে লাগত ৬ থেকে ৮ ঘণ্টা। গতকাল পদ্মা সেতু হয়ে ইলিশ পরিবহনের গাড়ি এ পথ পাড়ি দেয় মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টায়। রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে সকাল ৮টায় বরিশালের উদ্দেশে ছেড়ে যায় ইলিশ পরিবহনের গাড়ি। বরিশালে পৌঁছে বেলা সাড়ে ১১টার দিকে। ওই বাসের চালক মো. মোখলেস বলেন, টোল ঘরে প্রথম দিন ভিড় থাকার পরেও সাড়ে ৩ ঘণ্টায় যাত্রীদের নিরাপদে বরিশালে পৌঁছাতে পেরে আনন্দিত তিনি। সড়কপথে প্রথমবারের মতো সাড়ে ৩ থেকে পৌনে ৪ ঘণ্টায় ঢাকায় পৌঁছতে পেরে যাত্রী এবং পরিবহন চালক-শ্রমিকরা বেশ খুশি বলে জানান সাকুরা পরিবহনের বরিশাল কাউন্টার ইনচার্জ মো. আনিচুর রহমান।

৫ ঘণ্টায় পটুয়াখালী : আমাদের পটুয়াখালী প্রতিনিধি সঞ্জয় কুমার দাস জানান, পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এই প্রথম পটুয়াখালীতে যাত্রীবাহী পরিবহনে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ রাজধানী ঢাকা থেকে খুব অল্প সময়ে পটুয়াখালী নিজ শহরের পৌঁছেছেন। দীর্ঘ ভোগান্তির পর মাত্র ৫ ঘণ্টায় পৌঁছতে পেরে যাত্রীরা বেশ আনন্দিত। গতকাল সকাল ৮টায় সাকুরা পরিবহনের একটি বাস ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে রওনা হয়ে দুপুর দেড়টার দিকে পটুয়াখালী চৌরাস্তায় এসে পৌঁছায়। একই সময় ঢাকার আরামবাগ থেকে গ্রিন লাইন পরিবহনের একটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাস এই প্রথম দক্ষিণাঞ্চলের রুটে যাত্রা শুরু করে দুপুর সোয়া ২টায় পটুয়াখালী চৌরাস্তায় এসে পৌঁছে।

 গ্রিন লাইন পরিবহনের যাত্রী আবৃতি সরকার জানান, স্বপ্নের পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর এই প্রথম সেতু পার হলাম এবং গ্রিন লাইনও পদ্মা সেতু পার হয়ে প্রথম পটুয়াখালীতে এসেছে। সব মিলিয়ে স¦প্নের পদ্মা সেতু আর আজকে পটুয়াখালীতে পৌঁছানোটা যেন স্বপ্নের মতো।

সর্বশেষ খবর