শিরোনাম
বুধবার, ২৯ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা

ইভিএমের পক্ষে সাত বিপক্ষে তিন দল

♦ ইসির সংলাপে অংশ নিল আওয়ামী লীগসহ ১০ দল, সাড়া দেয়নি সিপিবি বাসদসহ চার দল ♦ বিএনপি ভোটে আসবে বিশ্বাস কাদেরের

নিজস্ব প্রতিবেদক

দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতিকে আরও জনপ্রিয় এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশনকে এখনই প্রচার শুরুর পরামর্শ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার হলেও আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই। সংলাপে অংশগ্রহণকারী ১০ দলের মধ্যে ইভিএমের পক্ষে বলেছে সাত দল, তিনটি দল ইভিএমের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গতকাল বিকালে ইভিএমের কারিগরি দিক যাচাই এবং আগামী সংসদ নির্বাচনে যন্ত্রটির ব্যবহার নিয়ে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এ পরামর্শ দেন ক্ষমতাসীন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। সিইসি কাজী হাবিবুল আউয়ালের সভাপতিত্বে এ সভায় আমন্ত্রিত ১৪টি দলের মধ্যে অংশ নেয় ১০টি। সিইসির স্বাগত বক্তৃতার পর রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া শুরু হলে প্রথমেই আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন। পরে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য দলের প্রতিনিধিরাও বক্তব্য দেন।  দুই ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জানান, বৈঠকে ৮০-৮৫ শতাংশ বা অধিকাংশই ইভিএমের পক্ষে বলেছেন। ইভিএম নিয়ে বিরুদ্ধেও বলেছেন দুয়েকজন। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে ইভিএমে সব আসনে ভোট করায় আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের। এক প্রশ্নের জবাবে ওবায়দুল কাদের বলেন, (ইভিএমে কত আসনে ভোট হবে) দ্যাট ইজ দ্য ডিসিশন অব ইলেকশন কমিশন। এটা তাদের এখতিয়ার। ... মন থেকে চাই, চেতনা থেকে চাই। ৩০০ আসনে ইভিএম হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা সাপোর্ট করি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি আগেও বলেছি, আমার বিশ্বাস যে, বিএনপি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনে আসবে। আমরাও চাই বিএনপি আসুক। আমরাও চাই একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ ইলেকশন। সে কারণে বিএনপির মতো একটা বড় দল বাইরে থাকবে এটা আমরা চাই না। আমরা চাই তারা আসুক।

সংলাপে ইভিএম নিয়ে ক্ষমতাসীন দল নিজেদের অবস্থান তুলে ধরে কাদের বলেন, আগামী নির্বাচনে ইভিএমের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি করার জন্য আমরা সিইসির কাছে আহ্বান করছি। ...আমরা মনে করি, দেশে ইভিএম পদ্ধতি অধিকতর জনপ্রিয় এবং সহজে ব্যবহার করার লক্ষ্যে ইসি এখন থেকেই প্রচার-প্রচারণায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন।

ওবায়দুল কাদের বলেন, আমাদের নেত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমরা। সেই সিদ্ধান্ত আমাদের দিস ইজ লাউড অ্যান্ড ক্লিয়ার- আমরা ইভিএম পদ্ধতির পক্ষে, রাখঢাক করে কোনো লাভ নেই। ...এখানে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ পদ্ধতিটা বৃদ্ধি করার কথা বলব। ইভিএমের পক্ষে নিজেদের অবস্থানের ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ মনে করে, ইসির কার্যক্রমে ইভিএমসহ প্রযুক্তির বৃদ্ধির কারণে সব কার্যক্রমের স্বচ্ছতা, জবাবদিহি বেড়েছে। ইভিএম ব্যবহারের ফলে ভোট ডাকাতি, কেন্দ্র দখল এবং নির্বাচনে জালিয়াতি, ভোট চুরি বন্ধ হবে।

নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে আওয়ামী লীগ : নির্বাচনের সময় ভোটের নির্বিঘ্ন পরিবেশসহ সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কমিশনের কাছে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক। সেই সঙ্গে নির্বাচনকালীন সরকারের সময় বর্তমান সরকারের ভূমিকা কী হবে তাও তুলে ধরেন তিনি। ওবায়দুল কাদের বলেন, নির্বাচনকালে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ নির্বাচন পরিচালনার জন্যে আবশ্যকীয় সব সংস্থা, প্রতিষ্ঠানকে ইসির তত্ত্বাবধানে ন্যস্ত থাকবে। নির্বাচনকালীন সরকারের কর্মপরিধি কেবলমাত্র আবশ্যকীয় দৈনন্দিন রুটিন কার্যাবলির মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে। বর্তমান সরকার ইসির কোনো কাজে হস্তক্ষেপ করবে না বলেও আশ্বস্ত করেন তিনি। একটা কথা কেউ কেউ বলে থাকে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। বর্তমান সরকারের অধীনে কিন্তু নির্বাচন হচ্ছে না, নির্বাচন হবে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। যে নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন ও কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের জন্য বর্তমান সরকার ফ্যাসিলেটেড করবে, সম্পূর্ণ সহযোগিতা আমরা দেব। এ সময় আইন প্রয়োগকারী সংস্থাসহ যেসব বিষয় নির্বাচন রিলেটেড, সেগুলো আপনাদের অধীনেই থাকবে। এখানে সরকারের কিছু করণীয় নেই। সরকার কোনো প্রকার হস্তক্ষেপ করতে মোটেও আগ্রহী নয়।

গতকাল বৈঠকে উপস্থিত ছিল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল-এমএল, গণতন্ত্রী পার্টি, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, গণফোরাম ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের প্রতিনিধি। ইভিএম দেখার আমন্ত্রণ পেয়েও আসেনি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ। গত ১৯ ও ২১ জুন দুই ধাপে ২৬টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের ইভিএম যাচাই বিষয়ক সভা করেছে ইসি। এই দুই ধাপে ১৮টি দল উপস্থিত থাকলেও সাড়া দেয়নি বিএনপিসহ আটটি দল। গতকাল এ ইস্যুতে তৃতীয় বা সবশেষ সভা করছে ইসি।

বাজে মতলব নেই, আগস্টে রাজনৈতিক সংলাপ : সংলাপ শেষে সিইসি জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই নিজেরা বসে ইভিএম নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। আমরা ইভিএমের অন্ধ গ্রাহক ছিলাম না। সব আলোচনা লিপিবদ্ধ করেছি। আমাদের সামর্থ্য কতগুলো তা দেখব। এরপর সিদ্ধান্ত নেব। সম্পূর্ণ বা ফিফটি ফিফটি করব কি-না সে সিদ্ধান্ত নেব। আগস্ট থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক করব, তখন সব নিয়ে আলোচনা করব। কোনো রাজনৈতিক চাপেও নেই বলে মন্তব্য করেন সিইসি। তিনি বলেন, ‘আমরা একশ শতাংশ নিরপেক্ষ থাকব। কিন্তু কোনো বাজে মতলব নিয়ে আসিনি বা আমাদের কোনো পক্ষ থেকে এই ধরনের কোনো আশ্বাসও কেউ দেননি। কোনো রাজনৈতিক চাপ আমাদের ওপর নেই। সেতুমন্ত্রী আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের প্রসঙ্গ টেনে সিইসি জানান, মন্ত্রী বলেছেন সেই সময় সরকার থাকবে কিন্তু আওয়ামী লীগ থাকবে না। সরকার আর আওয়ামী লীগ এক না। আমরা সরকারের কাছে হেল্প নেব। আওয়ামী লীগের কাছ থেকে আমরা কোনো হেল্প নেব না; প্রশ্নই আসে না। কাজেই আমরা বিশ্বাস করি, সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে যে বিভাজনটা আছে, সেই বিভাজনটাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে আমি উচ্চারণ করতে শুনেছি উনি এ ব্যাপারে খুবই স্পষ্ট, সরকারের তরফ থেকে আমাদের সহায়তা দেওয়া হবে। কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেন, আরেকটি জিনিস হলো- আমরা আপনাদের মাঝে ঐক্য চাচ্ছি, নির্বাচন মাঠে সবাই থাকবেন এবং বিভিন্ন পার্টির উপস্থিতি কিন্তু এক ধরনের ভারসাম্য সৃষ্টি করে নির্বাচনের মাঠে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদককে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আমরা আশা করব স্যার, আপনারা সরকারে থেকে আমাদেরকে সরকারি সাহায্য সহায়তা দেবেন। আমরাও যে সহায়তা চাইব তা সাগ্রহে প্রদান করবেন। যাক আপনি বলেছেন এ জন্য আমরা আশ্বস্ত বোধ করছি এবং এই আশ্বাসটা নিয়ে আমরা আগামীতে কাজ করে যাব।

ইভিএমের পক্ষে সাতদল, বিপক্ষে তিন : গতকাল নিবন্ধিত ১০টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ইভিএমে ভোটের ব্যবহারে সাতটি দল সমর্থন জানিয়েছে। তাদের মধ্যে কোনো কোনো দল ৩০০ আসনেই ইভিএমের ব্যবহারের মতামত দিয়েছেন। উপস্থিত তিনটি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ব্যবহারের বিপক্ষে তাদের মতামত জানিয়েছে। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সংলাপে ইভিএমের পক্ষে বলেছে- ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, বিকল্প ধারা বাংলাদেশ, বাংলাদেশ তরিকত ফেডারেশন, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল-এমএল, গণতন্ত্রী পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জানান, অধিকাংশই ইভিএমের পক্ষে বলেছেন। ইভিএম নিয়ে বিরুদ্ধেও বলেছেন দুয়েকজন। এমন পরিস্থিতিতে আগামী নির্বাচনে ইভিএমে সব আসনে ভোট করায় আপত্তি নেই আওয়ামী লীগের।

জাসদের স্থায়ী কমিটির সদস্য মোশারফ হোসেন বলেন, ইভিএম পরিচিত করানো নির্বাচন কমিশনের দায়িত্ব। এই মুহূর্তে তড়িঘড়ি করে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএমে ভোট করা ঠিক হবে না। আগামী নির্বাচনগুলোকে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট বিষয়ে করার মত দেন তিনি। গণতন্ত্রী পার্টির সাধারণ সম্পাদক ড. শাহাদাত হোসেন বলেন, মেশিন যদি ঠিকঠাক থাকে মেশিন ভালো সার্ভিস দিবে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করার মত দেন তিনি। বিকল্প ধারার মহাসচিব আবদুল মান্নান বলেন, আমরা অবশ্যই ইভিএম চাই। তবে প্রশ্ন হলো এই প্রযুক্তিতে ভোটাররা ভোট দিতে পারবেন কি না? সাম্যবাদী দলের সাধারণ সম্পাদক দিলীপ বড়ুয়া বলেন, ১৪ দল অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর চায়। এ ছাড়া আওয়ামী লীগের দেওয়া প্রস্তাবের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করেন তিনি।

ওয়ার্কার্স পার্টি সাধারণ সম্পাদক ফজলে হোসেন বাদশা বলেন, ইভিএম ব্যবহারে আমাদের কোনো আপত্তি নাই। তবে জাতীয় নির্বাচনের আগে ইভিএম ব্যবহারের আগে স্থানীয় নির্বাচনে ভোট করলে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে। তরিকত ফেডারেশনের মহাসচিব রেজাউল হক চাঁদপুরী বলেন, সবাই যেহেতু ইভিএম বিষয়ে একমত না এ জন্য কমপক্ষে ১৫০ আসনে ইভিএম ব্যবহার করা যেতে পারে।

এ ছাড়া ইভিমের বিপক্ষে বলেছে, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট ও গণফোরাম। গণফোরামের প্রেসিডিয়াম সদস্য সুরাইয়া বেগম বলেন, তাদের দল ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ভোট চায় না। বাংলাদেশ আওয়ামী-ন্যাপের মহাসচিব গোলাম মোস্তফা ভূইয়া মনে করেন ইভিএমের পুরো পদ্ধতিটাই আস্থাহীনতা। সাংস্কৃতিক মুক্তিজোটের সভা প্রধান আবু লায়েন্স মুন্না বলেন, ইভিএম থেকে ইসির সরে আশা উচিত।

সর্বশেষ খবর