বৃহস্পতিবার, ৩০ জুন, ২০২২ ০০:০০ টা
পদ্মা সেতু নিয়ে সংসদে প্রধানমন্ত্রী

ষড়যন্ত্রের কারণে নির্মাণে দেরি

নিজস্ব প্রতিবেদক

ষড়যন্ত্রের কারণে নির্মাণে দেরি

সংসদে গতকাল রওশন এরশাদের স্বাস্থ্যের খোঁজ নেন প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেছেন, ষড়যন্ত্রের কারণে পদ্মা সেতু নির্মাণ দুই বছর দেরি হলেও আমরা হতোদ্যম হইনি। শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ভেদ করে আলোর মুখ দেখেছি। দেশি ও বিদেশি সব ষড়যন্ত্র এবং বাধা-বিপত্তি পেরিয়ে পদ্মা সেতুর স্বপ্ন আজ বাস্তবে রূপ পেয়েছে।

জাতীয় সংসদের গতকালের বৈঠকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটের  ওপর সাধারণ আলোচনার  সমাপনী বক্তব্য এবং প্রধানমন্ত্রীর জন্য প্রশ্নোত্তর পর্বে টেবিলে উপস্থাপিত লিখিত প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন।

শেখ হাসিনা বলেন, করোনাভাইরাস আমরা সফলভাবে মোকাবিলা করতে পেরেছি। ডব্লিউএইচওর নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা শতভাগ টিকা দিয়েছি। নতুনভাবে আবার দেখা দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের জন্য মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে।

সবাইকে কৃচ্ছসাধন করতে হবে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশবাসীর উদ্দেশে বলেন, প্রত্যেককে তার নিজ নিজ জায়গা থেকে যতটুকু সম্ভব কৃচ্ছসাধন করতে হবে। ব্যক্তিগত সঞ্চয় করতে হবে। প্রত্যেকের নিজস্ব সঞ্চয় বাড়ানো এবং মিতব্যয়ী হতে হবে। দেশীয় পণ্যের ব্যবহার বাড়াতে হবে। কথায় কথায় দৌড়ায়ে বিদেশে গিয়ে চিকিৎসা নেওয়া যাবে না। দেশেও ভালো চিকিৎসা হয়। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ ঢালাও ব্যবহার করবেন না, অপচয় যেন না হয় সবাই কিছু কৃচ্ছসাধন করে কিছুটা সঞ্চয় করে নিজেকে সুরক্ষিত রাখবেন। সব প্রকার অপ্রয়োজনীয় ব্যয় তথা অপচয় কমানো, আমদানিকৃত বিলাস পণ্য পরিহার করে শুধু প্রয়োজনীয় জিনিস কেনায় মনোযোগ দিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, শত বাধা ও চাপের মুখে পড়লেও আমরা দৃঢ়ভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। অনেক প্রতিকূল অবস্থায় এগোতে হচ্ছে। উন্নত দেশগুলো যেখানে হিমশিম খাচ্ছে সেখানে আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন গতিশীলতা ধরে রাখতে সক্ষম হয়েছি। আমাদের দেশে-বিদেশে বাইরে সব জায়গায় একটা বাধা পেতে হয়। সেটা অতিক্রম করে আমরা অসম্ভবকে সম্ভবে পরিণত করছি। তিনি বলেন, বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে হবে। আমাদের সরকার সবসময় ব্যবসাবান্ধব সরকার। এ বিষয়টি বিবেচনায় রেখে করপোরেট করহার আরও কমিয়ে ২ দশমিক ২৫ ভাগ হারে হ্রাস করা হয়েছে।

চেষ্টা করছি দ্রব্যের দাম সহনীয় রাখতে : গতকালের বৈঠকে টেবিলে উত্থাপিত প্রশ্নোত্তর পর্বে জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য সৈয়দ আবু হোসেন বাবলার প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন ও সরবরাহ হ্রাস পায়। উপরন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। যুদ্ধের কারণে উৎপাদন ও সরবরাহ ব্যবস্থার অবনতি ঘটে বিধায় বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতি দেখা দেয় এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়। সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বাংলাদেশে দ্রব্যসামগ্রীর উৎপাদন বৃদ্ধি এবং সরবরাহ অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি, অর্থনীতির চাকা সচল রেখে দ্রব্যমূল্যের দাম সহনীয় রাখতে।

এ সময় প্রধানমন্ত্রী বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সঙ্গে মূল্যস্ফীতির তুলনা করে বলেন, মে ২০২২ মাসে ব্রিটেনে মুদ্রাস্ফীতি ছিল ৯%, যুক্তরাষ্ট্রে ৮%, ভারতে ৭ দশমিক ৯% এবং তুরস্কে ৫৪ দশমিক ৮%। এ সময়ে বাংলাদেশে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে হয়েছে ৭ দশমিক ৪২% এবং গড় মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ২%। আমরা চেষ্টা করছি অর্থনীতির চাকা সচল রেখে দ্রব্যমূল্যের দাম সহনীয় রাখতে। তিনি বলেন, ভোক্তা পর্যায়ে দ্রব্যমূল্যের অস্বাভাবিক পার্থক্য নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে পাইকারি এবং খুচরা বাজারে পাকা রশিদের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে। বিষয়টি জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর কর্তৃক কঠোরভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। এ বিষয়ে কোনো অনিয়ম পরিলক্ষিত হলে প্রয়োজনীয় আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

ভোজ্য তেলের মূল্যবৃদ্ধির কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে ভোজ্য তেলের বার্ষিক চাহিদা প্রায় ২০ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে দেশে উৎপাদন হয় মাত্র ২ লাখ মেট্রিক টন। অবশিষ্ট ১৮ লাখ মেট্রিক টন ভোজ্য তেল আমদানি করে ভোক্তা সাধারণের চাহিদা পূরণ করা হয়। তাই আমদানিনির্ভর এ ভোজ্য তেলের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বৃদ্ধি পেলে দেশীয় বাজারেও এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। তিনি বলেন, ভোজ্য তেলের বাজার মূল্য সহনীয় ও স্থিতিশীল রাখার জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন পরিবেশক নিয়োগ আদেশ, ২০১১ মোতাবেক বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে সরকার কর্তৃক ভোজ্য তেলের মূল্য নির্ধারণ করছে। আসন্ন পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে ২২ জুন থেকে গোটা বাংলাদেশে টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী ১ কোটি পরিবারের মাঝে ২ লিটার সয়াবিন তেল, ১ কেজি চিনি, ২ কেজি মসুর ডাল সাশ্রয়ী মূল্যে বিক্রয় কার্যক্রম শুরু হয়েছে। এর ফলে নিম্ন আয়ের মানুষ উপকার পাচ্ছে এবং নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজার স্থিতিশীল থাকবে মর্মে আশা করা যাচ্ছে। বাজার নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে জরুরি পরিস্থিতিতে প্রতি মাসে টিসিবি কর্তৃক সাশ্রয়ী মূল্যে পিঁয়াজসহ অন্যান্য পণ্য টিসিবির ফ্যামিলি কার্ডধারী ১ কোটি পরিবারের মাঝে বিক্রি করা হবে।

সরকারি দলের এমপি মেরিনা জাহানের প্রশ্নের লিখিত জবাবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, পদ্মা সেতুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের আবেগ, আমাদের সৃজনশীলতা, আমাদের সাহসিকতা, সহনশীলতা এবং আমাদের প্রত্যয়। আমরা এ সেতু করবই, সেই জেদ। শেষ পর্যন্ত অন্ধকার ভেদ করে আমরা আলোর মুখ দেখেছি। পদ্মার বুকে জ্বলে উঠেছে লাল, নীল, সবুজ, সোনালি আলোর ঝলকানি। ৪২টি স্তম্ভ যেন স্পর্ধিত বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না, পারেনি। আমরা বিজয়ী হয়েছি।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনে শুকরিয়া আদায় করে প্রধানমন্ত্রী জানান, এতে কোটি কোটি দেশবাসীর সঙ্গে আমিও আনন্দিত, গর্বিত এবং উদ্বেলিত। অনেক বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে আর ষড়যন্ত্রের জাল ছিন্ন করে প্রমত্তা পদ্মার বুকে আজ বহু-কাক্সিক্ষত সেতু দাঁড়িয়ে গেছে। এ সেতু শুধু ইট-সিমেন্ট-স্টিল-লোহা-কংক্রিটের একটি অবকাঠামো নয়, এ সেতু আমাদের অহংকার, আমাদের গর্ব, আমাদের সক্ষমতা আর মর্যাদার প্রতীক। এ সেতু বাংলাদেশের জনগণের।

বিরোধীদলীয় নেতার স্বাস্থ্যের খবর নিলেন প্রধানমন্ত্রী : দীর্ঘদিন অসুস্থ থাকার পর সুস্থ হয়ে গতকাল সংসদে আসেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ। এ সময় বিরোধী দলনেতার স্বাস্থ্যের খোঁজখবর নিতে তার আসনের সামনে এগিয়ে যান সংসদ নেতা ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এ সময় তার সঙ্গে কুশল বিনিময় করেন ও সুস্বাস্থ্য কামনা করেন। প্রধানমন্ত্রীর এ উদ্যোগকে টেবিল চাপড়িয়ে সবাই স্বাগত জানান। উল্লেখ্য, বিরোধীদলীয় নেতা দীর্ঘদিন থাইল্যান্ডে চিকিৎসাধীন ছিলেন। গতকাল তিনি হুইল চেয়ারে বসে সংসদে আসেন। তিনি বাজেট আলোচনায় অংশ নিয়ে আবার হুইল চেয়ারে করে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করেন।

সর্বশেষ খবর