শিরোনাম
শুক্রবার, ১ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা
হোলি আর্টিজান হামলার ছয় বছর

২ সহস্রাধিক জঙ্গি জামিনে কারাগারে ২ হাজার ৩০০

সাখাওয়াত কাওসার

২ সহস্রাধিক জঙ্গি জামিনে কারাগারে ২ হাজার ৩০০

২০১৬ সালের ১৪ ও ১৫ আগস্ট ঢাকা ও গাজীপুর থেকে ইশরাত জাহান ওরফে মৌসুমী ওরফে মৌ ও খাদিজা পারভীন মেঘলাকে গ্রেফতার করেছিল এলিট ফোর্স র‌্যাব। কিন্তু আট মাসের মাথায় তারা জামিনে বের হয়ে ফের জড়িয়ে পড়েন জঙ্গিবাদে। নব্য জেএমবিকে নতুন করে সংগঠিত করার চেষ্টাকালে ২০১৮ সালের ১৭ অক্টোবর নরসিংদীর মাধবদীতে পৃথক দুটি আস্তানায় কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি) ও পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের যৌথ দলের অভিযানে ফের গ্রেফতার হন তারা। এর আগে ২০১৪ সালে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট ও আল নুসরা ফ্রন্টের হয়ে সদস্য সংগ্রহের কাজ করছিলেন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ নাগরিক সামিউন রহমান ইবনে হামদান। ওই বছরের ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ তাকে কমলাপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে। কিন্তু তিন বছরের মাথায় ২০১৭ সালের মাঝামাঝি সময়ে তিনি জামিনে বের হয়ে আসেন কারাগার থেকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে তিনি সীমান্ত পেরিয়ে চলে যান পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে। সেখান থেকেই তিনি ভারত-বাংলাদেশে জঙ্গিদের সংগঠিত করছিলেন। কিন্তু ওই বছরেরই সেপ্টেম্বরে ভারতের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাকে গ্রেফতারের পর সামিউনের জামিন নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়। শুধু সামিউন, মৌ কিংবা মেঘলা নন, বাংলাদেশের বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের শীর্ষ অনেক নেতা থেকে শুরু করে সাধারণ সদস্য অনেকেই জামিন নিয়ে ফের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছেন। অভিযোগ রয়েছে, জঙ্গিবাদ দমনে যথাযথ সমন্বয় না থাকার কারণেই জঙ্গিরা সুযোগ নিচ্ছে। একাধিক সূত্রের দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে বেশির ভাগই কোণঠাসা অবস্থায় থাকলেও শঙ্কা এখনো আনসার আল ইসলামকে নিয়ে। আন্তর্জাতিক নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার অনুসারী আনসার আল ইসলামকে ভারতীয় উপমহাদেশের আল-কায়েদার শাখা একিউআইএস (আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাব-কন্টিনেন্ট) হিসেবেও ধরা হয়। যদিও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, শীর্ষ পর্যায়ের জঙ্গিরা জামিনে বের হলে কারা কর্তৃপক্ষ সাধারণত সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশ বা পুলিশের বিশেষ শাখার সদস্যদের জানিয়ে থাকে। এরপর জামিন পাওয়া জঙ্গি সদস্যের ওপর নজরদারি করা হয়। তবে সব জঙ্গির ক্ষেত্রে এটি করা হয় না। সাধারণত শীর্ষ জঙ্গিদের ক্ষেত্রে নজরদারি করা হয়। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান, অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা জামিনে বের হয়ে আসা শীর্ষ জঙ্গিদের নজরদারি করি। তারা কেউ পুনরায় জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে কি না তা নজরদারি করা হয়। এ ছাড়া তারা জামিনে বের হয়ে এসে কার সঙ্গে যোগাযোগ করছে বা কোথায় যাতায়াত করছে তাও পর্যবেক্ষণ করা হয়।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একটি সূত্র বলছে, জঙ্গিবাদের ঘটনায় সাধারণত সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়। সারা দেশে এখন পর্যন্ত সন্ত্রাসবিরোধী আইনে প্রায় ২ হাজার ১০০ মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট আসামির সংখ্যা সাড়ে ৫ হাজারের বেশি। এসব আসামি তথা জঙ্গি সদস্যদের মধ্যে ২ সহস্রাধিক জামিনে রয়েছেন। পলাতক রয়েছেন তিন শতাধিক জঙ্গি। জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে গঠিত বিশেষায়িত ইউনিট অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের (এটিইউ) উপমহাপরিদর্শক (ডিআইজি) মো. মনিরুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে দেশ অনেক বেশি নিরাপদ। তবে সমস্যা যে একেবারেই নেই তা বলা ঠিক হবে না। আমরা সচেতন নাগরিকদের সঙ্গে নিয়েই জঙ্গিবাদ দমনের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছি।’ জানা গেছে, ২০১৮ সালে এটিইউ চালু হওয়ার পর থেকে তারা জঙ্গিদের তথ্য-উপাত্ত নিয়ে একটি ডাটাবেজ তৈরির চেষ্টা করছে। ২০০১ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা জঙ্গিবাদ তথা সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের হওয়া মামলার সংখ্যা পেয়েছেন ২ হাজার ১০০টি। এসব মামলায় ৯ হাজার আসামিকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তিন বছরে ৫৫০ জন জঙ্গি সদস্য জামিন পেয়েছেন। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটিটিসির একাধিক কর্মকর্তা বলেন, তারা নিয়মিত জামিন পাওয়া জঙ্গি সদস্যদের মনিটরিং করেন। তবে জনবল স্বল্পতার কারণে কার্যকরভাবে মনিটরিং করা যাচ্ছে না। তারা জামিন পাওয়া জঙ্গি সদস্যদের তথ্য সংগ্রহ করে প্রতি মাসে অন্তত দুইবার মোবাইলের মাধ্যমে সরাসরি জঙ্গি সদস্যের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন অথবা তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করছেন। এ ছাড়া তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সঙ্গেও যোগাযোগ করে জামিন পাওয়া জঙ্গি সদস্যের খোঁজ করেন। এ ক্ষেত্রে থানা পুলিশের বিভিন্ন বিটের দায়িত্বে থাকা সদস্যদের সহায়তা নিয়ে থাকেন তারা। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার পরিচালক লে. কর্নেল মশিউর রহমান জুয়েল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘আমরা জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়মিত মনিটরিং করে থাকি। একই সঙ্গে তাদের ডি-র‌্যাডিক্যালাইজেশনের কাজ করছি। জামিনে বের হয়ে এসে যাতে নতুন করে জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়তে না পারে বা সংগঠিত হতে না পারে সে বিষয়ে নজরদারি করা হচ্ছে। একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন, র‌্যাবই প্রথম জঙ্গিবাদে জড়িয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের আত্মসমর্পণ ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেছে।’ তবে জঙ্গিবাদ নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করেন এমন বিশ্লেষকরা বলছেন, ‘জামিনে থাকা জঙ্গিদের নিয়মিত নজরদারির কথা বলা হলেও তা আসলে অপ্রতুল। তা না হলে আমরা মাঝেমধ্যেই দেখতে পাচ্ছি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতেই এমন জঙ্গি সদস্য গ্রেফতার হচ্ছে, যারা আগেও গ্রেফতার হয়ে জেলখানায় ছিলেন। জামিনে বের হয়ে এসে আবারও জঙ্গিবাদে জড়িয়েছেন।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক কর্মকর্তা বলছেন, ঢাকার কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট জঙ্গিবাদ দমনে সফল হলেও তাদের অধিক্ষেত্র হলো রাজধানীকেন্দ্রিক। ঢাকার বাইরে অপারেশন করতে হলে সংশ্লিষ্ট জেলা পুলিশ বা পুলিশ সদর দফতরের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। আর সারা দেশের জঙ্গিবাদ দমনে ২০১৮ সালে অ্যান্টি টেররিজম ইউনিট গঠন করা হলেও এখনো জনবল সংকটের কারণে তারা প্রতিটি জেলায় কার্যক্রম চালাতে পারছে না। ঢাকা থেকে টিম পাঠিয়ে তাদের কার্যক্রম চালাতে হচ্ছে। জঙ্গিবাদ বিশ্লেষক নূর খান লিটন বলেন, জামিনে থাকা জঙ্গিদের সব সময় নজরদারির মধ্যে রাখতে হবে। বিশেষ করে যারা সুপথে ফিরতে চায় তাদের সমাজে রি-এস্টাবলিশমেন্টের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এ জন্য ডেডিকেটেডভাবে কোনো একটি সংস্থাকে কাজ করতে হবে। জঙ্গিবাদ দমনে একাধিক সংস্থা কাজ করছে। তাদের মধ্যে সমন্বয়হীনতাও দেখা যায়। জঙ্গিবাদ দমনে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে আরও কার্যকর ভূমিকা নিতে হবে।

 

 

সর্বশেষ খবর