শনিবার, ২ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

ঈদের পরই নির্বাচনী সংলাপ

ইভিএম নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত রাজনৈতিক দল

গোলাম রাব্বানী

ঈদের পরই নির্বাচনী সংলাপ

আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলো। নির্বাচন কমিশন আয়োজিত ইভিএম বিষয়ক সংলাপে অংশ নিয়ে নানা ধরনের মতামত দিয়েছে তারা। নিবন্ধিত ৩৯ দলকে ইভিএম দেখার আমন্ত্রণ জানানো হলেও অংশ নিয়েছে ২৮ দল। এ ছাড়া ইসির ইভিএম বিষয়ক সংলাপ বর্জন করেছে বিএনপিসহ ১১ দল।

সংলাপে আওয়ামী লীগ বলেছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার হলেও তাদের আপত্তি নেই। জাতীয় পার্টি বলেছে, আগামী নির্বাচন ইভিএমে হোক তা তারা চায় না। তবে পরীক্ষামূলক হতে পারে। এ ছাড়া জাসদসহ কয়েকটি দল ইভিএমের পক্ষে বললেও এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে যন্ত্রটি ব্যবহার করে জনমত গঠনের পরামর্শ দিয়েছে। এমনকি ধারাবাহিক সংলাপে বিভিন্ন পেশাজীবীরাও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে-বিপক্ষে মত দিচ্ছেন।

ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, সংলাপে অংশ নেওয়া ২৮টি দলের মধ্যে ১৪টি দল ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে কথা বলেছে। বাকি ১৪টি দল ইভিএম ব্যবহারের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং যে ১১ দল সংলাপে আসেনি তারাও ইভিএমের বিপক্ষে সব সময় কথা বলে আসছে।

এদিকে আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ‘নির্বাচনী সংলাপ’ আয়োজনের প্রস্তুতি নিচ্ছে নির্বাচন কমিশন। এ ক্ষেত্রে ঈদুল আজহার পরে আগস্টে এই সংলাপ শুরু করার পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এই সংলাপে দেওয়া সব দলের মতামতের ওপর নির্ভর করছে আগামী সংসদ নির্বাচনের অনেক কিছুই। সংসদ নির্বাচনে কত আসনে ইভিএমে ভোট হবে- সেই বিষয়ে বর্তমান নির্বাচন কমিশন এখানো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত না নিলেও প্রায় ১০০ আসনে ইভিএমে ভোটের প্রাথমিক প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে।  গত ২৮ জুন ইসির সংলাপে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, (ইভিএমে কত আসনে ভোট হবে) দ্যাট ইজ দ্য ডিসিশন অব ইলেকশন কমিশন। এটা তাদের এখতিয়ার। ... মন থেকে চাই, চেতনা থেকে চাই। ৩০০ আসনে ইভিএম হলে আমাদের কোনো আপত্তি নেই। আমরা সাপোর্ট করি। গত ১৯ জুন সংলাপে অংশ নিয়ে জাতীয় পার্টির মহাসচিব মুজিবুল হক চুন্নু বলেন, আগামী নির্বাচনে পরীক্ষামূলক হতে পারে। কিন্তু সারা দেশে ৩০০ আসনে ইভিএমে হলে এটা হ্যাপাজার্ড হয়ে যাবে। আমাদের দলের পক্ষ থেকে বলতে চাই, আগামী নির্বাচন ইভিএমে হোক তা আমরা চাই না।

গত ২৮ জুন ইভিএম বিষয়ক সংলাপের শেষ দিনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেই ইভিএম নিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন। আমরা ইভিএমের অন্ধ গ্রাহক ছিলাম না। সব আলোচনা লিপিবদ্ধ করেছি। আমাদের সামর্থ্য কতগুলো তা দেখব। এরপর সিদ্ধান্ত নেব। সম্পূর্ণ বা ফিফটি ফিফটি করব কি না সে সিদ্ধান্ত নেব। আগস্ট থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বৈঠক (সংলাপ) করব, তখন সব বিষয় নিয়ে আলোচনা করব। কোনো রাজনৈতিক চাপেও নেই বলে মন্তব্য করেন সিইসি।

নির্বাচন কমিশন বলছে, আগামী সংসদ নির্বাচনে প্রায় ১০০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের সক্ষমতা রয়েছে। তবে দলগুলোর আস্থা অর্জন হলে আরও বেশি আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের চিন্তাও রয়েছে কমিশনের। এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ইভিএমে ভোট গ্রহণ নিয়েই বিপরীতমুখী অবস্থানে রয়েছে। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নিয়েই সংসদ নির্বাচনে সবার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা এবং আস্থা অর্জনে স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে সংলাপ করেছে। ধারাবাহিক সংলাপে বিভিন্ন পেশাজীবীও নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারের পক্ষে-বিপক্ষে মত দিচ্ছেন। এদিকে সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আগামী দেড় বছরের মধ্যে প্রশিক্ষণ, দক্ষ জনবল তৈরি, প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দসহ সার্বিক কাজও গুছিয়ে নিতে হবে সাংবিধানিক সংস্থাটিকে। ইসির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ২০২৩ সালের ডিসেম্বরের শেষ দিকে বা ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে। বর্তমানে ইসির হাতে যে পরিমাণ ইভিএম সংরক্ষিত আছে, তা দিয়ে প্রায় ১০০ আসনে ভোট গ্রহণ করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট গ্রহণের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হলে, সেই প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য ইসির হাতে এখনো পর্যাপ্ত সময় রয়েছে। তারা জানান, ১১ কোটি ৩২ লাখেরও বেশি ভোটারের জন্য দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ৪২-৪৫ হাজারেরও বেশি ভোট কেন্দ্র থাকতে পারে। ভোট কক্ষ থাকবে প্রায় আড়াই লাখেরও বেশি। ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে সাড়ে ৪ লাখ ইভিএম প্রয়োজন হবে। ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ইসির কাছে এখন মোট দেড় লাখ ইভিএম আছে। ৩০০ আসনে ইভিএমে ভোট করতে হলে আরও প্রায় ৩ লাখ ইভিএম প্রয়োজন হবে। নির্বাচন কমিশন যথাসময়ে সিদ্ধান্ত দিলে সারা দেশে আগামী নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহার করা সম্ভব হবে। প্রয়োজনীয় লোকবল প্রশিক্ষণ দেওয়াও সম্ভব হবে। এ জন্য মোট ৫ লাখের মতো প্রশিক্ষিত জনবল প্রয়োজন হবে। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন নির্বাচনে ২ লাখ ৯৬ হাজার ৮৪৫ জনকে (প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা) প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২০১০ সালে ইভিএম চালুর পর স্থানীয়ভাবে তা অব্যাহত থাকে। ড. এ টি এম শামসুল হুদা কমিশন ওই ইভিএম স্থানীয় নির্বাচনে সিটি করপোরেশনে বড় পরিসরে ব্যবহার করেছিল। কিন্তু সংসদে ব্যবহার করে যেতে পারেননি। ২০১২ সালে কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ নেতৃত্বাধীন ইসি আগের ইভিএমকে অনেকটা অকেজো অবস্থায় ফেলে গিয়েছিল, সিটি নির্বাচনেও হোঁচট খায় ইভিএম ব্যবহার। কে এম নূরুল হুদা কমিশন নতুন করে ইভিএম নিয়ে এগোয়। অনেক চড়াই-উতরাই পেরিয়ে আইন সংশোধন করে একাদশ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি সংসদীয় আসনেও ইভিএম ব্যবহার করে। এ ধারাবাহিকতায় কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন ইভিএম নিয়ে এগোতে চাইছে। বর্তমান কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৫ জুন কুমিল্লা সিটি করপোরেশন এবং শতাধিক ইউনিয়নে ব্যবহার করা হয় ইভিএম। এর মধ্যে হাতিয়ার দুটি ইউনিয়ন ছাড়া বাকি সব এলাকায় ভোট হয় শান্তিপূর্ণ। ইভিএম নিয়ে অন্য কোথাও কোনো কারচুপির অভিযোগ ওঠেনি, তবে আঙুলের ছাপ দিয়ে পরিচয় শনাক্তে অনেক ভোটারকে বিপাকে পড়তে হয়েছে। ভোটগ্রহণে ধীরগতিও দেখা গেছে বিভিন্ন এলাকায়।

ইভিএম বিষয়ক সংলাপে কী পেল ইসি?

ইভিএম যাচাইয়ের সংলাপে রাজনৈতিক দলকে টেকনিক্যাল পারসন আনার আমন্ত্রণ জানানো হলেও বেশির ভাগ দলই যন্ত্রটি যাচাইয়ে টেকনিক্যাল পারসন বা প্রযুক্তিবিদ নিয়ে আসেনি। প্রথম দফায় অংশ নেওয়া ১০টি দলের কেউ টেকনিক্যাল পারসন আনেনি। দ্বিতীয় দফায় উপস্থিত আটটি দলের মধ্যে চারটি রাজনৈতিক দল নিয়ে আসে বিশেষজ্ঞদের। তৃতীয় দফায় ১০টি দলের মধ্যে কেবল জাকের পার্টি টেকনিক্যাল পারসন নিয়ে উপস্থিত হয়। অর্থাৎ সব মিলিয়ে ২৮টি দলের মধ্যে পাঁচটি প্রযুক্তিবিদ নিয়ে ইসির ডাকে সাড়া দেয়।

ইভিএমের পক্ষে : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) পদ্ধতিকে আরও জনপ্রিয় এবং সহজে ব্যবহারযোগ্য করতে নির্বাচন কমিশনকে এখনই প্রচার শুরুর পরামর্শ দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আগামী সংসদ নির্বাচনে ৩০০ আসনে ইভিএম ব্যবহার হলেও আওয়ামী লীগের আপত্তি নেই বলে জানিয়েছেন দলের সাধারণ সম্পাদক। এ ছাড়া জাসদসহ কয়েকটি দল ইভিএমের পক্ষে বললেও এই মুহূর্তে সিদ্ধান্ত না নিয়ে বিভিন্ন স্থানীয় নির্বাচনে যন্ত্রটি ব্যবহার করে জনমত গঠনের পরামর্শ দিয়েছে। অন্য যে দলগুলো ইভিএমের পক্ষে বলেছে, তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের শরিক দলই বেশি। এগুলো হলো- বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, তরিকত ফেডারেশন, সাম্যবাদী দল-এমএল, গণতন্ত্রী পার্টি, জাতীয় পার্টি (জেপি), বিকল্প ধারা। এ ছাড়া জাকের পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), গণফ্রন্ট, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশও ইভিএমের পক্ষে বলেছে। বিএনপির জোট থেকে বের হয়ে আসা ন্যাশনাল পিপলস পার্টি-এনপিপিও ইভিএমের পক্ষে বলেছে।

ইভিএমের বিপক্ষে : যেসব দল ইভিএমের বিরোধিতা করেছে, তার মধ্যে রয়েছে জাতীয় সংসদের প্রধান বিরোধী দল জাতীয় পার্টি। এ ছাড়া বিপক্ষে রয়েছে মুসলিম লীগ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ কংগ্রেস, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ, ইসলামিক ঐক্যজোট, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী ফ্রন্ট, গণফোরাম, বাংলাদেশ ন্যাপ ও বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট।

ইসি ইভিএম বিষয়ক সংলাপ বর্জন : দীর্ঘদিন থেকে ইভিএমের বিরোধিতা করে আসা বিএনপি ও তার জোটের শরিকরা ছাড়াও কয়েকটি দল ইসির ইভিএম বিষয়ক সংলাপ বর্জন করেছে। এর মধ্যে রয়েছে- বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পাটি, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, কৃষক-শ্রমিক-জনতা লীগ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি।

সর্বশেষ খবর