রবিবার, ৩ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা

♦ বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে অস্থিরতা ♦ চিন্তায় ফেলেছে উচ্চ মূল্যস্ফীতি ♦ কমছে রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়

মানিক মুনতাসির

চ্যালেঞ্জ অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা

শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানোই অন্যতম প্রধান চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। কেননা করোনা মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে চলছে অস্থিরতা। ডলারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ইউরো, পাউন্ডসহ অন্য বৈদেশিক মুদ্রার দাম। ফলে বাড়ছে আমদানি ব্যয়। এদিকে খাদ্যপণ্যের আমদানি মূল্য বেড়ে যাওয়ায় স্থানীয় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে অব্যাহতভাবে। অবশ্য জ্বালানি ও বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাবে জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়ছে অস্বাভাবিক হারে, যা মূল্যস্ফীতির চাপকে উসকে দিচ্ছে মাসের পর মাস। এ চাপ সামাল দিতে বাংলাদেশ ব্যাংক বাজারে ডলারের সরবরাহ বাড়াচ্ছে। অন্যদিকে বাজার থেকে টাকার প্রবাহ কমাচ্ছে। আবার ভারসাম্য রক্ষায় দফায় দফায় টাকার অবমূল্যায়ন করা হচ্ছে ডলারের বিপরীতে। বৃহস্পতিবার ডলারের বিপরীতে টাকার মান ৫০ পয়সা কমানো হয়েছে। আবার স্বল্প আয়ের মানুষকে কম দামে পণ্য পৌঁছে দিতে ১ কোটি ফ্যামিলি কার্ডও ইস্যু করা হয়েছে। এর পরও বাগে আসছে না মূল্যস্ফীতি, যা সরকারকে বেশ চিন্তায় ফেলেছে।

বাংলাদেশ ও বিসিএসের প্রকাশিত সবশেষ প্রতিবেদনের তথ্যমতে, গত এপ্রিলে দেশে মূল্যস্ফীতি ছিল ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ। পরের মাস অর্থাৎ মে মাসে তা ৭ দশমিক ৪২ শতাংশে ওঠে, যা গত আট বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরে তা ৫ দশমিক ৩ শতাংশে বেঁধে রাখার লক্ষ্য ঠিক করেছিল সরকার। কিন্তু সম্ভব হয়নি। ১ জুলাই থেকে নতুন শুরু হওয়া অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির গড় ৫ দশমিক ৬ শতাংশে ধরে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়েছে। বছর শেষে তা কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারে সেটি অবশ্য এখনই কিছুটা আঁচ করা যাচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, মূল্যস্ফীতির চাপ অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে অস্বস্তিকর, যা ভোক্তাসাধারণের ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করে। সাধারণ মানুষের ভোগান্তি বাড়ে। এ জন্য এই চাপ সামলে রাখাই এ বছরের অন্যতম চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম। অন্যদিকে কোরবানির ঈদ সামনে রেখেও বাড়ছে না রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি। প্রবাসীদের আয়ও কমেছে। বিদেশে কর্মী পাঠানোতেও এখন ঝুঁকি আরও বেড়েছে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্যসহ বৈশ্বিক শ্রমবাজারের সংকট মোকাবিলায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। অভ্যন্তরীণ কৃষিজ উৎপাদন খরচও বেড়েছে, বাড়ছে। রপ্তানি আয়েও বড় কোনো আশার আলো দেখা যাচ্ছে না। নতুন করে রপ্তানির বাজার অনুসন্ধানও থমকে আছে। এতে চাপের মুখে পড়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। অন্যদিকে আমদানি ব্যয় বাড়ছে। ফলে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্য রক্ষা করাও কঠিন হয়ে পড়েছে। সরকারের চলতি হিসাবে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। ফলে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানোর চ্যালেঞ্জ নিয়েই শুরু হয়েছে নতুন অর্থবছর।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গত এপ্রিলে ঈদুল ফিতরের সময় প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়লেও এর পরই মে মাসে তা ১৩ শতাংশ কমে যায়। সদ্য বিদায়ী অর্থবছরের মে মাসজুড়ে রেমিট্যান্স এসেছে ১৮৮ কোটি ৫৩ লাখ ডলার, যা আগের মাসের তুলনায় প্রায় ১৩ কোটি ডলার কম। এমনকি গত অর্থবছরের একই সময়েও দেশে এর চেয়ে বেশি অর্থ পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২০ সালের মাঝামাঝি সময়ের পর থেকে আমদানি ব্যয় বাড়তে শুরু করে। এতে ডলারের চাহিদা ও দামও বাড়তে শুরু করে। অন্যদিকে রপ্তানি ও রেমিট্যান্স কমতে থাকে। এর পর থেকে বড় ধরনের আমদানি ব্যয় পরিশোধ করতে গিয়ে ডলার সংকট শুরু হয়, যা এখনো অব্যাহত। রাশিয়া-ইউক্রেনের মধ্যকার যুদ্ধ এ সংকটে ঘি ঢেলেছে। ফলে জ্বালানির মূল্য বেড়েছে দফায় দফায়। এর প্রভাবে ডলারের বাজারের অস্থিরতা এখনো বিরাজমান। তবে এ যুদ্ধ আরও দীর্ঘায়িত হলে সংকট আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

অবশ্য নতুন বাজেটে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল বারবার বলেছেন, অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার, সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফেরানোই প্রধান লক্ষ্য। এ ছাড়া তিনি বলেন, অধিক কর্মসৃজন করা হবে। দেশীয় শিল্পকে চাঙা করা হবে। ব্যবসা-বাণিজ্যে গতি ফেরাতে করপোরেট কর কমানো হয়েছে। বাজেটে আরও যেসব বিষয়ে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে সেগুলো হলো- বেসরকারি বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, ভর্তুকির সংস্থান, ঘাটতি কমানো, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, স্থিতিশীল রিজার্ভ, ব্যাংক ঋণের সুদ হার, রাজস্ব আদায়।

এদিকে দেশের অভ্যন্তরে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে আবারও অস্থিরতা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি সামলাতে বৃহস্পতিবারও মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমানো হয়েছে। সকালের রেটের সঙ্গে বিকালের রেটও মেলে না। বিশেষ করে খোলাবাজারে ডলার, ইউরো, পাউন্ডের দাম বেড়েই চলেছে। এতে বিদেশে চিকিৎসা নিতে যাওয়া মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে সবচেয়ে বেশি। একই সঙ্গে খরচ বাড়ছে আমদানির। ভ্রমণপিপাসুদের খরচও বাড়ছে। বাজার-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্য ও জ্বালানি পণ্যের দাম ঊর্ধ্বমুখী হওয়ায় এর একটা মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে।

এ ছাড়া করোনা সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আসায় মানুষের বিদেশ ভ্রমণের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। বিভিন্ন প্রয়োজনে কিংবা ঘুরতে মানুষের বিদেশ ভ্রমণের মাত্রা বেড়েছে এবং এটা প্রতিদিনই বাড়ছে। ফলে ডলার, পাউন্ড, ইউরো, রিয়ালসহ নানা ধরনের বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা বেড়েছে। তবে ডলারের চাহিদা বেড়েছে সবচেয়ে বেশি। কেননা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত একচেটিয়া প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে আমদানি ও রপ্তানির ক্ষেত্রে ডলারই একমাত্র বিনিময়ের মাধ্যম।

এদিকে পরিস্থিতি সামলাতে টাকার মান কমছেই। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, গতকাল ডলারের দাম ৫০ পয়সা বেড়েছে। আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারে মঙ্গলবার (২৮ জুন) এক ডলারের জন্য ৯৩ টাকা ৪৫ পয়সা খরচ করতে হয়েছে গ্রাহকদের, যা দেশে ডলারের দামের সর্বোচ্চ রেকর্ড। সোমবার এই ডলারের দাম ছিল ৯২ টাকা ৯৫ পয়সা। একইভাবে ইউরোর দামও ১০০ টাকা ছাড়িয়েছে, যা ছয় মাস আগেও ৯৭ থেকে ৯৮ টাকা ছিল। ব্রিটিশ পাউন্ডের দাম ছাড়িয়েছে ১১৪ টাকা।

এদিকে গত মে মাসে ডলারের দাম বেড়ে খোলাবাজারে ১০২ টাকা অতিক্রম করে রেকর্ড গড়েছিল। সে সময় বেশ হইচই পড়ে যায়। বাংলাদেশ ব্যাংক তাৎক্ষণিক কিছু পদক্ষেপ নেওয়ায় স্বল্প সময়ের মধ্যেই তা আবার কমে আসে। বর্তমানে খোলাবাজারে ৯৯ টাকায় ডলার বেচাকেনা হচ্ছে। গতকালও খোলাবাজারে ৯৮ দশমিক ৫০ থেকে ৯৯ টাকায় লেনদেন হয়েছে প্রতি ডলার। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক মাস আগের তুলনায় বর্তমানে ডলারের বাজারে সরবরাহ কিছুটা বেড়েছে। রেমিট্যান্স ও রপ্তানি প্রবৃদ্ধি বাড়লে বাজারে সরবরাহ আরও বাড়বে। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক তদারকি বাড়ালে বাজারে অস্থিরতা কমে আসবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। তবে এ ক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর পদক্ষেপ হচ্ছে খোলাবাজার ও আন্তব্যাংক মুদ্রাবাজারের মধ্যে তফাতটা কমানো। কিন্তু এ কাজটা করা বেশ কঠিন বলে মনে করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. হোসেন জিল্লুর রহমান।

এদিকে বাজেট বাস্তবায়নের হারও কমছে। সদ্য বিদায়ী ২০২১-২২ অর্থবছরের জুন-মার্চ নয় মাসের বাজেট বাস্তবায়নের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। এতে চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে বাজেটের মাত্র ৪৪ শতাংশ বাস্তবায়ন হয়েছে, যা অর্ধেকেরও কম। বাকি ৬৬ শতাংশ মাত্র তিন মাসেই ব্যয় দেখাতে হবে। ফলে বাজেট বাস্তবায়নের গুণাগুণ নিয়ে নানা প্রশ্ন দেখা দেবে। এতেও হতাশা ব্যক্ত করেছেন অনেকেই। ফলে শুরু হওয়া নতুন অর্থবছরটা সামষ্টিক অর্থনীতির জন্য খুবই চ্যালেঞ্জের হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

সর্বশেষ খবর