শনিবার, ৯ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা
ঈদে ঘরে ফেরা

গণপরিবহনের অভাবে ভোগান্তি

মানুষের ঢল বাস টার্মিনালে, চার গুণ ভাড়া আদায়, আট ঘণ্টা পরও মেলেনি গাড়ি

জুলকার নাইন

গণপরিবহনের অভাবে ভোগান্তি

বাসের অভাবে গতকাল গাতবলীতে হাজার হাজার মানুষের ভোগান্তি সৃষ্টি হয়। এ সময় ঝুঁকি নিয়ে অনেকে ট্রাকে করেও গন্তেব্যে রওনা হন -জয়ীতা রায়

গণপরিবহনের অভাবে চরম ভোগান্তির সৃষ্টি হয়েছে ঈদযাত্রায়। ঘরমুখো মানুষের ভোগান্তির শুরু ঘর থেকে বের হওয়ার পরই। বাসস্ট্যান্ডে যাওয়ার পথে প্রয়োজনীয় পরিবহনের অভাব ও যানজটের কারণে যেতে হয়েছে হেঁটে। টিকিট বিক্রি হয়েছে তিন-চার গুণ দামে। সে দামে টিকিট কেনার পর বাসস্ট্যান্ডেই বসে থাকতে হয়েছে আট-দশ ঘণ্টা। এত কিছুর পর বাস ছাড়লেও ঘণ্টার পর ঘণ্টা অসহনীয় যানজটে বসে থাকতে হয়েছে মহাসড়কে। পরিবহন চালক ও যাত্রীরা বলছেন, ঢাকার সিটি বাসগুলো দেশের বিভিন্ন রুটে  রিজার্ভ হয়ে দূরপাল্লার যাত্রী বহন করায় ঈদে বাড়ি যেতে নগরীর বাস টার্মিনাল ও স্টেশনে পৌঁছার জন্য গাড়ি সংকট দেখা দিয়েছে। গতকাল ভোর থেকে নগরীর বিভিন্ন এলাকার বাসস্ট্যান্ডে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষার পরও অনেকে লোকাল বাস পাননি। তাদের অনেকেই বাধ্য হয়ে হেঁটে টার্মিনালের উদ্দেশে রওনা হন। কেউ কেউ রিকশা, ভ্যান ও সিএনজিচালিত অটোরিকশায় কয়েক গুণ বেশি ভাড়া দিয়ে বাস ও রেলস্টেশনে গেছেন। দিনভর রাজধানীর খামারবাড়ি মোড়, ফার্মগেট, কারওয়ান বাজার, শাহবাগসহ বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে যানবাহনের অপেক্ষায় মানুষের ভিড় দেখা গেছে। অনেকক্ষণ পরপর বাস এলে ব্যাগ-বোঁচকা নিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ছিলেন সবাই।

কল্যাণপুর-গাবতলীতে বৃহস্পতিবারের কর্মদিবস শেষে রাতেই ওই এলাকায় ভিড় উপচে পড়ে। গতকাল সকালে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না ঢাকার অন্যতম বড় এ বাস টার্মিনাল এলাকায়। শ্যামলী এনআরের কাউন্টার ম্যানেজার মুকুল বলেন, ‘সকালের (গতকাল) পরিস্থিতি চিন্তাই করা যায় না। মানুষ আর মানুষ। মনে হয় যেন গণজমায়েত হয়েছে। কয়েক বছর ধরে গাবতলী-কল্যাণপুরে এত যাত্রী দেখা যায়নি। বড় বাস কোম্পানিগুলো অগ্রিম টিকিট বিক্রি করে দিয়েছে। আমরা এখানে বসে আছি সবাইকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য।’

গাবতলী-কল্যাণপুরের অধিকাংশ কাউন্টারেই বিভিন্ন গন্তব্যের ভাড়ার মূল্য তালিকা দেখা গেছে। আগাম টিকিট বিক্রি হলেও বেশ কিছু কাউন্টারকে দেখা গেছে দ্বিগুণের বেশি দামে তাৎক্ষণিক টিকিট বিক্রি করতে। তবে এখানে প্রশাসনের চোখ এড়াতে নেওয়া হয়েছে বিশেষ কৌশল। ৫০০ টাকার ভাড়া ১০০০ টাকা লিখে রাখা হয়েছে। যাত্রীর কাছ থেকে টাকা বুঝে পাওয়ার পর টাকার অঙ্কের ওপর কাটাকাটি করতে বেশ কয়েকবার চালিয়ে দেওয়া হয়েছে কলম। তবে শেষে আর এ ধরনের রাখঢাকের মধ্যে ছিল না কেউ। গাবতলীর মতো সাভারের বাসস্ট্যান্ডে মানুষের ঢল নেমেছিল। যানবাহনের অপেক্ষায় ছিল হাজারো মানুষ।

ঢাকার যাত্রাবাড়ী ও ধোলাইপাড়ে মানুষের ঢল ছিল চোখে পড়ার মতো। কোথাও দাঁড়ানোর জায়গা ছিল না। ধোলাইপাড়ে ঢাকা-মাওয়া রুটে যাওয়ার জন্য ঢাকার লোকাল বাসগুলো ৫০০-৮০০ টাকা হেঁকেছে। প্রাইভেট কারগুলো যাত্রী টেনেছে ১০০০ থেকে ১৫০০ টাকায়।

ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে ছিল ৩০ কিলোমিটার যানজট : ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের উত্তরবঙ্গের দিকে ৩০ কিলোমিটার এলাকায় যানজটের কবলে পড়েছে ঈদে ঘরমুখো লোকজন। ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব মহাসড়কের এ এলাকাজুড়ে দীর্ঘ সারির সৃষ্টি হওয়ায় থেমে থেমে যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রী ও চালকরা। বাস না পেয়ে বিকল্প হিসেবে পরিবার-পরিজন নিয়ে খোলা ট্রাক ও পিকআপ ভ্যানে গাদাগাদি করে গিয়েছে মানুষ। মহাসড়কের বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব রেলস্টেশন এলাকায় দেখা গেছে, শত শত পরিবহন সেতু পারাপারের অপেক্ষায়। বেশির ভাগই ট্রাক। আর তাতে যাত্রীরা দাঁড়িয়ে গন্তব্যে গেছেন। মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার আশিকপুর বাইপাস পর্যন্ত উত্তরবঙ্গগামী লেনে ছিল যানজট। বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত ১৩ কিলোমিটার এলাকার দুই লেনের সড়কেও ছিল যানজট। সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাত থেকে মহাসড়কে পরিবহনের চাপ বেড়েছে। এতে সড়কে ফিটনেসবিহীন পরিবহনগুলো দীর্ঘ সময় চালানোর পর বিকল হয়ে যায়। আবার সেতুতে ওঠার পরও কিছু কিছু পরিবহন বিকল হয়ে পড়লে টোল আদায়ে বিঘ্ন ঘটে। পরে ক্ষতিগ্রস্ত গাড়িটি উদ্ধার হলে গাড়ি স্বাভাবিক গতিতে সেতু পারাপার হয়।

ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে ধীরগতি : ঈদযাত্রায় ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে যাত্রী ও যানবাহনের চাপ বেড়ে যাওয়ায় ধীরগতি ছিল যানবাহনের। মহাসড়কের চিটাগাং রোড বাসস্ট্যান্ডে পরিবহনের দীর্ঘ জটলা থাকলেও তা একেবারে স্থবির হয়ে পড়েনি। চিটাগাং রোড থেকে মেঘনা টোল প্লাজা পর্যন্ত যান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। মহাসড়কের প্রতিটি স্ট্যান্ডে ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম অভিমুখী যাত্রীর উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা গেছে। সড়কে যে পরিমাণ যাত্রী ছিল সে অনুপাতে ছিল না পরিবহনের ব্যবস্থা। এমন পরিস্থিতিতে পরিবহনগুলো যাত্রীদের কাছ থেকে বাড়তি ভাড়া আদায় করেছে।

ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে কিলোমিটার যানজট : পদ্মা সেতুর উত্তর টোল প্লাজা থেকে শুরু করে ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়েতে ছিল যানজট। গতকাল সকাল থেকেই ব্যক্তিগত গাড়ি ও গণপরিবহনে করে মানুষ পদ্মা সেতুর টোল প্লাজার সামনে এলে অতিরিক্ত গাড়ির কারণে টোল প্লাজা এলাকা থেকে এ যানজটের সৃষ্টি হয়। দুপুরের দিকে মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের পদ্মা সেতু উত্তর থানার মোড় থেকে শ্রীনগর উপজেলার দোগাছি পর্যন্ত প্রায় ৩ কিলোমিটার যানজট তৈরি হয়। টোল দিতে প্রতিটি গাড়িকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ সময়। তবে বিকাল ৩টার দিকে আবারও চাপ কমতে শুরু করে।

গণপরিবহনে ভাড়া ডাকাতির অভিযোগ যাত্রীকল্যাণ সমিতির : ঈদযাত্রায় মোটরসাইকেল বন্ধের সুযোগ কাজে লাগিয়ে গণপরিবহন সংকট পুঁজি করে সড়ক রেল নৌ পথে ভাড়া ডাকাতি ও ইচ্ছামতো যাত্রী হয়রানি চলছে বলে অভিযোগ তুলেছে বাংলাদেশ যাত্রীকল্যাণ সমিতি। গতকাল এক বিবৃতিতে বলা হয়- যাত্রীকল্যাণ সমিতির পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে রাজধানীর সিটি সার্ভিসের বাসের ভাড়া কোনো কোনো পথে পাঁচ থেকে ছয় গুণ পর্যন্ত বাড়তি আদায় করা হচ্ছে। উত্তরা থেকে সায়েদাবাদে ৫০ টাকার বাস ভাড়া ৩০০ নিতে দেখা গেছে। শ্যামলী থেকে গুলিস্তানে ৩০ টাকার বাস ভাড়া ২০০ আদায় করা হয়। ধানমন্ডি থেকে সদরঘাট ২৫ টাকার বাস ভাড়া ২০০ আদায় করা হয়। নগরীর প্রতিটি লেগুনা সার্ভিসের ভাড়া কোথাও দ্বিগুণ, কোথাও তিন গুণ আদায় করা হচ্ছে। কেরানীগঞ্জের কদমতলী ও সদরঘাট থেকে গুলিস্তানের পথ মাত্র ৩ কিলোমিটার। এ রুটে স্বাভাবিক সময়ের ভাড়া ১৫ টাকা। এখন নেওয়া হচ্ছে ৩০ থেকে ৫০ টাকা। এ চিত্র নগরীর সব লেগুনা রুটে। রিকশা ভাড়া তিন থেকে চার গুণ বাড়তি আদায় করা হচ্ছে। সিএনজিচালিত অটোরিকশায় গুলশান, বনানী, বারিধারা থেকে স্বাভাবিক সময়ে ৫০০ টাকায় সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল বা কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে যাতায়াত করা গেলেও বৃহস্পতিবার থেকে এ পথে ২ হাজার থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত ভাড়া গুনতে হচ্ছে। দূরপাল্লার যাত্রাপথে ঢাকা-রংপুর, ঢাকা-রাজশাহী, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুরসহ উত্তরাঞ্চলের প্রতিটি রুটে বিদ্যমান ভাড়া থেকে গন্তব্যভেদে ৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত বাড়তি নেওয়া হচ্ছে। অনুরূপভাবে ঢাকা-কক্সবাজার, বান্দরবান, রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি প্রতিটি রুটে এ ভাড়া নৈরাজ্য চলছে। দেশের এক জেলা থেকে অন্য জেলায় চলাচলকারী গণপরিবহনেও অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের এ চিত্র অব্যাহত আছে। পদ্মা সেতু হয়ে যাতায়াতকারী প্রতিটি রুটে বিভিন্ন নন ব্র্যান্ডের বাসে দ্বিগুণ ভাড়া আদায়ের নৈরাজ্য চলছে।

সর্বশেষ খবর