শনিবার, ৯ জুলাই, ২০২২ ০০:০০ টা

লাব্বাইক ধ্বনিতে হজ পালিত

নিজস্ব প্রতিবেদক

লাব্বাইক ধ্বনিতে হজ পালিত

গতকাল হজের দিন আরাফাতের ময়দানের জাবালে রহমত পাহাড়ে হাজিরা উপস্থিত হন -এএফপি

সৌদি আরবের ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে অবস্থান ও খুতবা শোনার মধ্য দিয়ে গতকাল পবিত্র হজের মূল আনুষ্ঠানিকতা শেষ করেছেন হাজিরা। সারা বিশ্বের ১০ লাখ মুসলমান দিনভর অবস্থান করেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বিদায় হজের স্মৃতি বিজড়িত ওই এলাকায়। সবার কণ্ঠে ‘লাব্বাইক আল্লাহুম্মা লাব্বাইক, লাব্বাইক লা শারিকা লাকা লাব্বাইক, ইন্নাল হাম্দা, ওয়ান নি’মাতা, লাকা ওয়াল মুলক, লা শারিকা লাকা লাব্বাইক’ ধ্বনিতে মুখরিত হয়ে ওঠে আরাফাত ময়দান।

বৃহস্পতিবার পবিত্র মক্কা থেকে মিনায় গিয়ে নির্ধারিত তাঁবুতে অবস্থানের মধ্য দিয়ে এবারের হজের পাঁচ দিনের ধারাবাহিক কার্যক্রম শুরু করেন হজ পালনকারীরা। দ্বিতীয় দিনে হজের মূল কাজ হিসেবে গতকাল সূর্যোদয়ের আগেই ঐতিহাসিক আরাফাত ময়দানে পৌঁছান তারা। নিয়মানুযায়ী সেখানে অস্থায়ী তাঁবু, মসজিদে নামিরা এবং আশপাশের খোলা স্থানে সূর্যাস্ত পর্যন্ত অবস্থান করেন সবাই।

দুপুরে আরাফাত ময়দানে অবস্থিত মসজিদে নামিরা থেকে হজের খুতবা দেন সৌদি সরকার নির্ধারিত দেশটির বিখ্যাত স্কলার শায়খ ড. মুহাম্মদ বিন আবদুল করিম আল ঈসা। আরবিতে দেওয়া খুতবা তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাসহ ১৪টি ভাষায় অনুবাদ করে প্রচার করা হয়। খুতবায় তিনি বলেন, ‘হে ইমানদারগণ! আল্লাহর ইবাদত করো। আল্লাহই একমাত্র মাবুদ। তাঁর ইবাদত করো। মুসলমানরা, আল্লাহকে ভয় করো। নিশ্চয়ই আল্লাহ সবকিছু জানেন।’

খুতবায় বলা হয়, আল্লাহ তায়ালা তাঁর নবীর মাধ্যমে যেসব ইবাদত করার নির্দেশ দিয়েছেন, তা পালন করতে হবে। তোমরা যা কিছু করো আল্লাহ তায়ালা সবকিছু জানেন। আল্লাহ জাকাত দিতে আদেশ করেছেন। রোজা ও নামাজ আদায় করার নির্দেশ দিয়েছেন। তাকওয়াকারীরা আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। খুতবায় আরও বলা হয়, দ্বীনের দাওয়াত দাও। আল্লাহ বলেন, মানুষকে ক্ষমা করো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, উত্তম চরিত্রের অধিকারীরা কিয়ামতের দিন আমার অনেক কাছে থাকবে। মুসলমানদের উচিত ভালো কাজে একে অপরকে সহযোগিতা করা। হজের খুতবায় বলা হয়, মুসলমানদের মানুষের উপকার করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। মানবতার গুরুত্ব দেওয়া ও সম্মান করা মুসলমানদের জন্য অত্যাবশ্যকীয়। সবচেয়ে বড় নেয়ামত হলো তাওহিদ। খুতবায় বলা হয়, যে জিনিস হিংসা-বিদ্বেষ সৃষ্টি করে তা থেকে দূরে থাকার কথা বলে ইসলামী মূল্যবোধ। আল্লাহ বলেন, মুত্তাকিদের জন্য রয়েছে জান্নাতের সুসংবাদ। সব মানুষই আদম আলাইহি ওয়া সাল্লামের বংশধর। আদম আলাইহি ওয়া সাল্লাম মাটির তৈরি। নেক কাজে তাড়াহুড়া করো। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন ছাড়া কেউ কষ্ট দূর করতে পারে না। আরাফাত ময়দানের তিন দিক পাহাড়বেষ্টিত। মাঝে সমতল ভূমি। জাবাল মানে পাহাড়। জাবালে রহমত হলো রহমতের পাহাড়। হজরত মুহাম্মদ (সা.) জাবালে রহমতের কাছে দাঁড়িয়ে বিদায় হজের ভাষণ দিয়েছিলেন। একে কেউ কেউ দোয়ার পাহাড়ও বলে থাকেন। বলা হয়ে থাকে, এই পাহাড়ে হজরত আদম (আ.) ও হজরত হাওয়া (আ.)-এর দেখা হয়েছিল।

আরব নিউজের খবরে বলা হয়, তীব্র গরম উপেক্ষা করে আরাফাতের পাথুরে ময়দানে কোরআন তিলাওয়াতে ব্যস্ত সময় পার করেন মুসল্লিরা। বিদায় হজের ভাষণ মহানবী (সা.) এই স্থানেই দিয়েছিলেন। মিসরের নাগরিক নাগতক সাদ ফারহাত খলিলের বয়স ৪৯। তিনি বলেন, ‘এখানে আসতে পেরে আমি খুব খুশি। ঠিক অন্য সবার মতো। করোনাভাইরাসের যুগে এটি সবচেয়ে বড় সমাগম। আজ এখানে ১০ লাখ মানুষ আছে। যদি সৌদিরা অনুমতি দিত, তবে ১ কোটি মানুষের সমাগম হতো।’

আরাফাত ময়দানে খুতবার পর জোহর ও আসরের নামাজ আদায় করেন মুসল্লিরা। এ ছাড়া আল্লাহর জিকিরে মশগুল ছিলেন হাজিরা। সূর্যাস্ত পর্যন্ত আরাফাতে অবস্থানের পর হাজিরা মুজদালিফায় গিয়ে মাগরিব ও এশার নামাজ আদায় করেন। রাতে সেখানে তারা অবস্থান করেন খোলা মাঠে। শয়তানের প্রতিকৃতিতে পাথর নিক্ষেপের জন্য প্রয়োজনীয় পাথর সংগ্রহ করেন সেখান থেকে।

আজ শনিবার মুজদালিফায় ফজরের নামাজ আদায় করে হাজিরা মিনায় ফিরবেন। মিনায় বড় শয়তানকে সাতটি পাথর মারার পর পশু কোরবানি দিয়ে মাথার চুল ছেঁটে (ন্যাড়া করে) গোসল করবেন। সেলাইবিহীন দুই টুকরা কাপড় বদল করবেন। এরপর স্বাভাবিক পোশাক পরে মিনা থেকে মক্কায় গিয়ে কাবা শরিফ সাতবার তাওয়াফ করবেন। কাবার সামনের দুই পাহাড় সাফা ও মারওয়ায় ‘সাঈ’ (সাতবার দৌড়ানো) করবেন। সেখান থেকে তারা আবার মিনায় যাবেন। মিনায় আরও দুই দিন অবস্থান করে তিনটি (বড়, মধ্যম, ছোট) শয়তানকে মোট ২১টি পাথর নিক্ষেপ করবেন। আবার মক্কায় গিয়ে বিদায়ী তাওয়াফ করার পর নিজ নিজ দেশে ফিরবেন হাজিরা। হজ ঘিরে এবার ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় সৌদি সরকার। নিরাপত্তা বিবেচনায় মক্কার আকাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে হেলিকপ্টার। স্বেচ্ছাসেবকরা ব্যস্ত আগতদের নানাভাবে সাহায্য করতে। পানির বোতল সরবরাহের পাশাপাশি আবর্জনা দ্রুত সরিয়ে ফেলায় ব্যস্ত তারা। তাপমাত্রা ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (১০৮ ডিগ্রি ফারেনহাইট) থাকায় বাড়তি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছেন আগতরা। হজ বিশ্বের বৃহত্তম বার্ষিক ধর্মীয় সমাবেশগুলোর একটি। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের একটি এই আনুষ্ঠানিকতা। মুসলমানদের অবশ্যই জীবনে অন্তত একবার হলেও হজ করা ফরজ। তবে এই শর্ত কেবল সামর্থ্যবানদের জন্য। এদিকে জিলহজ মাসের ১০ তারিখ হিসেবে আজ সৌদি আরবের সাধারণ মানুষ পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপন এবং  কোরবানি আদায় করবেন। নিয়ম না থাকায় ঈদের নামাজ পড়বেন না। তাদের মধ্যে ঈদের কোনো আমেজও থাকবে না। তারা সবাই হজের বাকি কাজ সম্পন্ন করতেই ব্যস্ত থাকবেন।

করোনার আগে ২০১৯ সালে সারা বিশ্ব থেকে প্রায় ২৫ লাখ মানুষের সমাগম ঘটেছিল মক্কায়। পরের বছর হানা দেয় মহামারি করোনা। সে বছর কেবল সৌদি আরবে বসবাসকারী অল্পসংখ্যক লোক অনুমতি পেয়েছিলেন হজের। পরের বছর সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৬০ হাজারে।

এবার বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ১০ লাখের বেশি মানুষ হজ করার সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে বাংলাদেশ থেকে ৬০ হাজার ১৪৬ জন ধর্মপ্রাণ মুসলমান পবিত্র হজ পালনের জন্য সৌদি আরব গেছেন। বাংলাদেশ থেকে হজযাত্রীদের সৌদি আরবে যাওয়ার ফ্লাইট ৫ জুন শুরু হয়। ৫ জুলাই ছিল সৌদি আরবে যাত্রার শেষ ফ্লাইট। হজ পালন শেষে ফিরতি ফ্লাইট শুরু হবে ১৪ জুলাই। ফিরতি ফ্লাইট শেষ হবে ৪ আগস্ট। করোনা সংক্রমণ কমে এলেও সতর্ক অবস্থানে আছে সৌদি হজ কর্তৃপক্ষ। অংশগ্রহণকারীদের টিকার ফুল ডোজ নেওয়ার সনদের পাশাপাশি পিসিআর পরীক্ষার রিপোর্ট জমা দিতে হয়েছে। এ ছাড়া মিনায় তাঁবুতে অবস্থানকারীদের মাস্ক এবং স্যানিটাইজার সরবরাহ করছে কর্তৃপক্ষ।

এ পর্যন্ত ১৫ বাংলাদেশি হজযাত্রীর মৃত্যু : হজে গিয়ে চলতি বছর ১৫ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে। ধর্ম মন্ত্রণালয়ের আইটি হেল্পডেস্ক জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার মক্কায় মারা যান ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিরিনা আক্তার। তার বয়স হয়েছিল ৫৯ বছর। এ পর্যন্ত যে ১৫ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে, তাদের মধ্যে ১০ জন পুরুষ ও পাঁচজন নারী।

সর্বশেষ খবর